
বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র উৎসব ঘুরে আগামীকাল দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে লীসা গাজীর চলচ্চিত্র ‘বাড়ির নাম শাহানা’।
কৈশোর পেরোনোর আগেই শাহানাবাড়ির মেয়ে দীপার বিয়ে হয়ে যায়। স্বামীর নির্যাতনের জাল ছিঁড়ে নিজের মতো করে বাঁচতে চেয়েছেন তিনি। নব্বইয়ের দশকের পটভূমিতে দীপার বেঁচে থাকার লড়াইয়ের গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে বাড়ির নাম শাহানা।
সত্য কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত বাড়ির নাম শাহানায় দীপা চরিত্রে অভিনয় করেছেন আনান সিদ্দিকা। ছবিটি যৌথভাবে প্রযোজনা করেছে কমলা কালেক্টিভ ও গুপী বাঘা প্রোডাকশন্স লিমিটেড।
আগে তথ্যচিত্র নির্মাণ করলেও লীসার এটিই প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। নিজের গল্প থেকে আনান সিদ্দিকার সঙ্গে যৌথভাবে চিত্রনাট্য লিখেছেন লীসা গাজী।
তিনি বলেন, ‘নব্বইয়ের দশকের বাংলাদেশে তালাকপ্রাপ্ত নারী হিসেবে আমি নিজেও প্রচুর সামাজিক কুসংস্কার ও অন্যায়ের শিকার হয়েছি। ফলে আমি বেশ ভালোভাবেই জানি, তালাকপ্রাপ্ত নারীরা কীভাবে নিজের ঘরে এবং পরিবারে নৈমিত্তিক নিষ্ঠুরতার শিকার হন, প্রতিনিয়ত উপেক্ষিত হন, যা প্রায় সমাজচ্যুত হবারই নামান্তর। এত সব প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েও যেসব নারী নিজেদের চলার পথ নিজেরা তৈরি করেন, তাদের সাহস এবং আবেগমথিত জটিল গল্পগুলো সব সময়ই আমাকে উদ্বুদ্ধ করে, সেই সব গল্পই আমি বলতে চেয়েছি। দীপা তেমনি একজন নারী। তার জীবন নিয়ে অন্যদের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত যে গ্রহণ করে না, বরং নিজের মতো করে বাঁচার জন্য লড়াই চালিয়ে যায়।’
নির্মাণের বাইরে লীসা গাজী লেখক, নাট্যকর্মী হিসেবে পরিচিত। লন্ডনভিত্তিক শিল্পসংগঠন ‘কমলা কালেক্টিভ’-এর তিনি অন্যতম সহপ্রতিষ্ঠাতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে যৌন সহিংসতার শিকার নারীদের জীবন নিয়ে নির্মিত তাঁর তথ্যচিত্র রাইজিং সাইলেন্স বিশ্বব্যাপী ১৫টি পুরস্কার অর্জন করেছে।
বাড়ির নাম শাহানা নিয়ে লীসা গাজী বলেন, ‘ছবিতে আমি ভালো ও মন্দের সরল সংজ্ঞার বাইরে গিয়ে একজন সাধারণ নারীর প্রতিনিধিত্ব সৃষ্টি করেছি, যার সঙ্গে দর্শক সংযোগ স্থাপন করতে পারবেন এবং ছবির চরিত্রগুলোর মধ্যে নিজেদের ছায়া দেখতে পাবেন। একজন নারীর সর্বত্যাগী মা বা বাধ্য স্ত্রী হওয়ার দরকার নেই। তিনি জটিল হতে পারেন, তাঁর জীবন কণ্টকিত হতে পারে এবং তাঁর অভ্যন্তরীণ মনোজগৎ বিপর্যস্ত হতে পারে, ঠিক আর দশজন মানুষের মতো এবং তারপরও যাঁর গল্প উদ্যাপনযোগ্য। বাড়ির নাম শাহানা বিষণ্ণ ছবি নয়, বরং ছবিটি জীবনের জয়গানে মুখর।’
