‘বাড়ির নাম শাহানা’ সিনেমায় দীপা চরিত্রে অভিনয় করেছেন আনান সিদ্দিকা
‘বাড়ির নাম শাহানা’ সিনেমায় দীপা চরিত্রে অভিনয় করেছেন আনান সিদ্দিকা

বাংলাদেশ থেকে অস্কারে যাচ্ছে, কী আছে এই সিনেমায়

‘দাদা, শাস্তি ধাইর্য্য হইসে। কারা খাটতে যাই। এই কারাবাসে আপিলের সুযোগ নাই,’ বিয়ের রাতে নিজের অসহায়ত্ব তুলে ধরে ভাইকে কথাটা বলেছিলেন শাহরিন দীপা (আনান সিদ্দিকা)। গল্পের পটভূমি নব্বইয়ের দশক। কৈশোর পার হওয়ার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হয় দীপা। স্বামীকে সে চেনে না, আগে দেখেওনি। শুধু জানে যার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে, সে তার মামির ভাইয়ের ছেলে, লন্ডন থাকে। বিয়ে পড়ানো হয় ফোনে। ট্রাংককলের বিয়ের আসরে দীপা কবুল বলেছিল কি না, তাও কেউ বলতে পারে না; কিন্তু মুরব্বিরা বলেন, ‘মেয়েরা মাথা ঝোঁকালেই কবুল।’ হারিয়ে যাওয়া ভাইয়ের সঙ্গে কাল্পনিক কথোপকথনে দীপার অসহায়ত্ব আরও বেশি করে ফুটে ওঠে। কলতলায় প্রায়ই সে ভাইকে দেখতে পায়। তার ‘একা’ জীবনে একমাত্র সঙ্গী এই হারিয়ে যাওয়া ভাই। কিন্তু নিজের অসহায়ত্ব মেনে নেওয়ার মেয়ে দীপা না। পরিবার, সমাজ আর স্বামীর বিরুদ্ধে গিয়ে ঠিকই নিজের লড়াইটা সে চালিয়ে যায়।

একনজরেসিনেমা: ‘বাড়ির নাম শাহানা’ধরন: ড্রামাপরিচালক: লীসা গাজীচিত্রনাট্য: লীসা গাজী, আনান সিদ্দিকাঅভিনয়: আনান সিদ্দিকা, লুৎফর রহমান জর্জ, কাজী রুমা, ইরেশ যাকের, কামরুন্নাহার মুন্নী, মুগ্ধতা মোর্শেদদৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ১৮ মিনিট

বিয়ের পরের দৃশ্যেই দেখা যায় দীপার হাতে ডিভোর্স পেপার। বিচ্ছেদ কেন হয়? দীপার সেই লড়াইয়ের গল্পই পর্দায় তুলে এনেছেন লীসা গাজী। ‘বাড়ির নাম শাহানা’ তাঁর প্রথম সিনেমা। দেশে নারীদের গল্প নিয়ে সিনেমা হয় কম। আর নারী নির্মাতার বানানো নারীর গল্প তো বিরল ঘটনা। নিজের আর আশপাশের মানুষের জীবনের সত্য ঘটনা অবলম্বনে এবার সেই গল্পই পর্দায় তুলে এনেছেন লীসা গাজী। সিনেমার প্রধান অভিনেত্রী আনান সিদ্দিকার সঙ্গে যৌথভাবে চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন নির্মাতা।

