মা ও বোনের সঙ্গে পপি
মা ও বোনের সঙ্গে পপি

পপির সঙ্গে তাঁর মা ও বোনের দ্বন্দ্বের শুরু, সমাধান কী

পারিবারিক বিরোধের জেরে হঠাৎ করে আলোচনায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী সাদিকা পারভীন পপি। বিরোধের সূত্রে খুলনার সোনাডাঙ্গা থানায় জিডি করেছেন এই নায়িকার ছোট বোন ফিরোজা পারভীন খেয়ালি। একসময় তিনিও ‘ভুল’ শিরোনামের একটি চলচ্চিত্রে নায়িকা হয়েছিলেন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে থাকতেন পপি। কখনো দ্বন্দ্বের আভাস পাওয়া যায়নি। হঠাৎ করে সপ্তাহখানেক ধরে পপির পারিবারিক দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসায় তাই অনেকে হতবাক হয়েছেন। কী এমন হয়েছে যে পপির সঙ্গে তাঁর পরিবারের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হলো। জিডি পর্যন্ত হলো। এসব জানতে যোগাযোগ করা হয় পপি ও তাঁর মা এবং বোন ফিরোজা পারভীনের সঙ্গে।

মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা পপি কিশোরী বয়স থেকে দিনরাত পরিশ্রম করে ঢাকায় নিজের একটা অবস্থান করে নেন। তাঁর সমসাময়িক অন্য জনপ্রিয় নায়িকাদের আর্থিক উন্নতির চিত্র দেখে পপি নিজের মুখোমুখি হন। হিসাব মেলাতে শুরু করেন। সেই যে নবম শ্রেণিতে কাজ শুরু, আরও পার হয়েছিল ২০ বছরের বেশি সময়।

সাদিকা পারভীন পপি

পপি বলছিলেন, আয়–ব্যয়, ব্যাংক–বিমার খোঁজ তিনি রাখতেন না। খোঁজ রাখতেন তাঁর মা–বাবা। ঢাকার বাড়িভাড়া থেকে শুরু করে সংসারের অন্য সব ব্যয় তিনিই করতেন। ব্যাংকে কত টাকা জমা হলো, কোথায় কত খরচ হলো, কোনো দিন তিনি খোঁজ রাখেননি; বরং একদিন জানতে পারলেন, তাঁর বাবার সঙ্গে তাঁর যে যৌথ ব্যাংক হিসাব ছিল, সেই হিসাবে যে অর্থ ছিল, সেটি অন্য আরেকজনের ব্যাংক হিসাবে পাঠানো হয়। এই খবর শোনার পর তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন।

কাঁদতে কাঁদতে পপি প্রথম আলোকে বললেন, ‘আমি এক হতভাগা মেয়ে। নিজের হাতে ভাই–বোনদের মানুষ করেছি। নিজের আয়ে মা–বাবা, পরিবার–পরিজনকে ভালো রাখতে চেষ্টা করেছি। যে মা–বাবা আমাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, তারাই আমার অর্থ ব্যাংক থেকে সরিয়ে ফেলবে, সেটি কোনো দিন কল্পনাও করিনি। কিন্তু বাস্তবে সেটিই ঘটেছে। আমি যখন জানলাম, আমার ব্যাংকে জমানো টাকা অন্য একজনের ব্যাংক হিসাবে দিয়ে দিল, আমি মা–বাবার কাছে কৈফিয়ত চাইলাম। কোনো জবাব পাইনি। উল্টো আমি হয়ে গেলাম শত্রু। আজও আমি তাদের কাছে শত্রু হিসেবে গণ্য হলাম।’

সাদিকা পারভীন পপি

পপির এসব অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন তাঁর মা মরিয়ম বেগম। মেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করার গল্প বলতে গিয়ে বারবার তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছিলেন। তিনি বলছিলেন, পপি তো তাঁর একমাত্র সন্তান নয়। তাঁর আরও পাঁচটি সন্তান রয়েছে। কিন্তু পপিকে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি যেভাবে দিনের পর দিন সময় ব্যয় করেছেন, অর্থকড়ি দিয়ে সহায়তা করেছেন, সেই পপি তাঁর সব অবদান অস্বীকার করবেন, অসম্মান করবেন, ভাত খাওয়ানোর খোঁটা দেবেন, সেটি তিনি কল্পনাও করেননি।

মরিয়ম বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার তো চার মেয়ে, দুই ছেলে। আমার স্বামী ছিলেন ব্যবসায়ী। সোনাডাঙ্গায় আমাদের পরিবারকে সবাই জমিদারবাড়ি হিসেবে চেনেন। আমার স্বামীর ধানি জমির পাশাপাশি শহরে বেশ কয়েক কাঠা সম্পত্তি রয়েছে। পপিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমরা একসময় ঢাকায় গিয়ে থিতু হই। আমার স্বামীর আয় ও পপির সহযোগিতায় আমরা ভালোই ছিলাম। ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছি। সবাই বিয়েশাদি করেছে। তবে আজ থেকে ১৮ বছর আগে পপির পাগলামি আমাদের পরিবারে অশান্তির জন্ম দেয়।’

