চিত্রনায়িকা মুনমুন
চিত্রনায়িকা মুনমুন

একটা মহল আমার পেছনে লেগে আমার এই সর্বনাশ করেছে: চিত্রনায়িকা মুনমুন

নব্বই দশকের আলোচিত চিত্রনায়িকা মুনমুন। ১৯৯৬ সালে ঢালিউডে অভিষেক হয় তাঁর। ওই সময় চলচ্চিত্রে অ্যাকশন নায়িকা হিসেবে বেশ পরিচিত পান তিনি। একাধিক লেডি অ্যাকশন ঘরানার সফল ছবি উপহার দিলেও একটা সময় তাঁর ছবিতে ‘অশ্লীলতা’র তকমা লেগে যায়। সেই আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে ২০০৩ সালে এসে চলচ্চিত্রে অনিয়মিত হয়ে পড়েন এই নায়িকা। এ পর্যন্ত আশির অধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন মুনমুন। অনেক দিন পর ‘রাগী’ নামে তাঁর নতুন একটি ছবি মুক্তি পেয়েছে । ছবিতে প্রথমবারের মতো খলনায়িকা হিসেবে দেখা গেছে তাঁকে। সিনেমাজীবন, ব্যক্তিজীবন—এসব নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন এই অভিনেত্রী।

প্রশ্ন

প্রথম খলনায়িকার চরিত্রে অভিনয়। দর্শকপ্রতিক্রিয়া কেমন?

ভালো সাড়া পাচ্ছি। আমার ছবি দেখতে এত মানুষ আসবে বুঝিনি, কল্পনাও করিনি। সেই ২০০৩ সাল থেকে নিয়মিত সিনেমা করা ছেড়ে দিয়েছি। অনেক দিন পর দর্শকের সামনে এলাম। তা-ও আবার ভিন্নরূপে। ভেবেছিলাম, মানুষ ভুলে গেছে আমাকে। মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটা কাজ করেছি। আমরা কয়েকজন ‘রাগী’ দেখতে মধুমিতা, চিত্রামহল ও নিউ গুলশান সিনেমা হলে গিয়েছিলাম। আমাদের ঘিরে দর্শকের যে আগ্রহ দেখেছি, খুব ভালো লেগেছে। দর্শকেরা আমাকে এখনো পর্দায় দেখতে চান, হলে গিয়ে বুঝতে পারলাম। নায়িকা থেকে খলনায়িক—আমাকে নতুনভাবে দেখেছেন দর্শক। ছবির পরিচালককে ধন্যবাদ জানাই। তিনি এমন একটি চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে কাজের সুযোগ দিয়েছেন। প্রথম দিন কয়েকটি হলে গিয়ে দর্শকের চাপে আমরা সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম।

প্রশ্ন

বলছিলেন, আপনাকে ঘিরে দর্শকের এখনো আগ্রহ আছে। তাহলে এখন থেকে নিয়মিত অভিনয়ে ফিরবেন?

অনেক দিন পর অভিনয় করার মতো, কাজ করার মতো চরিত্র পেয়েছি ‘রাগী’ ছবিতে। চরিত্রটির ওজন আছে। লেডি ভিলেন। ছবিতে আমার এন্ট্রিটাও দারুণ হয়েছে। এ  রকমের গল্প বা কাজ করার মতো চরিত্র পেলে অবশ্যই কাজ করব। এখন আমাকে যদি দুই-তিনটা সংলাপ ধরিয়ে দিয়ে কলাগাছের মতো দাঁড় করিয়ে রাখে, নামেই থাকল যে ছবিতে মুনমুন আছে, তাহলে তো সেখানে কোনো কিছুই করার সুযোগ থাকল না। কিন্তু কাজ করার মতো চরিত্র হলে অবশ্যই করব। কারণ, আমি তো শিল্পী। একসময় এটি আমার পেশা ছিল। হয়তোবা মাঝখানে সে রকম ভালো অফার পাইনি। এ জন্য বিরতি দিয়ে কাজ করেছি। তবে নিয়মিত কাজ করতে আরও একটু সময় নিতে চাই। আগে দেখি, ‘রাগী’ ছবির মতো চিত্রনাট্য, চরিত্র আসে কি না।

