
২০ বছরের সংগীতজীবন আরফিন রুমীর। শুরুর দিকে টানা কয়েক বছর ব্যস্ত থাকলেও পরে হঠাৎ ছন্দপতন ঘটে। এখন আবার ব্যস্ত হচ্ছেন জনপ্রিয় এই গায়ক ও সংগীত পরিচালক। নতুন ৩০ গানের প্রকল্প নিয়ে আসছেন আরফিন রুমী। এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে ‘প্রেমের রেডিও’ গানটি। এ সপ্তাহে নতুন আরও দুটি গানের ভিডিওর শুটিং হবে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুর কাদের
অনেকেই বলছেন, ‘প্রেমের রেডিও’ শুনে পুরোনো রুমীকে আবার খুঁজে পাওয়া গেছে—আপনার নিজের মনে হয়, কী বদল ঘটেছে এই ফেরার ভেতর?
আরফিন রুমী : নাচটা আমি নিয়মিতই চেষ্টা করছি। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের চাওয়া ছিল, তাই আমাকে নাচ নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। গানের রোমান্টিক অংশকে সিনেমাটিক উপায়ে দেখতে চান। এতে আমার উপস্থাপনও একটু ভিন্নভাবে হয়েছে। আমার আগের সব গানে এভাবে থাকতাম না। এখন মনে হয়, নতুনভাবে যেহেতু আসছি, নাচটা নিয়ে অন্যভাবে কাজ করতে চেষ্টা করি।
৩০ গানের এই বড় প্রকল্পটা শুনে মনে হয়, এটা শুধু গান নয়—একটা যাত্রা বা গল্পের মতো। এর পেছনে কী ভাবনা বা দর্শন কাজ করেছে? গানগুলো সম্পর্কে যদি কিছুটা ধারণা দিতেন, কোন ধরনের গান, নতুনত্ব কী কী থাকছে?
আরফিন রুমী : ৩০ গানের প্রকল্পটা মূলত সিডি চয়েজের সোহেল ভাইয়ের পরিকল্পনা। তিনি আমার কাছে জানতে চাইছিলেন, কী করা যায়? কীভাবে এগোনো যায় গান নিয়ে। খুব দ্রুত গানগুলো বানানো ঠিক নয়, আবার অনেক সময় নেওয়াটা ঠিক নয়। আমরা চেষ্টা করছি ভিন্নভাবে, মাঝখানে যেহেতু একটা বিরতি ছিল। সার্বিক পরিস্থিতি মিলে কদিন আগে আমরা গান প্রকাশও কম করেছি। এখন আমি যেহেতু ফেসবুকে সরব আছি, অনেকে আমাকে নতুন গানের কথা বলেন। তাই ভিন্ন রকমভাবে আসছি। নতুন গানের মধ্যে কিছু গান একদম নতুন স্টাইলের, যা সচরাচর মঞ্চে গাই না। কিছু থাকবে পুরোনো স্টাইলকে টার্গেট করে, যা আমার সিগনেচার। আর কিছু ফিউশন, থাকবে নাচের গানও।
প্রশ্ন: এখনকার রুমী কি শুরুর দিকের রুমীর চেয়ে বেশি পরীক্ষামূলক না বেশি আত্মবিশ্বাসী শিল্পী?
আরফিন রুমী : এখনকার রুমী আগের রুমীর চেয়ে ভালো। আগের রুমী যা জানত, এই রুমী কিছুটা হলেও তার চেয়ে বেশি জানে। শিল্পীদের চিন্তা করা উচিত নয়, এই সময়টা কেমন যাচ্ছে। শিল্পীদের সৃষ্টি কিন্তু মরার পরও বেঁচে থাকে। ভক্তরা সব সময় লালন করে থাকেন অন্তরে। তাই এই ব্যাপারটা পরীক্ষামূলক নয়, ভালোবাসা মনে করি। ভালো কাজের কারণে ভালোবাসা পাচ্ছি। আত্মবিশ্বাস তো আসলে থাকবে। মূল কথা হচ্ছে, আল্লাহর রহমত এবং আমার চেষ্টা।
অনেক দিন পর প্রচারে এত সক্রিয় দেখা যাচ্ছে আপনাকে, পর্দায় নাচছেনও আপনি—এই নতুন যোগাযোগ ভাবনা কি গানকে শ্রোতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার নতুন কৌশল?
আরফিন রুমী : ২০১০ সালের দিকে আমি ও পড়শী যখন ‘তোমারই পরশে’ গান বের করলাম, তখনই বিভিন্ন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে নাচের পারফর্ম করতাম। এবার নতুন করে যখন আবার ফিরছি, সিডি চয়েজের এমদাদ ভাই-সোহেল ভাই ভাবলেন, রুমী ভাইকে দিয়ে রিদমিক গানে পারফর্ম করালে ভালো হয়। আমিও প্রয়োগ করার চেষ্টা করছি।
আপনি নাটকের গান করছেন, অডিওর গান নিয়েও ব্যস্ত। কিন্তু সিনেমার গানে বলা চলে অনুপস্থিত—এটা কি ইচ্ছাকৃত দূরত্ব, নাকি...?