সিনেমার মূল সুর নারীর লড়াই; পাশাপাশি উঠে এসেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, ধর্মান্ধতার মতো বিষয়। কিন্তু এগুলোর কিছুই লেকচারের মতো শোনায়নি, নারীবাদের ক্লাসও নেননি নির্মাতা; বরং ডাকাবুকো চরিত্র দীপার মাধ্যমে গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। মোটাদাগে বিষয়বস্তু শুনে যতটা গুরুগম্ভীর মনে হয়, ‘বাড়ির নাম শাহানা’ মোটেও তেমন বিষণ্ন কোনো সিনেমা না, বরং উদ্‌যাপনের গল্প।
নন–লিনিয়ার (অ–সরলরৈখিক) ভঙ্গিতে গল্প বলেছেন লীসা গাজী। গল্প শুরু হয় বিয়ে দিয়ে, পরে বর্তমানে ফিরে আসে; মাঝে আবার দেখানো হয় লন্ডনের ছোট্ট এক উপশহরে দীপার প্রবাস সংসার। ছোট বড় নানা ঘটনা আর চরিত্র দিয়ে দীপার পুরো যাত্রাটা দেখিয়েছেন নির্মাতা।

‘বাড়ির নাম শাহানা’ সিনেমার দৃশ্য। ছবি : প্রযোজনা সংস্থার সৌজন্যে

সমাজের প্রচলিত ‘ভালো মেয়ে’র ছাঁচে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেনি দীপা। স্বামীর সঙ্গে থাকতে সে যখন বিলেত যায়, তার প্রতি পদক্ষেপে ফুটে ওঠে এক ডানাভাঙা পাখির যন্ত্রণা। সিনেমাটির অন্যতম বড় শক্তি সংলাপ। স্বামী-স্ত্রীর একান্ত কথোপকথনের মাধ্যমে অনেক বক্তব্য দর্শককে জানিয়ে দিয়েছেন নির্মাতা। নারীকে ‘মানুষ’ হিসেবে গণ্য না করা, তার চাওয়া-পাওয়ার কোনো মূল্য না দেওয়ার মতো বিষয়গুলো সহজাতভাবে এসেছে। দেশের বাইরে গেলেও নারীরা যে স্বাধীন হয়ে যায় না, বরং ক্ষেত্রবিশেষে হয়ে ওঠে আরও পরাধীন; পর্দায় সেটাই ফুটে উঠেছে।

‘বাড়ির নাম শাহানা’ যেন আমাদের চারপাশের সমাজের টুকরা টুকরা চিত্র। শুধু পড়ালেখা করার জন্য দীপাকে বাবার পা ধরে আকুতি করতে দেখা যায়। ‘ঘর ভাঙা মেয়ে’ বলে বিয়ের অনুষ্ঠানে তাকে মুখের ওপর আসতে না করা হয়। অন্যদিকে ‘মাথায় সমস্যা আছে’, ‘জিনের আসর’—এসব বলে তার ওপর অত্যাচারের নানা খড়্গ ঝুলে থাকে। সেই দীপাই যখন সফল হয়, তখন সমাজের সবাই তার কৃতিত্বের ভাগ নিতে আসে। ছোটবেলায় বিয়ে দেওয়া মামা-মামিও বলে ওঠে, ‘আমার প্রেশারটা একটু মেপে দে তো।’ বাবাও পুরো পাড়ায় মিষ্টি বিলি করে।

‘বাড়ির নাম শাহানা’ সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে রয়েছে আয়না। ছবি : প্রযোজনা সংস্থার সৌজন্যে

সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে রয়েছে আয়না। দীপার সবচেয়ে ভালো বন্ধু যেন আয়না। তার সফলতা, অসহায়ত্ব, উল্লাস থেকে কান্না—সব সময়ের সঙ্গী আয়না। তালাক দেওয়ার পর দীপা যখন আয়নার সামনে উল্লাস করে বলে, ‘সাত বছর ঝুলে ছিলাম, তালাক পাইছি’, তখন আয়নার কাল্পনিক প্রতিউত্তর যেন সে শুনতে পায়। খুশিতে নাচতে শুরু করে। আবার লন্ডনের বন্দিজীবন থেকে সে যখন পালায়, গাড়ির রিয়ার ভিউ মিররে আবার নিজের মুখোমুখি হয় দীপা।