আমার প্রথম শুটিং করা ছবি ‘মৌমাছি’ হলেও  মুক্তি পাওয়া ছবি ‘আজকের সন্ত্রাসী’। এটি ১৯৯৬ সালে মুক্তি পায়। এরপর একের পরপর হিট হতে থাকে আমার ছবি। একজন শিল্পীর একের পর এক ছবি হিট হতে থাকলে পরিচালক ও প্রযোজকেরা তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অজান্তে শত্রুও তৈরি হয়। কিছু কিছু পরিচালক ও প্রযোজক ফায়দা লোটার চেষ্টা করেন। লাভের আশায় আমার অভিনীত সিনেমাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন। আমি নিজে কোনো অন্যায় করিনি। কিন্তু একশ্রেণির ফায়দাবাজ আমার কাজের মধ্যে অন্যায় জিনিস ঢুকিয়ে দিয়েছেন। তাঁরাই আবার আমার দিকে অন্যায়ের ঢিল ছুড়েছেন। আমি অ্যাকশন নায়িকা হিসেবে যেসব ছবিতে কাজ করতাম, সেসব ছবিতে কাটপিস সংযোজন বেশি হতো। তখন আমি জায়গাটিকে নিরাপদ মনে করিনি। ফলে বাধ্য হয়ে একটা সময় চলচ্চিত্র ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল আমাকে।

‘টারজান কন্যা’ ছবিটি মুক্তির পর আলোচনায় আসেন মুনমুন। ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন

কিন্তু ওই সময় আরও কয়েকজন নায়ক-নায়িকাসহ আপনাকেও তো অশ্লীল সিনেমার নায়িকার তকমা দেওয়া হয়েছিল। কী বলবেন?

এ বিষয়ে আর কত বলব? সেই সময় দর্শক আমার নামে সিনেমা হলে আসতেন। কারণ, দর্শক তখন জানতেন, মুনমুন একজন অ্যাকশন নায়িকা, অভিনয়ে ভালো, ফাইটে ভালো, নাচও ভালো পারে। এসব কারণে আমার ছবি দেখার জন্য হলে দর্শক ভিড় করতেন। আর অশ্লীলতার ব্যাপারটা ক্লিয়ার করি। আমি ১৯৯৬ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ছবিতে নায়িকা হিসেবে নিয়মিত কাজ করেছি। ওই সময় কিন্তু সিনেমায় অশ্লীলতা সেভাবে ছিল না। ২০০৬, ২০০৭ সালের দিকে সিনেমায় অশ্লীলতার জোয়ার ছিল। তত দিনে আমি চলচ্চিত্র থেকে সরে আসি। ১৯৯৬ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ওই সময়ের আমার ছবি দেখেন, কোথাও অশ্লীলতা পাবেন না। আমি কি কোনো ধরনের হট পোশাক পরেছি? খোলামেলা পোশাক পরেছি? সেটার প্রমাণ কোথায়?

আমি যে পোশাক পরে অভিনয় করতাম, তখনকার সব নায়িকাই একই ধরনের পোশাক পরে অভিনয় করতেন। তখনকার আমার সিনেমাগুলো দেখলেই বুঝবেন। একটা মহল আমার পেছনে লেগে আমার এই সর্বনাশ করেছে। ইলিয়াস কাঞ্চন, মান্না, শাকিব খান, আমিন খান, নাঈম, রুবেল, বাপ্পারাজসহ দেশের এ গ্রেডের অনেক নায়কের বিপরীতে নায়িকা ছিলাম আমি। এই সময়ে এসেও অশ্লীলতার ব্যাপারটি ধরে আমাকে কেন বারবার প্রশ্ন করা হয়? না জেনে, না বুঝে অনেকেই আমার দিকে এ বিষয়ে আঙুল তোলেন। খুবই কষ্ট লাগে। আমার ইতিহাসটা সবার জানা উচিত। আমি সেই সময় দেলোয়ার জাহান ঝন্টু, কাজী হায়াৎ, মালেক আফসারীদের মতো গুণী নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করেছি। তাঁরা তো অশ্লীল ছবি নির্মাণ করেননি। সেই সময় আমার ছবিগুলো হিট হচ্ছিল। একটা মহল চাচ্ছিল কীভাবে আমাকে অশ্লীলতার মতো এই বাজে তকমা দেওয়া যায়। সেটাই তারা করেছিল।

‘রাগী’ সিনেমার পোস্টারে মুনমুন।
প্রশ্ন

আপনি প্রথম সারির অনেক নায়কের বিপরীতে অভিনয় করেছেন। কোন নায়কের সঙ্গে কাজে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন?

আমি যখন যাঁর সঙ্গে অভিনয় করেছি, তাঁর সঙ্গেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছি। তাঁরাও বলতেন, মুনমুনের সঙ্গে কাজ করতে ভালো লাগে। কারণ, অভিনয়, ড্যান্স, ফাইট—সবই ভালো আয়ত্তে ছিল। আমি যখন আসি, তখন ইলিয়াস কাঞ্চন ভাই, রুবেল ভাই, মান্না ভাইয়েরা সুপারস্টার ছিলেন। আমার সৌভাগ্য যে নতুন হয়েও তাঁদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম।

প্রশ্ন

চলচ্চিত্রে কীভাবে এসেছিলেন?

