ঋত্বিক ঘটকের জন্মশতবার্ষিকী আজ। কোলাজ
ঋত্বিক ঘটকের জন্মশতবার্ষিকী আজ। কোলাজ

‘আমি মারা যাবার পর সবাই আমাকে বুঝবে’

বেঁচেছিলেন মাত্র ৫০ বছর। বেঁচে থাকতে তাঁর শিল্পকর্মের কদর খুব একটা হয়নি। স্ত্রী সুরমা ঘোটক তাঁর বই ‘ঋত্বিক’–এ যেমন লিখেছেন, ‘বহুদিন শুনেছি “লক্ষ্মী! টাকাটা তো থাকবে না, কাজটা থাকবে, তুমি দেখে নিয়ো, আমি মারা যাবার পর সবাই আমাকে বুঝবে।” মানুষটি কি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ছিলেন?’ ঋত্বিক ঘটক নিজের চিন্তা প্রকাশ করে গেছেন তাঁর লেখা নানা বইয়ে। মৃত্যুর পর তাঁর কাজ যেন আরও ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর সিনেমা, দর্শন আর চরিত্রগুলো এখনো কতটা প্রাসঙ্গিক, তা নির্মাতার সিনেমার দর্শকমাত্রই জানেন। আজ ৪ নভেম্বর, ঋত্বিক ঘটকের জন্মশতবার্ষিকী। এ উপলেক্ষ ঋত্বিকের ‘চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরো কিছু’ অবলম্বনে নির্মাতার বয়ানে জেনে নেওয়া যাক তাঁর সিনেমা–দর্শন।

চলচ্চিত্রের স্বরূপ কী?
ফরাসি ভাষায় ‘engage’ বলে একটা কথা আছে। আমার মনে হয়, সর্ব শিল্পে সেইটিকে গ্রহণ করা উচিত। নিরালম্ব, বায়ুভূত শিল্প কখনো শিল্পের পর্যায়ে ওঠে না। মানুষটিকে কোথাও না কোথাও আত্মীকরণ করতে হয়। ভালো না বাসলে শিল্প জন্মায় না। এর প্রকাশভঙ্গি বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে, শিল্পীর মেজাজের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু মূল সূত্রটি সেই ‘সত্যম, শিবম সুন্দরম’। ভালো করে তাকিয়ে দেখুন, প্রথমে সত্য। সত্য সিদ্ধ না হলে কোনো শিল্পই শিল্পের পর্যায়ে ওঠে না। এটা প্রথম কথা।
শিবম কথাটা বাংলায় খুব প্রচারিত নয়, কথাটার মানে হচ্ছে, যা কিছু শাশ্বত। এখানে প্রশ্ন আসে যে কী শাশ্বত। সেইটাই শাশ্বত, যেটা আপনি আপনার দুঃখ দিয়ে অর্জন করেছেন। শাশ্বত হচ্ছে সেই জিনিসগুলো, যেগুলো আপনি আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে খুঁজে পেয়েছেন।

‘মেঘে ঢাকা তারা’ সিনেমায় সুপ্রিয়া চৌধুরী। আইএমডিবি

সুন্দর। এর কোনো সংজ্ঞা নেই। এটা সম্পূর্ণ আপনার রুচির ওপর নির্ভরশীল। সৌন্দর্যের কোনো মান নেই। দেশে দেশে, কালে কালে, সৌন্দর্যের মান বিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু সত্য এবং শিবকে অস্বীকার করে যে সুন্দর দাঁড়ায়, তাকে ঘৃণা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

