‘ইনসাফ’–এ শরীফুল রাজ ও তাসনিয়া ফারিণ। রাজের ফেসবুক থেকে
‘ইনসাফ’–এ শরীফুল রাজ ও তাসনিয়া ফারিণ। রাজের ফেসবুক থেকে

‘ইনসাফ’, যত গর্জে তত বর্ষে কি

সিনেমা মুক্তির আগেই পোস্টার, টিজার ও আইটেম গান মন্দ ছিল না। মোটের ওপর দর্শকদের আগ্রহের বিচারে ওপরের দিকেই ছিল বাণিজ্যিক সিনেমাটি। মুক্তির পরে ‘ইনসাফ’ কি পারল দর্শকদের প্রত্যাশা মেটাতে? টিজারে ভেসে আসা ভয়েস ওভারের সূত্র ধরেই শুরু হয় ‘ইনসাফ’। ঢাকা শহরে হঠাৎ অপরাধ বেড়ে গেছে। সবাই ভাবছে, এর পেছনে রয়েছেন একসময়ের ত্রাস, ডন ইউসুফ। তবে ইউসুফ তো ঢাকার বুক থেকে হারিয়ে গেছেন পাঁচ বছর আগে। তাঁর লাশও শনাক্ত করা হয়েছে। তবে কি ইউসুফ মরেননি? নাকি নতুন কোনো ত্রাস এসেছে এ শহরে?

একনজরেসিনেমা: ‘ইনসাফ’ধরন: অ্যাকশন–থ্রিলাররানটাইম: ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিটকাহিনি: নাজিম উদ দৌলা, স্বরূপ দে, সঞ্জয় সমাদ্দারচিত্রনাট্য: নাজিম উদ দৌলাপরিচালক: সঞ্জয় সমাদ্দারঅভিনয়: শরীফুল রাজ, তাসনিয়া ফারিণ, ফজলুর রহমান বাবু, মিশা সওদাগর, মোশাররফ করিম

পুলিশ বিভাগ ইউসুফের মৃত্যুর খবর পেয়ে যখন তাঁর কেস বন্ধ করতে যাচ্ছে, তখনই এএসপি জাহান খান গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র পান। জানতে পারেন, ইউসুফ এখনো মারা যাননি। অনেক খুঁজে ও সূত্র ধরে বুঝতে পারেন, ইউসুফ গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন সিলেটে। সিলেটের পথে পা বাড়ান জাহান। সেখানে পাওয়া যায় লাবু মাস্টারকে, যার কিনা ইউসুফের সঙ্গে চেহারার হুবহু মিল। কিন্তু সব সূত্র মিথ্যা প্রমাণ করে দেয় লাবু মাস্টার। দুঁদে পুলিশ জাহানও একপর্যায়ে মেনে নেন—এ ইউসুফ নন, নেহাতই এক আর্টের টিচার, লাবু মাস্টার। কিন্তু তত দিনে ইউসুফকে যাঁরা মেরেছেন, তাঁরা পিছু নিয়েছেন লাবু মাস্টারের। সহজ–সরল লাবু মাস্টারকে বাঁচতে দেবেন না তাঁরা। পুলিশ অফিসার জাহানের একটা ভুল কি লাবু মাস্টারের জীবন বিপন্ন করে তোলে? নাকি ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে?

‘ইনসাফ’–এ লাবু মাস্টার ও ইউসুফ দুটি চরিত্রেই অভিনয় করেছেন শরীফুল রাজ। আগে ‘পরাণ’, ‘হাওয়া’, ‘দেয়ালের দেশ’–এ অভিনয় করে নিজের জাত চিনিয়েছেন তিনি। তবে পুরোদস্তুর বাণিজ্যিক ধারার অ্যাকশন সিনেমায় রাজ এই প্রথম অভিনয় করলেন। সিনেমায় দুটি ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করলেও তিনি চরিত্র দুটি বেশ ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

‘ইনসাফ’ সিনেমার পোস্টার

রাজের বিপরীতে ছবিতে এএসপি জাহান চরিত্রে দেখা গেছে তাসনিয়া ফারিণকে। আগে ঢাকা ও কলকাতায় সিনেমা করলেও (‘আরো এক পৃথিবী’, ‘ফাতিমা’) তিনিও বাণিজ্যিক সিনেমায় প্রথম। এ সিনেমায় পুলিশ অফিসারের লুকে তাঁকে দারুণ মানিয়েছে। অ্যাকশন দৃশ্যগুলোয় তিনি চলনসই। তবে কিছু দৃশ্যে তাঁর আরও ভালো করার সুযোগ ছিল। বিশেষ করে তিনি যখন থানায় আসামি পেটাচ্ছিলেন, দেখে মোটেও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি।

ইউসুফের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মিশা সওদাগর যথারীতি ভালো অভিনয় করেছেন। ইউসুফের বাবার চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবু মানিয়ে গেছেন। শেষ দিকে বড় চমক ছিলেন শমশের ডাক্তারের চরিত্রে মোশাররফ করিম। অ্যাকশন দৃশ্যে তিনি যে খুব সাবলীল ছিলেন, তা বলা যাবে না। তবে এর চেয়ে বড় সমস্যা তাঁর অভিনীত চরিত্রটির হঠাৎ বিপ্লবী হয়ে ওঠার ভালো ব্যাখ্যা নেই সিনেমায়। এ সিনেমায় তাঁর ভূমিকা ঠিক কী, সেটা আরও ভালোভাবে বোঝানোর প্রয়োজন ছিল।

