
দুঃস্বপ্ন তাহলে কখনো কখনো সত্যি হয়! দিনটা ২৫ জুলাই, ১৯৮২। হোটেল রুমে একটানা বেজে যাচ্ছিল ফোনটা। রাত ভালোই হয়েছে। অমিতাভ ফোনটা ধরলেন। ফোনের ওপারে স্মিতা পাতিলের কণ্ঠ, ‘তুমি ঠিক আছ তো?’ অমিতাভ শুরুতে রসিকতাই ভেবেছিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়, মাঝরাতে এমন রসিকতার কোনো কারণ নেই। পরে স্মিতা জানালেন, অমিতাভকে নিয়ে বাজে স্বপ্ন দেখেছেন। অমিতাভ তাঁকে আশ্বস্ত করে ঘুমাতে গেলেন। কিন্তু কে জানত, সেই দুঃস্বপ্ন সত্যি হয়ে ফিরে আসবে! পরদিন সেই কুখ্যাত ২৬ জুলাই। ‘কুলি’ ছবির শুটিং সেটে ঘটে গেল ভয়ংকর সেই দুর্ঘটনা। পুরো ভারত তখন বসে গেল তাদের প্রিয় অভিনেতার জন্য প্রার্থনায়
দুর্ঘটনার মুহূর্ত
ঘটনাস্থল ছিল বেঙ্গালুরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। ১৯৮৩ সালের ‘কুলি’ ছবির একটি মারামারির দৃশ্যে নবাগত অভিনেতা পুনীত ইসারের একটি ঘুষি ভুলভাবে গিয়ে আঘাত করে অমিতাভ বচ্চনের পেটের ডান দিকে, যার ফলে তাঁর অন্ত্রে গুরুতর আঘাত পান। দৃশ্যটিতে অমিতাভ বচ্চনকে একটি টেবিলের ওপর পড়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সময়ের সামান্য ভুলে তাঁর লাফ সঠিকভাবে না বসায় তিনি গুরুতর পেটের ভেতরে আঘাত পান। সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। পরে অমিতাভ নিজেই জানান, তখন তিনি ‘প্রায় কোমায়’ চলে গিয়েছিলেন এবং ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’ ছিলেন কয়েক মিনিটের জন্য।
প্রথমে তাঁকে নেওয়া হয় বেঙ্গালুরুর সেন্ট ফিলোমেনা হাসপাতালে। সেখানেই জরুরি অস্ত্রোপচার হয়। পরে তাঁকে উড়োজাহাজে মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে আনা হয়। অবস্থার ক্রমাগত অবনতি ঘটে। ২ আগস্ট তাঁর হৃদ্যন্ত্র থেমে যায়—কয়েক মিনিটের জন্য তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
তখনই চিকিৎসক ওয়াদিয়া শেষ চেষ্টা হিসেবে একের পর এক কর্টিসন/অ্যাড্রেনালিন ইনজেকশন দিতে শুরু করেন। প্রায় ৪০টি ইনজেকশনের পর ধীরে ধীরে তাঁর দেহ সাড়া দিতে শুরু করে। পাশে থাকা জয়া বচ্চন তখন বলেন, ‘দেখো, ও বেঁচে আছে! ওর পায়ের আঙুল নড়েছে।’
সবার প্রার্থনা
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এসে তাঁর কপালে চুমু দেন, আর রাজীব গান্ধী মার্কিন সফর বাতিল করে হাসপাতালে ছুটে আসেন। হাজারো সাধারণ মানুষ শরীরের যেকোনো অঙ্গ দান করতে প্রস্তুত ছিলেন, শুধু যাতে তাঁদের ‘হিরো’ বেঁচে যান। ধর্ম, ভাষা, বর্ণ, অঞ্চল ভুলে গোটা দেশ একজোট হয়ে প্রার্থনা করেছিল এক মানুষকে ঘিরে—যিনি তখন শুধুই অভিনেতা ছিলেন না, বরং ভারতের হৃদয়।
‘কুলি’: মৃত্যু থেকে ফিরে এসে নতুন গল্প
‘কুলি’ ছবির মূল কাহিনিতে অমিতাভের চরিত্র মারা যেত। কিন্তু মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার পর পরিচালক মনমোহন দেশাই ছবির চিত্রনাট্য বদলে দেন। ছবি মুক্তির সময় সে দৃশ্যটি বিশেষভাবে চিহ্নিত করে বলা হয়—এই দৃশ্যে শুটিং চলাকালীন অমিতাভ গুরুতর আহত হয়েছিলেন।
পুনীত ইসারকে ক্ষমা