বাংলা ছবি দেখলে কষ্ট হয়
আমার পক্ষে আধুনিক বাংলা ছবি সম্পর্কে বলা খুব কঠিন। আমি বাংলা ছবি প্রায় দেখি না। দেখলেই কষ্ট হয়। আমাদের মতো একটা দেশ, যার কোনো তুলনা নেই, আমাদের দেশের চলচ্চিত্র নির্মাণকারীরা সে দেশ সম্পর্কে কোনো খোঁজখবর রাখেন বলে মনে হয় না।
এই জন্য আমি যেটুকু দেখি, সেগুলো বিদেশি ছবি। তারা নিজের দেশকে ভালোবাসতে জানে। এই জিনিসটাই আমাদের দেশের চলচ্চিত্রকাররা পরিপূর্ণ হারিয়েছে। মানুষকে ভালোবাসা দেশকে ভালোবাসা, মানুষের জীবনসংগ্রামের সঙ্গী হওয়া, এটা হচ্ছে সর্বশিল্পের শেষ কথা। এইটে যখন হারিয়ে যায়, তখন মানুষ সব হারায়। এর ঊর্ধ্বে কোনো কথা নেই। পয়সার জন্য উল্টোপাল্টা কাজ যেকোনো লোক করতে পারে, কিন্তু তাতে কোনো জায়গায় ব্যাপারটা পৌঁছায় না। লড়াই করাই সবচেয়ে বড়ো ঘটনা। এবং সেটা করার জন্য যত রকমের দুঃখ আসুক, আঘাত আসুক ভয় করলে চলবে না।
ভেবেচিন্তে শিল্প হয় না

ঋত্বিক ঘটক

আমরা ছোটোবেলায় অ আ ক খ শিখি। তখন খুব কষ্ট করে বুঝতে হয় যে অ-টা কী রকম। তারপরে যখন বড়ো হয়ে প্রেমে পড়ি, তখন প্রেমিকাকে চিঠি লেখার সময় অ আ কি মনে থাকে।
সর্ব শিল্পও তাই। সমস্ত শিল্পে টেকনিক ভালো করে জানতে হবে, কিন্তু সেটা শেখার সময়। তার পরে ভুলে যেতে হবে। শেখাটা খালি ভোলার জন্য। ওটা রক্তের মধ্যে ঢুকে যাবে।

আমি আমার ছবিতে কী করতে পেরেছি, ঠিক জানি না। কিন্তু এই মানসিকতাই আমাকে সব সময় পরিচালিত করেছে। কাজ যেদিন আরম্ভ করেছিলাম, সেদিন আমার প্রথম শিক্ষার উন্মেষ, তখন খালি অ আ ক খ নিয়েই পড়েছিলাম। তার পরে ও-সব ভুলে গেছি। এখন যা আসে, ভেতর থেকে আসে। ভেবেচিন্তে শিল্প হয় না। ওটা প্রাণের থেকে উৎসারিত একটা ব্যাপার। যদি সেটা সত্যি হয়। পৃথিবীতে শাশ্বত সত্য বলে কোনো পদার্থ নেই, যা আছে সেটা হচ্ছে নিজের উপার্জন করা সত্য। তার বিকাশের জন্য প্রতিটি শিল্পী তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে কথা বলবেন, এটাই কাম্য।

‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্রের দৃশ্য। আইএমডিবি

মহৎ শিল্পের প্রাথমিক শর্ত
সব শিল্পকর্মেই বিভিন্ন স্তরে রস সঞ্চারিত হয়ে থাকে। অধিকারীভেদে বিভিন্ন স্তর থেকে মানুষ রস গ্রহণ করে থাকে। যেমন ধরুন ছবিতে। প্রাথমিক স্তরে একটা টানা গল্প হয়তো থাকে—হাসিকান্না, সুখদুঃখ দিয়ে বিচিত্র জীবনের নকশা আঁকা থাকে। একটু গভীর স্তরে প্রবেশ করলে দেখা যায় রাজনৈতিক, সামাজিক দ্যোতনাগুলি খেলা করছে। আরও গভীরে প্রবেশ করে যাঁর মন তিনি দেখেন দর্শনগত ও শিল্পীর আত্মচেতনা অনুসারে নির্দেশগত সংকেতগুলি। তারও গভীরে তলিয়ে যিনি যান, তিনি যে মুহূর্তগত অনুভূতির আস্বাদন লাভ করেন, তাকে কথা দিয়ে ধরা যায় না। সেই মুহূর্তগুলিতে তিনি অজ্ঞেয় কিছু একটার দোরগোড়ায় গিয়ে উপস্থিত হন।
এই সব কটি স্তরের রস আস্বাদন করা সকলের পক্ষে সমানভাবে সম্ভবপর নয়, এবং সেটা আশাও করা যায় না। যার যে স্তরে বিচরণ, তিনি সেই স্তরেই আনন্দ পাবেন, এটাই কাম্য। কিন্তু সত্যিকারের মহৎ শিল্প এর সব কটা স্তরকেই ছুঁয়ে যায়, এটা হচ্ছে মহৎ শিল্পের প্রাথমিক শর্ত।