মাছ কাটা আর ভাজার সঙ্গে দীপা আর পরীর (মুগ্ধতা মোর্শেদ) জীবনকে যেভাবে নির্মাতা রূপক অর্থে দেখিয়েছেন, সেটার তারিফ করতে হয়। সিনেমার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো ‘বিয়ার গান’, ‘জলের পদ্ম’, ‘আমি বাঁধিনু তোমারে’-র মতো গানের সঙ্গে গল্পকে মেলানো। লীসা গাজীর লেখা শাহানা বাজপেয়ী ও সোহিনী ইসলামের কণ্ঠে গানগুলো ছবির মেজাজের সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়ে গেছে। আনাম সিদ্দিকা অভিনেত্রীর সঙ্গে গায়িকাও বটে, কয়েকটি গানে তাঁর ব্যাক ভোকাল ভালো লাগে শুনতে।

‘বাড়ির নাম শাহানা’ সিনেমার দৃশ্য। প্রযোজনা সংস্থার সৌজন্যে

নব্বইয়ের গল্প তাই ‘লাল দোপাট্টা’, মিমি চকলেটসহ সেই সময়ের পপ কালচারের অনেক কিছুই ছবিতে উপস্থিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আলোচনা, দেয়ালে ‘রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়’ স্লোগানও নব্বইয়ের দশকের শুরুর সময়টা মনে করায়।
দীপা চরিত্রে প্রথম সিনেমাতেই চমকে দিয়েছেন আনান সিদ্দিকা। অসহায়ত্বের দৃশ্যগুলোতে তিনি দারুণ। তবে কখনো কখনো সংলাপ বলার ভঙ্গিতে অতি নাটকীয়তা প্রকাশ পেয়েছে। দীপা ডাকাবুকো ধরনের মেয়ে, কিন্তু কিছু সংলাপ তার মতো মফস্‌সলের মেয়ের সঙ্গে গেল কি? দীপার স্বামী চরিত্রে ভালো করেছেন আরিফুল ইসলাম। সুখময় চরিত্রে ইরেশ যাকের, মা ও বাবার চরিত্রে কাজী রুমা ও লুৎফর রহমান জর্জও যথাযথ। পার্শ্বচরিত্র হলেও নজর কেড়েছেন জুলেখা চরিত্রে কামরুন্নাহার মুন্নী ও পরীর চরিত্রে শিশুশিল্পী মুগ্ধতা মোর্শেদ।

‘বাড়ির নাম শাহানা’ যেহেতু দীপার সংগ্রাম আর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প, সিনেমার প্রায় প্রতিটি ফ্রেমেই রয়েছেন আনান সিদ্দিকা। যা কখনো কখনো একটু একরৈখিক হয়ে পড়ে। সুখময় চরিত্রের সঙ্গে তার সখ্যও যেন অনুমিত; লড়াই সংগ্রাম থেকে একটু স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা। চরিত্রটির সঙ্গে দীপার লড়াইয়ের যোগ ঠিক স্পষ্ট নয়। সিনেমাটোগ্রাফি গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছে; কিন্তু দেখার সময় বেশ কয়েকটি দৃশ্যে লাইট অসংগত মনে হয়েছে। এটা কি কারিগরি ত্রুটি নাকি প্রেক্ষাগৃহের ঝামেলার কারণে বোঝা গেল না।

‘বাড়ির নাম শাহানা’র পোস্টার। ছবি :প্রযোজনা সংস্থার সৌজন্যে

ছোটখাটো দু–একটা অসংগতি থাকলেও ‘বাড়ির নাম শাহানা’ দেশের সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। একান্তই এক নারীর দৃষ্টিতে তার চরিত্র, সংগ্রাম, মানসিকতার এমন রূপায়ণ খুব কম সিনেমাতেই দেখা যায়। বড় পর্দায় লীসা গাজী আর আনান সিদ্দিকা দুজনের অভিষেকই তাই হয়ে রইল স্মরণীয়।