ঘটনাটি ১৯৯৬ সাল। এহতেশাম দাদুর কাছে গিয়েছিলাম। ইচ্ছে ছিল, তাঁর সঙ্গে সহকারী হিসেবে কাজ করে একসময় চলচ্চিত্র পরিচালক হব। এহতেশাম দাদু চলচ্চিত্রের অনেক পরিচালক, নায়ক ও নায়িকা উপহার দিয়েছেন। তো সেই সময় আমি তাঁর কাছে বেশ কয়েকবার গেলাম। আমাকে দেখে তাঁর কথা, ‘তুমি স্বাস্থ্যটা একটু কমাও, নায়িকা হও। অভিনয় করতে পারবা।’ মানসিকভাবে তিনিই আমাকে নায়িকা হওয়ার জন্য প্রস্তুত করলেন। আমার প্রথম ছবি লেডি অ্যাকশন ঘরানার ‘মৌমাছি’ তৈরি করলেন তিনি। ছবিটিতে কাজের সময় তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘মুনমুন, দেখবে লেডি অ্যাকশন মুভিতেই তোমার ভালো ভবিষ্যৎ আছে।’ একসময় তাঁর কথাই ঠিক হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে ‘টারজান কন্যা’ সুপারডুপার হিট হয়েছিল। এর পর থেকে একের পর এক লেডি অ্যাকশন সিনেমার প্রস্তাব আসতে থাকে। ‘নিষিদ্ধ নারী, ‘রানি কেন ডাকাত’সহ অনেকগুলো অ্যাকশন নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেছি। সেই সময় ছবিগুলো দারুণ ব্যবসা করেছে।

বাস্তবে জীবনে কারোর গালে একটা চড়ও দিইনি আমি, কীভাবে অ্যাকশন চরিত্রে কাজ করব, এত মারামারি করব—শুরুতে এসব নিয়ে ভয় ছিল আমার। প্রথম প্রথম আমার কাছে অস্বস্তি লাগত।
রাগ-ক্ষোভ, বিষাদময় মন নিয়ে ২০০৩ সালে বিয়ে করেই সিনেমাজগৎ থেকে দূরে সরে পড়েন মুনমুন। ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন

নিজের পছন্দে নাকি দর্শকের চাহিদার কারণে এ ধরনের চরিত্রে বেশি কাজ করতেন?

অ্যাকশন নায়িকা হিসেবে দর্শকেরা আমাকে পছন্দ করেছিলেন। ফলে প্রযোজক, পরিচালকেরাও আমাকে নিয়ে এ ধরনের ছবি তৈরিতে এগিয়ে এসেছিলেন সে সময়। যদিও প্রথম দিকে আমার এ ধরনের চরিত্রে কাজ করতে ভালো লাগত না। কারণ, প্রচুর ফাইট করতে হতো। অ্যাকশন চরিত্র করতে অনেক পরিশ্রম করতে হতো।

বাস্তবে জীবনে কারোর গালে একটা চড়ও দিইনি আমি, কীভাবে অ্যাকশন চরিত্রে কাজ করব, এত মারামারি করব—শুরুতে এসব নিয়ে ভয় ছিল আমার। প্রথম প্রথম আমার কাছে অস্বস্তি লাগত। একটা সময় আমার ওস্তাদ ফাইট ডিরেক্টর আরমান স্যার, মোসলেম স্যারের কাছে ফাইট শিখলাম। যখন পরিপূর্ণভাবে ফাইটটা শিখে গেলাম, তখন আবার অ্যাকশন চরিত্রে কাজের নেশা হয়ে গেল। ছবিতে ফাইট না থাকলে ভালো লাগত না। চিত্রনাট্য এলে পড়ে যে ছবিটিতে ফাইট বেশি থাকত, সেই ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হতাম।

মুনমুন এখন পুরোদস্তুর সংসারী। ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন

নতুন করে আর সংসার করবেন না?

যেকোনো কারণেই হোক, আমার সংসার টেকেনি। আমার দুটি ছেলেসন্তান আছে। বড়টার নাম যশ, সে নবম শ্রেণিতে পড়ে। ছোটটার নাম সিব্রাম, তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তবে অবশ্যই বিয়ে করব। একা একা তো থাকতে পারব না। থাকা ঠিকও হবে না। সময় হলেই নতুন সংসারের খবর জানাব আপনাদের।