পপি

পপির মায়ের ভাষ্যে, একসময় পপি দাবি করলেন, তিনি যেহেতু পরিবারের সংসারের ব্যয়সহ সব ধরনের ব্যয় মিটিয়ে চলেছেন, সুতরাং সোনাডাঙ্গায় তাঁর স্বামীর যে ১১ কাঠা সম্পত্তি রয়েছে, তার ৬ কাঠা তাঁকে লিখে দিতে হবে। পপির এই বক্তব্য শোনার পর সংসারে রীতিমতো ঝড় ওঠে। পপির এই দাবি কোনোমতেই মানতে রাজি নন তাঁর স্বামীসহ অন্য সন্তানেরা। নাছোড়বান্দা পপি তাঁর বাবাকে একপ্রকার জিম্মি করে সেই ৬ কাঠা সম্পত্তি নিজের নামে লিখিয়ে নেন।

ফিরোজা পারভীন খেয়ালি, পপির এই বোন ‘ভুল’ নামে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন

পপির বোন ফিরোজা পারভীন খেয়ালি দাবি করেন, যে ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে তাঁর বাবার কাছ থেকে পপি ৬ কাঠা জমি জোরপূর্বক লিখে নিয়েছিলেন, সেই টাকা কোন ব্যাংকে, কার হাতে দিয়ে দিয়েছিলেন, তার কি কোনো প্রমাণ আছে? আর পপির মা বললেন, ‘যেভাবেই পপি ওই ৬ কাঠা জমি আমার স্বামীর কাছ থেকে লিখে নিক, টাকা দিয়ে নিক বা টাকা না দিয়ে নিক, তাতে আমার বা আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু পপি আমার স্বামীর ১১ কাঠার জমি নিজের নামে নামজারি করে নিয়েছে, এই খবর পেয়েছিলাম কয়েক দিন আগে। আমি তো ভাবতেও পারিনি পপি এমন কাজ করবে। আমার কি অন্য সন্তান নেই? তারা কি তাদের বাবার সম্পত্তিতে ভাগ পাবে না। পপি না হয় স্টার, আমার অন্য সন্তানেরা তো সাধারণ মানুষ।’

মা এবং বোনের এসব অভিযোগ রীতিমতো অসত্য বলে প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন পপি। তাঁর ভাষ্য, সিনেমা করেই তাঁর যত আয়, এর বেশির ভাগই নিয়েছেন তাঁর মা–বাবা, ভাই–বোনেরা। তিনি এতটা অসহায় হয়ে পড়েন, যখন তাঁর কয়েক কোটি টাকা সরিয়ে ফেলা হয়। তখন কৈফিয়ত চাওয়ার পর তাঁর বাবা সুস্থজ্ঞানে ১১ কাঠা জমির মধ্যে ৬ কাঠা জমি তাঁকে লিখে দিয়েছিলেন। সেটি তিনি নামজারি করেছেন। বাবা লিখে দিলেও বহু বছর ধরে সেই সম্পত্তি থেকে যে আয়, তা মা-বোনেরাই নিতেন। তিনি কোনোভাবেই তাঁর বাবার অন্য পাঁচ কাঠা জমি নিজের করে নেননি; বরং তাঁর কেনা যে ৬ কাঠা সম্পত্তি, সেই সম্পত্তির দখল নিতে যাওয়ায় তাঁর মা ও অন্য ভাইবোনেরা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন।

মা মরিয়ম বেগমের সঙ্গে চিত্রনায়িকা পপি

প্রথম আলোকে তাঁর বাবার কাছ থেকে যে ৬ কাঠা সম্পত্তি কিনেছিলেন, তার দলিলসহ অন্যান্য প্রমাণপত্র দেখিয়েছেন।

জমি, অর্থ, সম্পর্কের টানাপোড়েন—এ সমস্যার সমাধান কী, সে বিষয়ে জানতে চাইলে পপির মা বললেন, ‘আমি তো চাই আমার সব সন্তান মিলেমিশে থাকুক। আমি আর কত দিনইবা বেঁচে থাকব। আমার পপি সবার বড়, আল্লাহ তো ওকে অনেক দিয়েছে। সে যদি আমার স্বামীর ওই পাঁচ কাঠা জমি নিজের করে নিয়ে থাকে, তাহলে আমি ছাড়ব না। ওই জমির মালিক আমার ওই সন্তানেরা। পপি যদি মন নরম করে আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়, সমাধান চায়, তাহলে এর সমাধান হবেই। আর যদি পপি গোঁয়ার্তুমি করে, তাহলে ওই জমি নিয়ে আমরা আইনগত পদক্ষেপ নেব।’

পপিও সমাধান চান। এই চিত্রনায়িকা বললেন, ‘ওই পাঁচ কাঠা জমি নিয়ে আমার তো কোনো মাথাব্যথা নেই। আমার জমি নিয়ে কেউ যেন টানাটানি না করে। আমার জমি নিয়ে যদি কেউ টানাটানি করে, আমাকে বিপদে ফেলতে চায়, আমি কাউকে ছাড়ব না। আমি চাই, আমার মা, ভাই–বোনদের যে জমি আছে, তা তারা ভোগদখল করুক। ভালো থাকুক তারা। আমি সেটিই চাই। আমি একজন নায়িকা, আমার সম্মান আছে। আমার সম্মান নিয়ে যেন কেউ টানাটানি না করে।’