যে ঘুষি প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছিল, তা দেওয়ার পর প্রচণ্ড মানসিক চাপ ও অপরাধবোধে ভুগছিলেন পুনীত ইসার। সুস্থ হওয়ার পর অমিতাভ নিজেই অনুরোধ করেন, তাঁকে যেন হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সংবাদমাধ্যম ও ভক্তদের সামনে পুনীতকে জড়িয়ে ধরেন অমিতাভ। যেন বলছিলেন, সবকিছু ঠিক আছে।
দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব
অমিতাভের শরীরে রক্ত দেওয়া ২০০ জনের মধ্যে এক বা একাধিক ব্যক্তি হেপাটাইটিস বি ভাইরাস বহন করছিলেন। সেই সংক্রমণ ২০০০ সালে ধরা পড়ে, যা থেকে তাঁর লিভারের ৭৫ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তিনি আজীবন লিভার সিরোসিসে ভুগছেন।
‘কিছুই মনে নেই’
পরে স্টারডাস্টে এক সাক্ষাৎকারে অমিতাভ জানিয়েছিলেন, তিনি সেই সময় কোমায় ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কী হয়েছে, তা তিনি কিছুই জানতেন না। তবে অসুস্থতার সঙ্গে তিনি তীব্র লড়াই করেছিলেন বলেও জানিয়েছেন। তবে জ্ঞান ফেরার পরের লড়াই অনেক কঠিন ছিল বলেও জানিয়েছেন তিনি।
গভীর প্রভাব
এ ঘটনার স্থায়ী ছাপ পড়ে পুনীতের জীবনে। এক সাক্ষাৎকারে অভিনেতা জানান, এই ঘটনা তাঁর জীবন একেবারে বদলে দেয়। পুনীত বলেন, ‘সবাই আমাকে ভয় পেতে শুরু করল। সবাই ভুলে গেলেন যে আমি স্বর্ণপদকজয়ী, আমি শিক্ষিত অভিনেতা, ভাষার ওপরও আমার দখল রয়েছে। সব ভুলে আমি শুধু “মারকুটে” হয়ে গেলাম। তার পর থেকে শুধু এই ধরনের চরিত্রই পেয়েছি।’
মাত্র ২১ বছর বয়সে অমিতাভের বিপরীতে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলেন পুনীত। কিন্তু ‘কুলি’র এই দুর্ঘটনার পর নানাজন নানা রকম কথা বলতে শুরু করেন। পুনীত বলেন, ‘সবাই বলতে লাগল, “সামান্য ধাক্কাতেই যদি একজন মানুষের এমন হাল হয়, তা হলে সত্যিকারের মারলে কী হবে!” ফলে ছয় বছর আমার হাতে কাজ ছিল না।’ শুধু তা–ই নয়, পুনীত এর পর থেকে আর ভালো চরিত্রও পাননি বলে দাবি। কিন্তু তত দিনে সংসার পেতে ফেলেছেন তিনি। স্ত্রী রয়েছেন ঘরে। তাই রোজগারের প্রয়োজনেই বিভিন্ন ধরনের খল চরিত্রে অভিনয় করতে শুরু করেন। যেখানে তাঁকে ‘মারকুটে’ হিসেবেই দেখানো হতো।
১৯৮৮ সালে অবশ্য তিনি বি আর চোপড়ার ‘মহাভারত’-এ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান। কিন্তু সেখানেও খল দুর্যোধন। পুনীত জানিয়েছেন, দীর্ঘ ছয় বছর তাঁর হাতে কাজ ছিল না। সে সময় তিনি নিজেকে গড়েছেন। তাঁর কথায়, ‘এ ধাক্কাটা আমাকে ভালো অভিনেতা ও আরও ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে। ধৈর্য ধরতে শিখিয়েছে, ভালো বন্ধু চিনতে শিখিয়েছে।’
ফিরে আসা
সবকিছুর পর ৭ জানুয়ারি ১৯৮৩—সেই দিন আবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান অমিতাভ বচ্চন। সবার কাছে ফিরে আসেন নিজের চেনারূপে, যেন কিছুই হয়নি।
এবং ‘কুলি’
মনমোহন দেশাইয়ের ‘কুলি’ ছবিটি শেষ পর্যন্ত প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ১৯৮৩ সালের ২ ডিসেম্বর। সাড়ে তিন কোটি রুপি বাজেটের সিনেমাটি মুক্তির পর সুপারহিট হয় বলাই বাহুল্য। তখন সিনেমাটি ২১ কোটি রুপির বেশি ব্যবসা করে। এটি ছিল সেই বছরের সবচেয়ে ব্যবসাসফল হিন্দি সিনেমা।
তথ্যসূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ইন্ডিয়া ডটকম