
‘উৎসব’ দেখে মন ভরে গেছে। বাংলাদেশের সিনেমা দেখতে যাওয়া, বয়স হওয়ার পর, একটা বিড়ম্বনা। একটা কারণ, সিনেমা হলের বের হওয়ার দরজার মুখে ক্যামেরা দাঁড়িয়ে থাকে। বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে, ‘কেমন দেখলেন।’ কী বলবেন? সিনেমা যাঁরা বানান, তাঁরা আমাদের ভাইবেরাদার, বোন-দুলাভাই, মামা-চাচা, ভাইপো-ভাইঝি, না হলে আমার আরেকটা নাটকের প্রডুসার, একটা চ্যানেলের মালিক, সত্য কথা বলে এই বয়সে বন্ধুহারা, ভাইহারা হতে কে চায়।
বেশির ভাগ সিনেমা শেষ পর্যন্ত দেখলে একটা উপকার হয়, নিজের ধৈর্যশক্তি বাড়ে, সহ্যক্ষমতা পোক্ত হয়! সম্পূর্ণ ভালো লেগেছে, এমন ছবি আমার তালিকায় খুব কম। একটা দুটোর নাম করি, ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’, ‘মুক্তির গান’। ‘নিরন্তর’ ভালো লেগেছিল, ‘শঙ্খনাদ’ পছন্দ করেছিলাম, ‘টেলিভিশন’ কিংবা ‘স্বপ্নজাল’ দেখেও প্রশংসা করেছিলাম...এই রকম হাতে গোনা কয়েকটা ছবি। হাতে গোনা ব্যাপারটা হলো, আপনি হাতের আঙুল দিয়ে গুনতে পারবেন, অঙ্গুলিমেয়, আঙুলের দাগ ধরে ধরে গুনবেন, বিশটার বেশি হবে না। আমার মনে হয়, দুই হাতের দশটা আঙুলের চেয়ে বেশি বাংলাদেশি সিনেমার নাম আমি বলতে পারব না, যা আমার বেশ ভালো লেগেছে।
তানিম নূর পরিচালিত এবারের ঈদের ছবি ‘উৎসব’ দেখলাম ১৩ জুন ২০২৫। অপরাহ্ণ শো। দুদিন আগেই টিকিট কাটা ছিল। আমরা আটজনের একটা দল, বন্ধুবান্ধব, ছেলেমেয়েসমেত স্টার সিনেপ্লেক্সে গিয়ে হাজির। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। এত বড় লাইন, সবার হাতে টিকিট, সবাই একটা সিনেমা দেখতে দাঁড়িয়ে আছেন হাসিমুখে, কী সুন্দর একটা দৃশ্য।
সিনেমা শুরু হলো। প্রথম দিকে একটা শিশুর মুখে সংলাপ, ‘ও! খাইষ্টা আঙ্কেল’ শুনে হেসে ফেললাম। তবে এই ধরনের ডায়ালগ হুমায়ূন আহমেদে অনেক শুনেছি। প্রথম তিন-চার মিনিট নিজের কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে করা বউয়ের চিরকালীন সন্দেহে আস্থা রাখতে শুরু করলাম, কোন ভূতে কিলাইছিল যে ঠিক দুপুরবেলা যখন ভূতে মারে ঠেলা, তখন আরামের ঘুমটা বিসর্জন দিয়ে সিনেমা হলে একটা ‘জোর করে হাসানোর চেষ্টা করবে নিশ্চয়ই’ ধরনের ঈদের নাটক দেখতে এসেছি। কিপ্টেমি নিয়ে ঈদের নাটক তো আমিও করেছিলাম, ‘প্রলয়-আলয়’, কিপ্টের চরিত্র করেছিলেন গোলাম মুস্তাফা! এ আর নতুন কী!