‘ইনসাফ’ ছবির পোস্টারে এভাবেই দেখা গেছে মোশাররফ করিমকে। ফেসবুক থেকে

‘ইনসাফ’–এর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা চিত্রনাট্য ও পরিচালনা। সিনেমায় প্রেম, ধোঁকা, মৃত্যু, বিপদ এসব আবেগপ্রবণ ও রোমাঞ্চকর মুহূর্ত ছিল। কিন্তু এসব দৃশ্যের সঙ্গে খুব কম সময়ই দর্শক একাত্মবোধ করতে পেরেছেন। অ্যাকশন–রোমান্স মিলিয়ে উপভোগ্য বাণিজ্যিক সিনেমার রসদ ‘ইনসাফ’–এর ছিল। কিন্তু লেখক–নির্মাতা সিনেমার সঙ্গে ঠিক ‘ইনসাফ’ করতে পারেননি।

একটি সাধারণ পরিবারের ছেলের ডন হয়ে ওঠার পেছনে যে গল্প দেখানো হয়েছে, সেটা যথাযথ মনে হয়নি। তেমনি যথাযথ লাগেনি এত সহিংসতার পেছনের কারণও। ফারিণের সঙ্গে রাজের প্রেম কীভাবে হলো, সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ইউসুফের পরিচয় জানার পরেও এমন দুঁদে পুলিশ অফিসারের বদলে যাওয়া মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। এই জায়গায় চাইলেই আরেকটু ভালোভাবে উপস্থাপন করা যেত।

‘ইনসাফ’ ছবির পোস্টারে এভাবেই দেখা গেছে তানসিয়া ফারিণকে

আর্টের শিক্ষক আর অ্যাকশন হিরো হিসেবে রাজের লুক ভালো ছিল, তবে অ্যাকশন দৃশ্যগুলো আরও জমাটি হতে পারত। ট্রেলারে যতটুকু দেখানো হয়েছে, এর বাইরে পুরো সিনেমায় নতুন কিছু কি দেখতে পেলেন দর্শক? ফারিণকে ‘গ্ল্যামারাস কপ’ হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও তাঁর অ্যাকশন দৃশ্যগুলোয় অযত্নের ছাপ ছিল স্পষ্ট। চাইলেই আরেকটু বাস্তবধর্মী করা যেত, বিশেষ করে শাড়ি পরে অ্যাকশন দৃশ্যটি হতে পারত আইকনিক।

শেষ দিকে মোশাররফ করিমের উপস্থিতিটা যেন হুট করেই আসা। নায়ক আর ভিলেন যখন মুখোমুখি, সেখানে একটা ধুন্ধুমার কিছু হবে, এটাই তো সবাই দেখতে চান। কিন্তু এ দৃশ্যটি যেন বড় সাদামাটা। পুরোনো দিনের বাংলা সিনেমার মতো, কোনো নতুনত্ব নেই। শুরুর দিকে প্রসেনজিৎ চৌধুরীর ক্যামেরায় ওয়াইড শর্ট আর লং টেকগুলো দেখতে মন্দ লাগছিল না, কিন্তু পরের দিকে গল্প এগিয়ে নিতে ক্যামেরার ভূমিকা ছিল কমই।

‘ইনসাফ’ সিনেমার একটি দৃশ্যে

আবহ সংগীতে ছিলেন আরাফাত মহসীন। এই ঈদেই মুক্তি পাওয়া তাণ্ডব–এ তিনি যতটা উজ্জ্বল, এ সিনেমায় তাঁর কাজ ততটা ছাপ ফেলতে পারেনি। একইভাবে পুরো সিনেমায় তেমন মনে রাখার মতো সংলাপও নেই। ‘তোমার খেয়ালে’ গানটিতে অনেক দিন পর হাবিব ওয়াহিদকে পাওয়া গেল। তবে ছবির সব গানের কোরিওগ্রাফিই গড়পড়তা মানের। এমনকি সিনেমার শেষে আইটেম গান ‘আকাশেতে লক্ষ তারা’ ঘরমুখী দর্শককে বসিয়ে রাখতে পারেনি।

ঢাকাই সিনেমায় এখন সমসাময়িক নানা বিষয় উঠে আসছে। ‘ইনসাফ’–এও যেমন এসেছে বেকারত্ব, দুর্নীতি প্রসঙ্গ, আছে পিএসসির চেয়ারম্যানের ড্রাইভারের বহুল চর্চিত দুর্নীতি প্রসঙ্গ। এ ছাড়া মেডিকেল সিন্ডিকেট, ভেজাল ওষুধ, সরকারি হাসপাতালের ওষুধ সাধারণ মানুষকে বিনা মূল্যে না দিয়ে বাইরে বিক্রির মতো বিষয়গুলো নিয়ে এসে বার্তা দিতে চেয়েছেন নির্মাতা।

সবশেষে সিনেমায় আছে বড় চমক, অতিথি চরিত্রে হাজির হন চঞ্চল চৌধুরী। এটা দিয়ে কি সিনেমাটিক ইউনিভার্সের ইঙ্গিত দিলেন নির্মাতা? সেটাই যদি হয়, তাহলে সিনেমায় তাঁর আগমনের হেতু আরও ভালোভাবে বোঝানোর প্রয়োজন ছিল।
সব মিলিয়ে টিজারে দেখানো সংলাপের মতো ‘বিল্ড আপ, বিল্ড আপ’ করেও শেষ পর্যন্ত `ইনসাফ'-এর ল্যান্ডিং ভালো হয়নি ।