আজ ২৪ ডিসেম্বর, ইলিয়াস কাঞ্চনের জন্মদিন
আজ ২৪ ডিসেম্বর, ইলিয়াস কাঞ্চনের জন্মদিন

লন্ডনে ইলিয়াস কাঞ্চনের অন্যরকম জন্মদিন, কেমন আছেন নায়ক

এবার জন্মদিনের প্রথম প্রহরে কোনো কেক কাটেননি তিনি। নেই হাসি, নেই উৎসবের কোলাহল।দূর দেশে চারদেয়ালের ভেতর, নীরব প্রার্থনা আর চিকিৎসার দীর্ঘ অপেক্ষার মধ্য দিয়ে কেটে যাচ্ছে তাঁর বিশেষ দিনটি। জীবনের এই অধ্যায়টি কোনো চলচ্চিত্রের দৃশ্য নয়, কিন্তু বাস্তবতা যেন আরও কঠিন, আরও কঠিন। ব্রেন টিউমারের সঙ্গে লড়াই করছেন তিনি—যে মানুষটি পর্দায় বারবার লড়েছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে, আজ লড়ছেন নিজের শরীরের ভেতরের এক অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে।

ইলিয়াস কাঞ্চন—নামটি শুধু একজন জনপ্রিয় নায়কের নয়, এটি এক সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। যিনি তিলে তিলে নিজেকে গড়ে তুলেছেন, যিনি নায়ক হয়েছেন পর্দার আলোয় যেমন, বাস্তব জীবনেও তেমনি। সামাজিক চলচ্চিত্র থেকে লোককথা, রোমান্টিক থেকে অ্যাকশন—সব ঘরানায় নিজেকে প্রমাণ করেছেন তিনি। আর পর্দার বাইরের জীবনে, সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রীকে হারিয়ে যিনি শুরু করেছিলেন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন—তা আজ যেন জাতীয় স্লোগানে পরিণত হয়েছে।

লন্ডনের চারদেয়ালে সীমিত জন্মদিন
আজ ২৪ ডিসেম্বর। এই গুণী অভিনেতার জন্মদিন। ১৯৫৬ সালের এই দিনে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার আশুতিয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পারিবারিক নাম ইদ্রিস আলী। বাবা আবদুল আলী, মা সরুফা খাতুন। প্রতিবছর এই দিনটি শুভেচ্ছা আর ভালোবাসায় ভেসে যেত। সহকর্মী, অনুরাগী ও শুভানুধ্যায়ীদের ফোন আর বার্তায় মুখর থাকত দিনটি। কিন্তু এবারের জন্মদিন আলাদা। উচ্ছ্বাস নেই, উৎসব নেই। এর বদলে অনুরাগীদের মনে জমেছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। কারণ, দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ এই নায়ক।

ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে প্রায় সাত মাস ধরে চিকিৎসাধীন ইলিয়াস কাঞ্চন। উন্নত চিকিৎসার জন্য ছয় মাস ধরে তিনি লন্ডনে অবস্থান করছেন। সেখানে একমাত্র মেয়ে ইসরাত জাহানের বাসায় থেকে চলছে চিকিৎসা। কথা হয় অভিনেতার জামাতা আরিফুল ইসলামের সঙ্গে। বুধবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘বাবার শরীর আগের চেয়ে ভালো। টিউমার যে সিরিয়াস কন্ডিশনে ছিল, রেডিয়েশন ও কেমোথেরাপির মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণে আছে। গত রাতে আমরা তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছি, কিন্তু তিনি কেক কাটতে পছন্দ করেন না বলে কেক কাটা হয়নি। আমরা এখন সবাই মিলে বাইরে বের হব, শহর থেকে একটু গ্রামের দিকে যাব—সেখানেই জন্মদিন উদ্‌যাপন করব।’

আরিফুল ইসলাম আরও বলেন, ‘দেশ-বিদেশ থেকে সকাল থেকেই কাছের মানুষজন এবং চলচ্চিত্রের মানুষজন ফোন দিয়েছেন। বাবাও মানসিকভাবে অনেক ভালো আছেন।’