ছবি চলছে। চঞ্চল চৌধুরী ভূত হয়ে এলেন। মজার মজার সংলাপ দিতে লাগলেন। তখনো আমার ভেতরের অহমিকা যাচ্ছে না। ভূত বলছে, কী সমস্যা, আমি ভূত, আপনারা ভয় পাচ্ছেন না কেন? ফানি ডায়ালগ। এই পর্যন্তই।
ছবি এগোতে লাগল। কখন যে ছবির গল্পে বুঁদ হয়ে গেলাম, টের পাইনি। জাহিদ হাসান যে দুর্দান্ত অভিনেতা, এটা আমাকে বলে দেবার দরকার নেই, আমি জানি। ‘বিচ্ছু’ নাটক মঞ্চে অন্তত সাতবার দেখেছি। কিন্তু গল্প গেল মফস্সল শহরে। সেইখানে কিশোর জাহিদ হিসেবে এলেন সৌম্য জ্যোতি আর তাঁর কিশোরী প্রেমিকা সাদিয়া আয়মান। তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক হোক, এটা তো সবাই চাইবে। এভরিবডি লাভস লাভ। লাইলি-মজনু মার্কা প্রেম নয়, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা মার্কা ইটস আ হানড্রেড পারসেন্ট লাভ নয়, একেবারেই...নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা, নাহি তথ্য নাহি উপদেশ। কী আছে?
ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা
নিতান্ত সহজ সরল, সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু-চারটি অশ্রুজল। সেই অশ্রুজল যখন অনবদ্য সাদিয়া আয়মান কিংবা অপাপবিদ্ধ সৌম্য জ্যোতির গণ্ডদেশে ঝলমল করে ওঠে তখন এক পশলা সজীব হাওয়া দর্শক হৃদয়ে বয়ে যায়।
জাহাঙ্গীরের (জাহিদ–সৌম্য) ভাগনের জন্য স্নেহ, জেসমিন (সাদিয়া) আর ছোট জাহাঙ্গীরের প্রেম, বিয়ে, তারপর একটা সময়? বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলিয়া দেয়।
আপনারা এরই মধ্যে জেনে গেছেন যে ভূত হিসেবে হাজির হন চঞ্চল চৌধুরী, জয়া আহসান আর অপি করিম। তাঁরাই কিপ্টে খাইষ্টা জাহাঙ্গীরকে দেখায় ভূত আর ভবিষ্যৎ। মনে হতে পারে, এই সব চমকের কারণে লোকে ছবিটা আঠার মতো লেগে থেকে দেখে। আমার ধারণা, তা নয়। জয়া আহসানের ভূতের চরিত্রে জয়া আহসানকে দেখানো হয়েছে লাস্যময়ী, আমার জানা জয়া আহসান বুদ্ধদীপ্ত, শীলিত, মৃদুভাষী—সে তুলনায় ভূত জয়া বড় বেশি প্রগলভ। অপি করিম বরং খানিকটা অপি করিমের মতোনই ছিলেন। তাহলে কোন রসায়নে এই ছবি দেখতে দেখতে ভুলে গেলাম যে একসময় আমিও ঢের ছবির স্ক্রিপ্ট লিখেছি, ভুলে গেলাম যে এখনো আমার একটা উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি আমার টেবিলে আধেক লেখা পড়ে আছে, আমি অন্তত ২৭ বার খিলখিল করে হেসে উঠলাম। এবং তিনবার চোখ ছলছল করে উঠল। এবং একসময় চশমা খুলে চোখ মুছতে হলো!
এই ছবি আরও বাঙ্ময় হয়ে উঠল সুনেরাহ্র আগমনে। সুনেরাহ্ ‘দাগি’তেও মিষ্টি চরিত্র পেয়েছেন, ‘উৎসবে’ও। আর তিনি যখন বললেন, ‘এক কাপ কফির দাম তিন শ টাকা, আপনারা পাইছেনটা কী’ তখন কিপ্টা জাহিদের মুখে যে হাসি ফুটে উঠল, তা আমার নিজের অশান্ত হৃদয়কে প্রশমিত করে ফেলল। এই হাসি আমি দেখেছি ‘অপু ট্রিলজি’তে, সম্ভবত ‘অপুর সংসার’–এ, অপু ট্রেন ফেইল করে ফিরে আসছে। তার মা ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমরা তাঁর মুখ দেখি, আস্তে আস্তে প্রসন্ন হাসিতে তাঁর মুখমণ্ডল ভরে ওঠে, তেমনি একটা হাসি ফুটে উঠল জাহিদ হাসানের মুখে, যেন মেঘ সরে যাচ্ছে চাঁদ থেকে, যেন সুবহে সাদিকে মাতৃদুগ্ধের মতো ভোরের আলো ফুটছে। আহ!