আরফিন রুমী : নাটকের গান হচ্ছে। কদিন আগেও ‘আমাদের গল্প’ নামের একটি নাটকেও গান করেছি। কয়েক দিন ধরেও নতুন আরেকটা নাটকের কাজ করছি, মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজের। তবে সিনেমার গান নিয়ে আমার কাছে ওরকম ডাক আসেনি। মোস্তফা কামাল রাজ কোনো সিনেমা বানালেও আমাকে মনে করেন। আমিও মন দিয়ে করি। এর বাইরে অন্য পরিচালক যাঁরা আছেন, তাঁদের সঙ্গে কোনো গানের কাজ নিয়ে সেভাবে আমার কথা হয়নি। বিষয়টা মোটেও ইচ্ছাকৃত নয়। আমি শিল্পী, আমার মতো কাজ করি, আমাকে কেউ মনে করতে হবে। আমাকে মনে না করলে আমি তো যেচে যেতে পারি না। সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে আমি যেমন একজন শিল্পীকে ডাকি, বলি—চলো একটা গান করি, বিষয়টাও এ রকম আরকি।
আপনার পরে ইমরান, প্রীতম হাসানরা এসেছেন। এঁদের মধ্যে কাদের কাজ আপনাকে ভাবায়?
আরফিন রুমী : দুজনের স্টাইল দিয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। এটা ভালো একটা দিক। এটাই হওয়া উচিত—ধীরে ধীরে নিজেদের জুনিয়র যারা আছে, তাদের মাধ্যমে নতুন কিছু ছড়িয়ে যায়। এটাই নিয়ম। যেমন আমি মিউজিক শিখেছি হাবিব ভাই ও ফুয়াদ ভাইয়ের কাছ থেকে—শিখে নিজেকে এগিয়ে নিয়েছি। আবার আমার থেকে কেউ শিখে, তারাও আগে বাড়বে—এটাই নিয়ম। এটা খুবই পজিটিভ। ক্রিকেটে যেমন ১১ জন দিয়ে টিম হয়, গানেও তেমন ১০-১৫-২০-৩০ জন দিয়ে মেইন স্ট্রিম দল হয়। এই টিম যত বড় হবে, তত ভালো।
আপনার সময়ের ‘মেলোডি’ ও আজকের ‘সাউন্ড ডিজাইন’-নির্ভর সংগীতের মধ্যে ফারাকটা আপনি কীভাবে দেখেন?
আরফিন রুমী : আমার সময়ে মেলোডি বেশি প্রাধান্য ছিল। এখনো তাই। নতুনদের সাউন্ড ডিজাইন ভিন্ন রকম হয়, কারণ ওরা নতুন জনরার গান শোনে বেশি, শ্রোতারাও তেমনটাই পছন্দ করেন। আমার ২০ বছরের ক্যারিয়ার। শুরুটাই হয়েছে মেলোডি দিয়ে, বেশির ভাগ গান হিট হয়েছে। মেলোডি আমার সঙ্গে মানিয়েও যায়। মানুষও মন্তব্যের ঘরে লিখতে থাকে, এ ধরনের গানই বেশি করবেন। তবে মেলোডি ও সাউন্ড ডিজাইন–নির্ভর সংগীতে পার্থক্য অনেক বড়। এটাও ঠিক, জাতি হিসেবে আমরা মেলোডিয়াস গানই বেশি শুনি।
আপনি যদি এখন নতুন করে ক্যারিয়ার শুরু করতেন—এই সময়ের রুমী কেমন গান করতেন বলে মনে হয়?
আরফিন রুমী : আমি বিদেশি স্টাইলে গান বানাতাম। এটাই স্বাভাবিক। এখনকার ছেলেমেয়েরা সারা পৃথিবীর সবকিছুর খোঁজখবর রাখেন। পুরোনো দিনের যা কিছু, তা–ও খুব সহজেই জানা যায়। তাই আমারও নতুন কিছু করা হতো।
জনপ্রিয়তার শীর্ষ থেকে একদম নীরব হয়ে যান, এরপর আবার ফেরা—এই যাত্রা আপনাকে শিল্পী হিসেবে কী শিখিয়েছে?
আরফিন রুমী : একটু শান্ত হতে শিখিয়েছে। আগে মনে হতো যে নিজের মতো কেন হবে না। না হলে খারাপ লাগত। এখন সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ম্যাচিউরিটির কারণে আল্লাহর ওপর ভরসা বেড়েছে। অনেকে কিছু সহজে মেনে নিতে পারি। এটাই সবচেয়ে বড় বদল।
গুরু হাবিবের যে শিক্ষাটা আপনার জীবন বদলে দিয়েছে। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে যাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে চান?
আরফিন রুমী : গুরু হাবিব (ওয়াহিদ) ভাইয়ের শিক্ষাটা আমার সংগীতজীবন বদলে দিয়েছে। তিনিই আমাকে ফুয়াদ (আল মুক্তাদির) ভাইয়ের কাছে পাঠিয়েছিলেন। এই দুজন মানুষের সান্নিধ্যের কারণে ওই সময় আমার সংগীতের অনেক কিছুর উন্নয়ন ঘটে। আর এখন তো আমার মতো যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই বলবে, এ আর রাহমানের কাছে ছুটতে চান, আমিও তার ব্যতিক্রম নই। আমার এই ইচ্ছা তো আছেই, তবে বেশি পছন্দ ইয়ানি। খুব ইচ্ছা, ইয়ানির সঙ্গে দেখা করার। তাঁকে না দেখেই, শুধু তাঁর মিউজিক শুনে যা শিখছি—তা–ও অবশ্য অনেক। সুযোগ পেলে তাঁর সান্নিধ্য যদি পেতাম, সপ্তাহে অন্তত একটা দিন, যদিও তা অসম্ভব।