২০১৭ সালে তরুণ নির্মাতা আবরার আতাহারের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র লাইফ ইন আদার ওয়ার্ডস-এ আনানকে দেখা গেছে। বাড়ির নাম শাহানা দিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে নাম লেখালেন।
আনান সিদ্দিকা বলেন, ‘নারীর জীবন ক্রমপরিবর্তনশীল এক দায়িত্বের উপাখ্যান। প্রথমে সে কারও মেয়ে। কখনো সে কারও স্ত্রী, কখনোবা কারও মা, শেষে সে–ই আবার কারও নানি বা দাদি। এ এক শেষ না হওয়া চক্র, যার কোনো স্থিরতা নেই। যেখানে শেষ ভাবা হয়, সেখান থেকেই নতুন আরেক গন্তব্যের দিকে তার যাত্রা শুরু হতে দেখা যায়। চলচ্চিত্রটিতে দীপার যাত্রাও ঠিক এমন করেই সামনে এগিয়ে গেছে।’
সংগীতশিল্পী হিসেবেও আনানের পরিচিতি রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘সমাজনির্ধারিত “ভাল মেয়ে”র ছাঁচে নিজেকে সে (দীপা) কোনোভাবেই খাপ খাওয়াতে পারে না। বরং জটিল ও বহুমাত্রিক এক ব্যক্তিসত্তা হিসেবে দীপার জীবন পরিচালিত হয়। তাই দীপার গল্প বলার সময় আমার দেখা বহু নারীর জীবন ও অভিজ্ঞতাকে গল্পের সঙ্গে জুড়ে দিতে চেষ্টা করেছি, বিশেষ করে যাঁরা এক দিনের জন্যও জীবন নিয়ে আশাহত হননি, বরং দাঁতে দাঁত কামড়ে টিকে থাকার সংগ্রাম করে গেছেন।’
সিনেমার অন্যতম প্রযোজক আরিফুর রহমান বলেন, ‘আমার যাপিত জীবনে দেখা মানুষগুলোর ছায়া আমি দীপা চরিত্রটির মধ্যে দেখতে পাই। গৎবাঁধা বীরত্বগাথাকে পাশ কাটিয়ে চলচ্চিত্রটি আমাদের চরম এক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, যা ব্যক্তির আবেগ ও ব্যক্তিগত সংগ্রামকে প্রবলভাবে অনুরণিত করতে পারে।’
বাংলাদেশের একটি মফস্সল শহরে ছবির বেশির ভাগ চিত্র গ্রহণ করা হয়েছে। কিছু অংশের শুটিং হয়েছে যুক্তরাজ্যের একটি ছোট শহরে। গল্পের সময় ও প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অন-লোকেশন সাউন্ড ধারণ করা হয়েছে।
সিনেমাটিতে আরও আছেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, লুৎফর রহমান জর্জ, ইরেশ যাকের, কাজী রুমা, কামরুন্নাহার মুন্নী প্রমুখ। চিত্র গ্রহণ করেছেন যোহায়ের মুসাভভির। সংগীত পরিচালনায় রয়েছেন সোহিনী আলম।
২০২৩ সালে জিও মামি মুম্বাই চলচ্চিত্র উৎসবে ‘জেন্ডার সেনসিটিভিটি অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছে বাড়ির নাম শাহানা। লন্ডন, শিকাগো, মেলবোর্ন, রোমের চলচ্চিত্র উৎসবেও সিনেমাটি পুরস্কার জিতেছে। বাংলাদেশে ছবিটি পরিবেশন করছে গুপী বাঘা প্রোডাকশন্স লিমিটেড।
সিনেমাটি ঢাকার স্টার সিনেপ্লেক্সসহ বেশ কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির কথা রয়েছে। বাংলাদেশের পাশাপাশি আগামী অক্টোবরে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি, মেলবোর্ন ও অ্যাডিলেডেও সিনেমাটি মুক্তি পাবে।