এক্সপেরিমেন্টাল ছবি
এক্সপেরিমেন্ট বলতে আমি যা বুঝি, আমাদের দেশের কোনো ছবিই সে পর্যায়ে পড়ে না। এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে ফিল্ম ফর্মটির অবকাশ বাড়িয়ে নতুন আয়তনের পরিধিতে ব্যাপ্ত করে দেবার প্রচেষ্টা। স্থান ও কালের সম্পর্কে এ প্রচেষ্টা নিরীক্ষার পর্যায়ে উন্নীত হয়।
সারা পৃথিবীর ছবি আমি দেখিনি, তবু আমার কেমন ধারণা হয়েছে, ‘এক্সপেরিমেন্ট’ ব্যাপারটি আকছার ঘটছে না এবং সর্বত্র ঘটছে না। আমাদের দেশে তো নয়ই।
শিল্পের যত সুষ্ঠু প্রয়োগই হোক, সম্পর্কের অভিনবত্ব প্রকাশের যত মাধুর্যময় ভঙ্গিই হোক, আঙ্গিকের অবকাশকে বাড়িয়ে তোলার সম্ভাবনা প্রকট করে না তুললে কিছুতেই এক্সপেরিমেন্ট পর্যায়ে ফেলতে আমি রাজি নই।

শিল্প ও সততা
১৯৬১ সালে কানে (কান চলচ্চিত্র উৎসব) চিত্রসাংবাদিকেরা মিকেলেঞ্জেলো আন্তোনিওনিকে তাঁর ছবি সম্বন্ধে কিছু বলতে বলেছিলেন। তাতে তিনি যে উক্তি করেছিলেন তার মর্মার্থ মোটামুটি দাঁড়ায় এই ছবি করার গোড়ার শর্ত হচ্ছে সততা। নিজের অনুভূতি এবং উপলব্ধির সৎপ্রকাশ। ক্যামেরায় যে মিথ্যা কথা বলার মারাত্মক ক্ষমতা আছে, তা রীতিমতো ভীতিকর। কারণ, মিথ্যাকে সত্য বলে চালাতে ক্যামেরা যত পারে তত আর কিছুই পারে না। আন্তোনিওনির উপরোক্ত মন্তব্যগুলি শুনে আমাকে তাঁকে হঠাৎ পরমাত্মীয় বলে মনে হল।

ঋত্বিক ঘটক। আইএমডিবি

এই গভীরতম সত্যটি সচরাচর কেউ স্পষ্ট ভাষায় বলে না বলেই কথাগুলো আমার কাছে চমকপ্রদ বলে মনে হয়েছে।
কথাটা হচ্ছে, সর্বশিল্পকর্মেরই সত্যকারের শিল্পপদবাচ্য হতে হলে, সর্বপ্রথমে হতে হবে সত্যবাদী। এই হচ্ছে শিল্প বিচারের দৃঢ়তম মানদণ্ড এবং যুগ যুগ ধরে স্বীকৃত। যুগে যুগে সত্যের সংজ্ঞা পাল্টিয়েছে কিন্তু আপেক্ষিকভাবে এই মানদণ্ড থেকেই গেছে।

পরিচালকই সব
আমি বিশ্বাস করি, পরিচালকই হচ্ছেন সব। তিনিই আমাদের বল, তিনিই আমাদের তৈরি করেন, তিনি অভিনেতা-অভিনেত্রীকে যেমন প্রতিষ্ঠিত করেন, ঠিক তেমনি আমাদের সমস্ত কলাকুশলীকেও তাঁরা সুযোগ দেন, তৈরি করে নেন। ছবির স্রষ্টা হচ্ছেন পরিচালক। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার বদলে কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রীকে নিয়ে নাচানাচি শুধু অজ্ঞতার পরিচায়ক নয়, রীতিমতো পীড়াদায়ক।