আমিও যে একজন বাবা। সন্তান যদি বাবার মতো হয়, বাবা যদি সেটা টের পান, সে যে কী একটা গৌরবের মুহূর্ত বাবার জন্য!
আমার মেয়েকে বলেছিলাম, মা, তুমি লেখক হতে চাও, কিন্তু তা ক্রিয়েটিভ রাইটিং না পড়েও হওয়া যায়, তুমি বিজনেস পড়ো, কম্পিউটার পড়ো, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ো। মেয়ে জবাব দিয়েছিল, তুমিও তেমার বাবা-মার কথা শোনোনি, আমিও আমার বাবা-মার কথা শুনব না। আমি ক্রিয়েটিভ রাইটিংই পড়ব। আমার একেবারে নিজের অনিশ্চিত তরুণবেলার কথা মনে পড়ল, যেদিন আমি লেখক হব বলে ইঞ্জিনিয়ারিং চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছিলাম। আমার ভীষণ গৌরববোধ হলো।
আমি জাহিদ হাসানের মুখশ্রীতে সেই গৌরবচ্ছটা দেখতে পেয়ে কলজে ঠান্ডা হওয়ার অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। আর! আমাদের মধুরতম সংগীত তো তা-ই, যা বিষণ্নতম। যাকে আমরা হারিয়েছি আমাদের প্রথম যৌবনে, যাকে আমরা আর কোনো দিন পাব না, যার স্মৃতি আমাদের মধুরতম বেদনার নাম, তাকেই কি আমরা দেখি না আফসানা মিমির মুখে!
সবশেষে রমজানের ঐ রোজার শেষে গাইবে আমাদের পাড়ার ব্যান্ড। মা, তোমাদের ব্যান্ডের নাম কী! আরও একটা বাংলা ব্যান্ড। এটা কী ধরনের নাম? এই ধরনের নামই তো এখন চলছে! এই একটা সংলাপ কি আমি লিখতে পারতাম? পারতাম না। সেইখানে আমাদের মতো পুরোনো লেখকদের মধুর পরাজয়, নতুনেরা এসে গেছে, ছেড়ে দিতে হবে স্থান!
বাইরে গাড়ি এসেছে। গাড়ি থেকে নামছে আমাদের সন্তান। মধু! মধু। গাড়ির জানালায় প্রাক্তন প্রেমিকার মুখ। যাকে আর কোনো দিনও পাব না, কারণ, সে স্বামী–সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করছে! প্রৌঢ়ত্ব পেরিয়ে একাকী নিঃসঙ্গ জীবনে জাহিদ হাসান তবু নিঃসঙ্গতা থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা পেলেন, পেলেন সন্তানকে আর পেলেন মহল্লার শিশু-তরুণ-বৃদ্ধদের ভালোবাসা।
ছবি শেষ। কেউ উঠছে না। সবাই হাততালি দিচ্ছে।
এগেইন, এই ‘ছবি সূর্য দীঘল বাড়ি’ নয়, ‘জীবন থেকে নেয়া’ নয়, ‘ডুব’ বা ‘ব্যাচেলর’ও নয়। এই ছবি অস্কারে যাবে না, কানেও সম্ভবত না, কিন্তু মানুষের অন্তরে রয়ে যাবে। সে সম্ভাবনা প্রচুর। যতই দিন যাবে, লোকের মুখে মুখে এর সুনাম ছড়িয়ে পড়বে, এই ছবিতে আরও দর্শক আসবে, এই ছবি আরও বেশি বেশি হল পাবে।
আইটেম সং নেই, নাচ নেই, অ্যাকশন দৃশ্য নেই। শুধু ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা দিয়ে ভরা এই ছবি সাঙ্গ করি মনে হবে, শেষ হয়ে হইল না শেষ।
আশ্চর্য, ছবিটার কথা আমি ভুলতে পারছি না কেন?
এই ছবির নায়ক কে? জাহিদ হাসান, সৌম্য, সাদিয়া, সুনেরাহ্? মূল আকর্ষণ কে? চঞ্চল, অপি, জয়া? মিমি, পাভেল? দিনার? তারিক আনাম?
আমার ধারণা, এই ছবির সাফল্য এর অসাধারণ স্ক্রিপ্ট আর ভীষণ পরিমিতিবোধের পরিচয় দেওয়া পরিচালক!
অভিনন্দন, তানিম নূর।