ইলিয়াস কাঞ্চন

জানা গেছে, অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে টিউমারের বড় একটি অংশ ইতিমধ্যে অপসারণ করা হয়েছে। অবশিষ্ট অংশ রেডিয়েশন ও কেমোথেরাপির মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা চলছে। বর্তমানে তিনি একটি মেডিসিন কোর্সে আছেন। কোর্স শেষ হলে আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। রিপোর্ট দেখে পরবর্তী চিকিৎসা–পরিকল্পনা ঠিক করবেন চিকিৎসকেরা। তিনি কবে দেশে ফিরতে পারবেন—এ বিষয়ে এখনো নিশ্চিত কিছু জানা যায়নি। ঘনিষ্ঠজনেরা জানান, শারীরিক অবস্থার পাশাপাশি মানসিকভাবেও তিনি বিপর্যস্ত। গতকাল রাতে জন্মদিনের কেক কাটতেও চাননি তিনি।

শৈশব থেকে শিল্পের পথে
ইলিয়াস কাঞ্চনের জীবনটা সত্যিই ফিল্মি। ১৯৭৫ সালে কবি নজরুল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। ছাত্রজীবনে স্কাউটিং করতেন। স্কাউট ক্যাম্প ফায়ারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশ নিতেন। স্কুলজীবনেই নাটকে অভিনয় করেছেন মামা–ভাগনের ভাগনে চরিত্রে। সেই অভিনয় দেখে দর্শকের হাততালি পেয়েছিলেন—যা তাঁকে ভেতরে ভেতরে সাহস জুগিয়েছিল। স্বাধীনতার পর বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে রবীন্দ্রসংগীতে তালিম নেন। শিখেছেন নাচও। শিল্পচর্চা তখন তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল।

ইলিয়াস কাঞ্চন। ফেসবুক থেকে

মঞ্চনাটক থেকে চলচ্চিত্রে
স্কুলজীবনে ‘বাংলার মুক্তি’ নাটকে নায়িকার বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। শিক্ষকেরাও সেই নাটকে অংশ নিয়েছিলেন। বন্ধুদের সঙ্গে গড়ে তোলা ‘সৃজন সংঘ’ থেকেই নাটকের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে ইলিয়াস কাঞ্চন নিজেই বলেছেন, চলচ্চিত্রে আসার বিষয়ে তাঁর কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছিল না—ঘটনাচক্রেই সবকিছু ঘটে।

ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘আমি তখন পুরান ঢাকায় থাকি। ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে একটি মঞ্চনাটক করি। সেই নাটকের প্রধান অতিথি ছিলেন সুভাষ দত্ত। ওয়াপদা মিলনায়তনে নাটকটি দেখে তিনি আমাকে পরদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। ওয়ারীতে দেখা করার পর জানালেন, পরিবারের আপত্তি না থাকলে আমাকে নিয়ে ছবিতে কাজ করতে চান।’

‘বসুন্ধরা’ থেকে নায়ক হয়ে ওঠা
১৯৭৭ সালে সেটিই হয় তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র—আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘বসুন্ধরা’। চরিত্রটি বোঝার জন্য তিনি বারবার বইটি কিনে পড়েছেন বাংলাবাজার থেকে। ‘বসুন্ধরা’তে কাজ করার জন্য তাঁকে আর্ট কলেজে তিন মাস ক্লাস করতে হয়েছে। সেই পরিশ্রমই তাঁকে তৈরি করে দেয় বড় পর্দার জন্য।


ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তা আমাকে সব সময় সাহায্য করেছেন। “বসুন্ধরা” প্রথম এবং সাহিত্যনির্ভর ছবি। পরিচিতি গড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ছবির অবদান অনেক।’

