‘থিয়েটারের ভবিষ্যৎ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ শীর্ষক অধিবেশনে মূল বক্তা হিসেবে বক্তব্য দেন অধ্যাপক ইসরাফিল শাহীন। ছবি: সৌজন্যে
‘থিয়েটারের ভবিষ্যৎ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ শীর্ষক অধিবেশনে মূল বক্তা হিসেবে বক্তব্য দেন অধ্যাপক ইসরাফিল শাহীন। ছবি: সৌজন্যে

সাংহাই থিয়েটার উৎসবে মূল বক্তা ইসরাফিল শাহীন

এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নাট্যশিক্ষা ও সমকালীন থিয়েটার চর্চার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক আয়োজন এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় থিয়েটার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উৎসব ও পরিচালকদের সম্মেলন ২০২৫-এ মূল বক্তা হিসেবে অংশ নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার ও পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ইসরাফিল শাহীন। চীনের সাংহাই থিয়েটার একাডেমিতে অনুষ্ঠিত এই উৎসব ও সম্মেলন শুরু হয় ২৮ নভেম্বর এবং শেষ হয় ৪ ডিসেম্বর।
অধ্যাপক শাহীন জানান, ২৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ফোরাম ‘থিয়েটারের ভবিষ্যৎ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ শীর্ষক অধিবেশনে তিনি মূল বক্তা হিসেবে বক্তব্য দেন। তাঁর বক্তৃতার বিষয় ছিল সরাসরি ও ডিজিটাল থিয়েটারের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা।

বক্তৃতায় তিনি তুলে ধরেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে কীভাবে সরাসরি থিয়েটারের ক্ষণস্থায়ী অভিজ্ঞতাকে নথিভুক্তকরণ, সংরক্ষণ, তাৎক্ষণিক অভিনয় ও অংশগ্রহণমূলক গল্প বলার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটি দীর্ঘস্থায়ী ও পারস্পরিক শিল্প-অভিজ্ঞতায় রূপ দেওয়া যায়।

কর্মশালায় ইস্রাফিল শাহীন। ছবি: সৌজন্যে

উৎসব চলাকালে অধ্যাপক ইসরাফিল শাহীন নাটক ও থিয়েটারবিষয়ক একাধিক মাস্টারক্লাস, কর্মশালা, সেমিনার ও আলোচনা সভা পরিচালনা করেন। তাঁর পরিচালিত বিশেষ মাল্টিমিডিয়া কর্মশালা ‘পরিবেশনার মাধ্যমে আরোগ্য’-এ বাংলাদেশের কিশোর সংশোধনাগার ও মানসিক স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত নাট্যভিত্তিক পুনর্বাসন কার্যক্রমের বিভিন্ন উদাহরণমূলক অভিজ্ঞতা আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণকারীদের সামনে উপস্থাপন করা হয়।
এ বছরের আয়োজনে চীন, ভারত, জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিলিপাইনসহ ২৫টির বেশি দেশ থেকে শিক্ষক, গবেষক, নাট্যপরিচালক ও শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।

উৎসবের পরবর্তী পর্বে অধ্যাপক ইসরাফিল শাহীন ৪, ৫ ও ৬ ডিসেম্বর সাংহাই থিয়েটার একাডেমির নাট্যসাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নরওয়ের সমকালীন বিশ্বনন্দিত নাট্যকার জন ফসে-এর নাটক ‘শরতের স্বপ্ন’ নিয়ে একটি নিবিড় কর্মশালা পরিচালনা করছেন।

সমকালীন ইউরোপীয় নাট্যজগতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব জন ফসে ২০২৩ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন। তাঁর নাট্যচর্চার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সংযত নির্মাণভঙ্গি, নীরবতার ভাষা এবং মানবসম্পর্কের সূক্ষ্ম টানাপোড়েনের গভীর অনুসন্ধান। শরতের স্বপ্ন নাটকে সময়, স্মৃতি, পুনর্মিলন, বিচ্ছেদ ও সম্পর্কের অন্তর্লৌকিক যন্ত্রণা একধরনের কাব্যিক নীরবতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়, যেখানে অপ্রকাশিত অনুভূতিই হয়ে ওঠে নাটকের প্রধান শক্তি।
এই কর্মশালায় অধ্যাপক শাহীন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নাট্যগঠনের কাঠামো, অন্তর্নিহিত ভাব, গতি ও ছন্দ, চরিত্রের অস্তিত্বগত সংকট এবং সংযত দৃশ্য-নির্মাণ নিয়ে কাজ করছেন। একই সঙ্গে পাঠনাট্য, পরিবেশনাভিত্তিক বিশ্লেষণ, নীরবতার নাট্যতত্ত্ব এবং কবিতামূলক অভিনয়ের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গভীর আলোচনায় যুক্ত হচ্ছেন তিনি।

অধ্যাপক ইসরাফিল শাহীন (মোহাম্মদ ইসরাফিল) বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান থিয়েটার নির্দেশক, গবেষক ও শিক্ষক। ১৯৬৪ সালে জন্মগ্রহণকারী এই নাট্যব্যক্তিত্ব ভারতের জাতীয় নাট্যবিদ্যালয় থেকে ১৯৯১ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরে ১৯৯৯ সালে কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাদেশের পথনাট্য বিষয়ে গবেষণার জন্য পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার ও পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগে তিনি দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করছেন এবং ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিভাগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

ইসরাফিল শাহীন। ছবি : সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ইসরাফিল শাহীনের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, ভুটান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, রাশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মিসর, ফিলিপাইন, ইতালি, স্পেন, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, চেক প্রজাতন্ত্রসহ বহু দেশে তিনি নাট্য কর্মশালা, গবেষণা কার্যক্রম ও একাডেমিক পরামর্শ প্রদান করেছেন। তাঁর নির্দেশনার প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে পদ্ধতিগত অভিনয়, স্থানীয় নাট্যরীতি, নৃবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এবং সংযত দৃশ্যরূপ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব উপাদান মিলিয়ে তাঁর কাজ সমকালীন থিয়েটারে একটি স্বতন্ত্র ভাষা ও দর্শন নির্মাণ করেছে। সামাজিক দায়বদ্ধতা, অংশগ্রহণমূলক অভিনয় এবং থিয়েটারকে একটি চলমান সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা বাংলাদেশের থিয়েটারচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী বলে বিবেচিত হয়।