‘গাড়িয়াল ভাই’ চলচ্চিত্রে ইলিয়াস কাঞ্চন ও অঞ্জু ঘোষ

বৈচিত্র্যের নায়ক
ইলিয়াস কাঞ্চনের অভিনয়জীবনের অন্যতম শক্তি ছিল তাঁর বৈচিত্র্য। প্রথম দিকের সাফল্যের পর একে একে আসে জনপ্রিয় সব ছবি, যেগুলো তাঁকে কেবল নায়ক হিসেবেই নয়, একজন পরিপূর্ণ অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ‘আঁখি মিলন’ ছবির “আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে” গানটি আশির দশকের দর্শকের কাছে এক সাংস্কৃতিক স্মারকে পরিণত হয়। এই গানেই গ্রামীণ আবহ, রোমান্টিক আবেগ ও লোকজ রসের মেলবন্ধনে ইলিয়াস কাঞ্চন একেবারে আলাদা মাত্রায় ধরা দেন।


অন্যদিকে ‘ভেজা চোখ’ ছবির “জীবনের গল্প, আছে বাকি অল্প” গানটি তাঁর ভাবমূর্তিকে আরও গভীর করে তোলে। এই গানে তাঁর অভিনয়ে ছিল সংযম, বিষণ্নতা আর জীবনের প্রতি একধরনের আত্মসমর্পণ—যা তাঁকে কেবল রোমান্টিক নায়ক নয়, বরং আবেগনির্ভর চরিত্রের দক্ষ অভিনয়শিল্পী হিসেবেও চিহ্নিত করে।

এই সময় থেকেই তাঁর ক্যারিয়ার ছড়িয়ে পড়ে নানা ধারায়। সামাজিক গল্পনির্ভর ছবিতে ‘মাটির কসম’, ‘নীতিবান’, ‘সহযাত্রী’, ‘প্রেম প্রতিজ্ঞা’ সিনেমায় তিনি তুলে ধরেছেন সমাজ, সম্পর্ক আর নৈতিকতার টানাপোড়েন। লোকজ ও পালাভিত্তিক ছবিতে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’, ‘গাড়িয়াল ভাই’-এর মতো চলচ্চিত্রে তাঁকে দেখা গেছে একেবারে ভিন্ন রূপে—যেখানে গ্রামীণ জীবন, মিথ, লোকবিশ্বাস ও নাটকীয়তা একসঙ্গে মিশে গেছে তাঁর অভিনয়ে।

নাটকের দৃশ্যে ইলিয়াস কাঞ্চন

অ্যাকশন ও প্রতিবাদী চরিত্রেও ইলিয়াস কাঞ্চন ছিলেন প্রায় সমানভাবে সাবলীল। ‘বাঁচার লড়াই’, ‘খুনি আসামি’সহ এ ধরনের ছবিতে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক দৃঢ়চেতা চরিত্রকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন। তাঁর অভিনয়ের বিশেষত্ব ছিল—চরিত্র অনুযায়ী নিজেকে ভেঙে নেওয়ার ক্ষমতা। কখনো সংলাপনির্ভর, কখনো নীরব অভিনয়ে, কখনো শরীরী ভাষার মাধ্যমে তিনি চরিত্রের ভেতরে ঢুকে পড়তেন।


এই ধারাবাহিক বৈচিত্র্যের কারণেই চলচ্চিত্র সমালোচকেরা তাঁকে বারবার সব্যসাচী নায়ক হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। রোমান্টিক নায়ক হিসেবে যেমন তিনি গ্রহণযোগ্য ছিলেন, তেমনি সামাজিক বাস্তবতায় নির্মিত ছবিতে কিংবা সাহিত্যনির্ভর গল্পে তাঁর উপস্থিতি ছবিকে বাড়তি ওজন দিয়েছে। লোকজ, অ্যাকশন কিংবা পারিবারিক গল্প—সব ক্ষেত্রেই তিনি নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছেন।


এই প্রতিবেদককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, অভিনয়ের প্রস্তুতির জন্য তিনি নিজ খরচে প্রশিক্ষক রেখে নাচ ও ফাইট শিখেছিলেন। পেশাগত জীবনে এসব প্রশিক্ষণ তাঁর কাজে লেগেছে।

এ কথা বললে বাড়াবাড়ি হবে না—ইলিয়াস কাঞ্চনের ক্যারিয়ার কোনো একক ঘরানায় সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি বাংলা চলচ্চিত্রের এক দীর্ঘ সময়ের দলিল—যেখানে একজন অভিনেতা সময়, দর্শক আর গল্পের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে বারবার বদলে নিয়েছেন। এই বদলে নেওয়ার ক্ষমতাই তাঁকে আলাদা করেছে, করেছে সত্যিকারের বৈচিত্র্যের নায়ক।

নির্মাতা ইলিয়াস কাঞ্চন ও হতাশা
চলচ্চিত্র নির্মাণেও হাত দিয়েছিলেন তিনি। ‘বাবা আমার বাবা’ ও ‘মায়ের স্বপ্ন’—এই দুটি ছবি নির্মাণ করেন। পরে আর পরিচালনায় ফেরেননি। চলচ্চিত্রশিল্পের সংকট, পাইরেসি, অশ্লীলতা ও বাজার সংকোচনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এখন ছবি বানালে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে গিয়ে অনুরোধ করতে হয়। সেটি আমি পারব না।’

সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন নিরাপদ সড়ক চাই–এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন

অভিনয়ের অতৃপ্তি, তবু আশার কথা
বছর দুয়েক আগে ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে কথা হয়। সে সময় চলচ্চিত্র নিয়ে তাঁর আশা ও আক্ষেপের কথা জানিয়েছিলেন। অভিনয়জীবনের দিকে ফিরে তাকালে তাঁর কণ্ঠে কোনো অভিযোগ ছিল না, ছিল একধরনের বেদনামিশ্রিত উপলব্ধি। তিনি বলেন, ‘আমি যখন পরিপূর্ণতা অর্জন করেছি, তখন অভিনয় থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে—এটাই আমার অতৃপ্তি।’

চার দশকের বেশি সময় ধরে শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তিনি এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছিলেন, যেখানে চরিত্র বাছাইয়ে ছিল পরিণত দৃষ্টিভঙ্গি, সংলাপে ছিল সংযম, আর অভিনয়ে ছিল গভীরতা। কিন্তু ঠিক সেই সময়েই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের সামগ্রিক সংকট, প্রেক্ষাগৃহ কমে যাওয়া, বিনিয়োগের অনিশ্চয়তা এবং প্রযোজনা কাঠামোর পরিবর্তনের কারণে তিনি ধীরে ধীরে অভিনয় থেকে সরে যেতে বাধ্য হন।

তাঁর অতৃপ্তির জায়গাটি এখানেই—অভিজ্ঞতা ও পরিণতির সময়েই একজন অভিনেতা সবচেয়ে অর্থবহ কাজ করতে পারেন, অথচ সেই সময়েই কাজের সুযোগ কমে যায়। তবু এই আক্ষেপ তাঁকে হতাশ করেনি। বরং চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি সব সময়ই আশাবাদী।

জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করেন ইলিয়াস কাঞ্চন ও তাঁর সংগঠন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’


ইলিয়াস কাঞ্চন বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সংকট কোনো স্থায়ী অবস্থা নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রযুক্তি, নতুন দর্শক ও নতুন নির্মাতাদের হাত ধরে আবারও সুদিন ফিরবে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের নির্মাতা ও অভিনেতাদের প্রতি তাঁর আস্থা প্রবল। তাঁদের সঙ্গে কাজ করার স্বপ্ন এখনো তাঁকে নাড়া দেয়। তাঁর ভাষায়, অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের মেলবন্ধনই পারে একটি শিল্পকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে।
ইলিয়াস কাঞ্চনের কাছে অভিনয় কেবল পেশা নয়, এটি তাঁর জীবনের পরিচয়। তাই চলচ্চিত্র ছেড়ে যাওয়ার কথা কখনো ভাবেননি। বরং জানা গেছে, তিনি চান সুস্থ হয়ে আবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে—হয়তো প্রধান নায়ক হিসেবে নয়, কিন্তু এমন সব চরিত্রে, যেখানে জীবন, সময় আর অভিজ্ঞতার ছাপ থাকবে।

আন্দোলনের নায়ক
চলচ্চিত্রের বাইরে ইলিয়াস কাঞ্চন আরেকটি ভিন্ন দুনিয়ায় নায়ক—যেখানে ক্যামেরা নেই, সংলাপ নেই, আছে বাস্তবের নির্মমতা আর মানুষের জীবনের প্রশ্ন। ১৯৯৩ সালে এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চনকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। সেই শোক ছিল ব্যক্তিগত, কিন্তু সেখান থেকেই জন্ম নেয় একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা। নিজের ক্ষতকে শক্তিতে রূপান্তর করে তিনি নেমে পড়েন সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে আন্দোলনে।

ইলিয়াস কাঞ্চন ২০১৮ সালে একুশে পদক পেয়েছেন। ছবি: সংগৃহীত

স্ত্রীর মৃত্যুর পর প্রথম দিকে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর অভিনয় করবেন না। কিন্তু এক সিনিয়র সাংবাদিকের পরামর্শ তাঁর চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে দেয়—যদি নিজের কষ্টকে হাজারো মানুষের জীবনের নিরাপত্তায় কাজে লাগানো যায়, সেটিই হবে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ। সেই উপলব্ধি থেকেই শুরু হয় ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন।
১৯৯৩ সালের ১ ডিসেম্বর এফডিসি থেকে জাতীয় প্রেসক্লাব পর্যন্ত ছিল সেই আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচি—একটি পদযাত্রা। সেদিন জনসমাগম ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেকেই এসেছিলেন তাঁকে ভালোবেসে, প্রিয় নায়ককে একনজর দেখতে। কিন্তু সেই ভালোবাসাকেই তিনি ধীরে ধীরে রূপ দেন সচেতনতায়, দাবি আর প্রতিবাদে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ কেবল একটি সংগঠনের নাম নয়, হয়ে ওঠে একটি জাতীয় দাবি ও সামাজিক চেতনার প্রতীক।


দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে কোনো বিরতি ছাড়াই এই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন ইলিয়াস কাঞ্চন। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি, বেপরোয়া যান চলাচল, চালকের অবহেলা, আইন প্রয়োগের দুর্বলতা—সবকিছুর বিরুদ্ধেই তিনি বারবার কথা বলেছেন। কখনো পদযাত্রা, কখনো মানববন্ধন, কখনো সংবাদ সম্মেলন—আন্দোলনের ভাষা বদলেছে, কিন্তু লক্ষ্য বদলায়নি।

এই আন্দোলনের পথে তিনি যেমন পেয়েছেন সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন, তেমনি পেয়েছেন অবহেলা, উপহাস ও রাজনৈতিক চাপও। তবু পিছু হটেননি। কারণ, তাঁর কাছে এটি আর কোনো সংগঠনের দায়িত্ব নয়—এটি তাঁর ব্যক্তিগত দায়, জীবনের ব্রত।
ইলিয়াস কাঞ্চনের ভাষায়, ‘আমি যদি আমার স্ত্রীর মৃত্যু থেকে কিছু শিখে থাকি, তাহলে সেটাই হলো—নীরব থাকা সবচেয়ে বড় অপরাধ।’ সেই বিশ্বাস থেকেই তিনি আজও আছেন রাজপথে, আছেন মানুষের পাশে। চলচ্চিত্রের নায়ক হয়তো একসময় পর্দা ছাড়েন, কিন্তু এই আন্দোলনের নায়ক আজও লড়াই করে যাচ্ছেন—নীরবে, নিরলসভাবে। তাঁর প্রতিষ্ঠান ও এর কার্যক্রম এখনো সক্রিয় রয়েছে।

‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ইলিয়াস কাঞ্চন অভিনীত তথা বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বাধিক ব্যবসাসফল ছবি

সম্মাননা ও ভালোবাসা
২০১৮ সালে তিনি একুশে পদক পান। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি। আজ তাঁর জন্মদিন। বিছানায় শুয়ে হয়তো বেশি সময় কাটছে তাঁর। কিন্তু কোটি মানুষের ভালোবাসা, প্রার্থনা আর আশীর্বাদ তাঁকে ঘিরে আছে। জীবনভর যিনি অন্যদের নিরাপত্তার কথা ভেবেছেন, আজ তাঁর জন্যই সবার একটাই প্রার্থনা—ইলিয়াস কাঞ্চন যেন আবার সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন।