পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে গাইছেন রফিকুল আলম। গত দুই মাসে এই শিল্পীর নতুন চারটি গান প্রকাশিত হয়েছে। তৈরি হচ্ছে আরও কয়েকটি নতুন গান। নতুন গান ও অন্যান্য প্রসঙ্গে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন মনজুর কাদের
‘পাহাড়ের কান্না’ ও ‘সকাল-সন্ধ্যায় চায়ের চুমুকে’—দুটি গানের কোন দিকটা আপনাকে সবচেয়ে টেনেছে?
রফিকুল আলম : দুটো গানেরই কথা সুন্দর। মোটেও গতানুগতিক কথা না, নতুন ধরনের মনে হয়েছে। সুরও মনে ধরেছে আমার। সুরকার নতুন প্রজন্মের—সম্রাট, শুনেছি ওর বাবাও গান গাইত। সে খুব ভালো কাজ করছে, আমার ভীষণ মনে ধরেছে—তাই গানগুলো গেয়েছি। এসব গানে আমার গায়কির ঢং আগের চেয়ে আলাদা।
আপনি সব সময় বলেন, ‘মৌলিক গানই একজন শিল্পীর পরিচয়’—এই সময়ে মৌলিক গান টিকিয়ে রাখার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কোথায় দেখছেন?
রফিকুল আলম : পাঁচ দশক ধরে গান করছি। আমি সব সময় বলি এবং পালন করিও—আমার গান যদি ১০ জনও শোনে, তাহলে নিজের গাওয়া গানই গাইব। কিশোর কুমারের গান গেয়ে আমি টাকাপয়সা কামাব, জনপ্রিয়তা পেতে চাইব—তা তো হবে না। আমরা যখন কাজ শুরু করেছি, একের পর এক মৌলিক গান প্রকাশ করছি—ওই সময়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ভারতের শিল্পীরা পুরো পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের গান তখন সেভাবে কেউ শুনতে চায়নি। সুবীর নন্দী, নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর গানও তখন কেউ শুনতে চায়নি। সবাই শ্যামল মিত্র, কিশোর কুমার শুনতে চাইত। এরপরও শুধু আমাদের চেষ্টায়, এতগুলো গান বেরিয়ে এসেছে। এটা তো অনেক বড় কৃতিত্বের কথা। আমি এবং আমরা কখনো নিজেদের গান ছাড়া অন্যদের গান গাইনি। তবে এই সময়ে মৌলিক গান টিকিয়ে রাখার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রযুক্তি। আমার বেশ কয়েকটি গান তৈরি হয়ে ঘরে পড়ে আছে। প্রযুক্তি ছাড়া তো এসব গান মানুষের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। এখন শ্রোতার কাছে পৌঁছানোর একমাত্র পথ হচ্ছে প্রযুক্তি। প্রযুক্তির পেছনে দেওয়ার মতো এত সময়ের শক্তি, ধৈর্য কোনোটাই তো নেই। টেকনিক্যালি কিন্তু আমি অতটা দক্ষ নই। ডিভাইস চালানোর ক্ষেত্রে অতটা প্রতিযোগিতাও করতে পারব না। সুবীর নন্দী বেঁচে থাকতে আমরা প্রায়ই এসব নিয়ে আলাপ করতাম—গান গাইব, আবার শ্রোতার কাছে গান পৌঁছানোর জন্য আমাদের ছুটতে হবে! এটা তো পারব না। এমন বিদ্যা তো আমরা শিখিনি।
এখনকার গান প্রকাশের মাধ্যম (ইউটিউব, স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম) নিয়ে আপনার মত কী? পুরোনো সময়ের রেডিও–ক্যাসেট যুগের সঙ্গে তুলনা করলে কী বদল দেখছেন?
রফিকুল আলম : আগেও প্রযুক্তির প্রভাব ছিল। কিন্তু প্রযুক্তি এভাবে আমাদের গিলে ফেলতে পারেনি। এখন প্রযুক্তি আমাদের গিলে ফেলেছে। আগামী ৫০ বছরে হয়তো এমন দৃশ্য দেখতে হবে—প্রযুক্তি বলছে, গোলাপ ফুল সেরা, আমাদের সেটাই ঠিক বলে ধরে নিতে হবে। আমাদের ইচ্ছা বা ভালো লাগা নিয়ন্ত্রণ করবে প্রযুক্তি। এসবের প্রমাণ এআই দিয়ে মানুষ এখন কিছুটা পাচ্ছে। কথা হচ্ছে, এআই তো কিছুই না। এরপর যে প্রযুক্তি আসবে সেটা মেধাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এসবের একটা সুবিধাও কিন্তু আছে, এসব প্রযুক্তিতে যদি গানটা ঠিকঠাকভাবে আমরা দিতে পারি, সেই গানের ভালো মেরিট থাকে, তাহলে তো জয়জয়কার।
আপনি যে সময় গান শুরু করেছিলেন, তখনকার সংগীতজগৎ আর এখনকার সংগীতজগতে সবচেয়ে বড় পার্থক্য কোথায় দেখেন?
রফিকুল আলম : ধারায় এবং চাহিদায় কিছু পরিবর্তন এসেছে। তবে সংগীত তো সংগীতই। এটা পরিষ্কার মনে আছে, আশির দশকে কিছু ক্যারিবিয়ান আর অ্যাফ্রো–আমেরিকান শিল্পীরা অত্যাচারই করেছিল—র্যাপ, হিপহপ করে গানকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারল আর কই? গান কিন্তু গানের জায়গায় বহাল তবিয়তে আছে। আমি যদি এভাবে বলি, সংগীতের আঙ্গিক পরিবর্তন হয়, অঙ্গ পরিবর্তন হয় না।
এখন গানের কথায়, সুরে বা পরিবেশনায় কী ধরনের পরিবর্তন আপনার চোখে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে?
রফিকুল আলম : এখন সহজ কথা ও সহজ সুরের গান বেশি হচ্ছে। আমাদের সময়েও এমনটা ছিল তবে এখন তা বেড়েছে। সারা পৃথিবীতে সব সময় হয়েছে সুরনির্ভর গান—সুরের প্রাধান্যটা এখন কমেছে। আমরা আগে গানে যে কঠিন উপমা দিতাম, এখনকার গানে সেসব কঠিন উপমায় যেতে চাইতে কাউকে দেখি না।
এখনকার তরুণ শিল্পীরা কি যথেষ্ট পরিশ্রম ও সাধনা করছেন বলে মনে হয়?
রফিকুল আলম : যারা করার তারা ঠিকই পরিশ্রম ও সাধনা করছে। তারা নীরবে, আড়ালে, গোপনে সাধনা করে চলছে। তবে করপোরেট জগৎটা খুব নিষ্ঠুর। করপোরেট জগৎ মানুষের আবেগের কোনো মূল্য দেয় না, সেখানে যুক্তির মূল্য বেশি প্রাধান্য পায়। তাদের এ রকমও মনে হতে পারে, আমরা রফিকুল আলমের পেছনে কেন ৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করব? এর চেয়ে বরং চটুল কোনো গানের পেছনে অর্থ ঢাললে বেশি ভালো। ব্যবসা, আলোচনা বেশি।
আপনার মতে, বাংলাদেশের সংগীতের আসল সমস্যা এখন কোথায়—গানের মান, প্রচারণা, না শ্রোতার রুচি?
রফিকুল আলম : শ্রোতাদের অনেক দায়িত্ব। কেন জানি মনে হয়, শ্রোতারা দায়িত্বহীন হয়ে পড়েছে। আগে শ্রোতাদের অনেক দায়িত্ব ছিল। গান খারাপ হলে যেমন বলত, তেমনি ভালো হলেও কত প্রশংসা করত। উৎসাহ দিত। এখন প্রশংসার ভাষাও পাল্টেছে। শ্রোতারা কেন তাদের দায়িত্ব থেকে দূরে সরে এসেছে, তা সমাজবিজ্ঞানীরা হয়তো বলতে পারবেন, এর মধ্যে অর্থনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারও জড়িত। সামাজিক অস্থিরতাও হতে পারে কারণ। ভালো গান, খারাপ গান সব সময় হয়েছে, হয়ও। এরপর শ্রোতারা ভালো গানকে একটা পর্যায়ে নিয়ে যায়। আগে চিঠি লিখে গান নিয়ে নিজেদের মনের কথা বলত।
আপনি ২৮টি ভাষায় গান গেয়েছেন—এই বৈচিত্র্যে প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছিলেন?
রফিকুল আলম : ২৮ ভাষার গান শেখার জন্য করেছি তা নয়। প্রয়োজনে ২৮ ভাষার গান গেয়েছি। তখন একটা চমৎকার পরিবেশ ছিল। কোনো বিদেশি অতিথি এলে, প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের কেউ এলে—যতগুলো সরকার দেখেছি, তখন সরকারের পক্ষ থেকে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা হতো। আমাদেরকে ওসব অনুষ্ঠানে গান শোনাতে বলত। অনুষ্ঠানের আগে তখন আমরা চলে যেতাম সংশ্লিষ্ট দূতাবাসে। তখন সহজে তো গান সংগ্রহ করা যেত না। তাই ওদের সঙ্গে আলাপ করে গান তুলে নিতাম। তবে বিদেশি ভাষার গান গাওয়ার আগ্রহ ছিল। ভারতের কাশ্মীর, তামিল, তেলেগু ভাষার গান গাইবার ব্যাপারে আগ্রহ ছিল আমার। তামিল একটা গান প্রায়ই গাইতাম। বাংলা ভাষার বাইরে ইতালি ও ব্রাজিলের ভাষায় গান গাইতেও ভালো লাগত। প্রয়োজনের কারণে এসব হয়েছে।
আপনি ২০০–এর বেশি সিনেমায় গান গেয়েছেন। এখন চলচ্চিত্রে গানের অবস্থান কোথায় বলে মনে হয়?
রফিকুল আলম : চলচ্চিত্রই তো এখন কমে গেছে। তাই গানের সংখ্যাও কমে গেছে। জুরিবোর্ড এবং সেন্সর বোর্ডে যুক্ত থাকার কারণে এ সময়ের অনেক সিনেমা দেখার সুযোগ হয়েছে। আমি দেখেছি, বেশির ভাগ ছবিতে পূর্ণাঙ্গ গান থাকে না। প্রেমের দৃশ্য প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একটা গানের দরকার হয়। এখন গল্প ও কাহিনিভিত্তিক ছবিও কম তৈরি হয়, তাই হয়তো গানের সংখ্যাও কম। গানের কথার গভীরতাও কম। গানের দৈর্ঘ্য অনেক কম। ভারতের মতো ইন্ডাস্ট্রিতেও গানের দৈর্ঘ্য কমে গেছে। চাহিদাও হয়তো কম, তাই এমনটা হচ্ছে।
সংগীতশিল্পী আবিদা সুলতানার সঙ্গে আপনার দীর্ঘ সংগীতজীবন—পরস্পরের কাছ থেকে কীভাবে শিখেছেন বা অনুপ্রাণিত হয়েছেন?
রফিকুল আলম : বিদেশি গান গাওয়া নিয়ে আমার যে আগ্রহ, এটা আবিদার কাছ থেকে বেশি পেয়েছি। আবিদা বিদেশি ভাষার গান খুব ভালো গাইতে পারে। ফ্রেঞ্চ ভাষায় তো দারুণ গায়। আরবি ভাষায়ও কী যে ভালো গাইত। মঙ্গোলিয়ান ভাষার গানও চমৎকার গায়। ওর কারণে বিদেশি ভাষার গানে আগ্রহটা বেড়েছে। বিদেশি গান প্রয়োজনের কারণে শিখেছি। তবে এই শেখার ক্ষেত্রে আবিদা আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে।
আপনাদের ছেলে ফারশিদ আলমও সংগীতচর্চা করছেন—তবে বর্তমান সংগীত পরিবেশে তাঁর মতো নতুনদের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?
রফিকুল আলম : আমার ছেলে ইংরেজি গান খুব ভালো গায়। ওকে আমি কখনো ইচ্ছা করেই গাইড করিনি। আমি যদি তা করতাম, তাহলে সে রফিকুল আলমের একটা রেপ্লিকা হতো। ওর ভেতরে আমি ঢুকে পড়ব, এটা চাইনি। ওর ভেতরে কিন্তু আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য আছে। বাবা হিসেবে বলছি না, ওর গায়কি স্টাইল সমসাময়িক কারোরই নাই—দ্ব্যর্থকণ্ঠে বলে দিলাম। একজন শিল্পী এবং টেকনিশিয়ান হিসেবে বলছি, নট অ্যাজ আ ফাদার।
আপনাকে যদি জীবনের প্রিয় একটি গান বেছে নিতে বলা হয়, কোনটি বলবেন এবং কেন?
রফিকুল আলম : এটা বড় কঠিন কাজ। তারপরও যদি বলতে হয়, আমার জীবনে কবি শামসুর রাহমানের লেখা ‘কখনো আমার মাকে’ গানটা সেরা মনে হয়। এই গান যদি এখন বাংলাদেশের কোনো শিল্পী বা ভারতের কোনো শিল্পী গাইতে পারে—আমি গান গাওয়াই ছেড়ে দেব। গানটা এত চমৎকার, কী যে অসাধারণ সুর। সত্যদার (সাহা) সুরে যখন গানটা গেয়েছি, তখন এত কিছু বুঝিনি, গেয়ে দিলাম। আস্তে আস্তে দেখলাম, গানটি শিক্ষিত শ্রেণির মানুষেরা পছন্দ করা শুরু করেছে। গানটি প্রথম গেয়েছিলাম ১৯৮৩ সালে, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের পাশে রেকর্ডিং স্টুডিওতে। ওই সময় সিনেমার বেশির ভাগ গানের রেকর্ডিং এই স্টুডিওতে হতো। গানটা প্রিয়, কিন্তু বেশি মানুষের কাছে পৌঁছায়নি, কবিতা এবং সাড়ে পাঁচ মিনিট দৈর্ঘ্যের কারণে। এই দৈর্ঘ্যের কারণে গানটি তখন রেডিও আর টেলিভিশনেও চালাত না। তখন সাড়ে তিন বা চার মিনিটের বেশি দৈর্ঘ্যের গান কোথাও চালাত না। ২০০৫ সালে এই গানটা আবার গেয়েছিলাম।
কোনো গান বা শিল্পী কি আজও আপনাকে অনুপ্রাণিত করে?
রফিকুল আলম : পুরোনো শিল্পীদের কথা বলতে হবে। কে এল সায়গলের গান এখনো শুনি। আরেকজনের তালাত মাহমুদ। আমার সব সময় মনে হয়, তাঁরা সুরের মধ্যে ডুবে থাকতেন। তাঁরা আমাকে সব সময় অনুপ্রাণিত করেন।
আপনি বাংলাদেশের সংগীতের ভবিষ্যৎ কোথায় দেখতে চান?
রফিকুল আলম : (হাসি) সংগীতের ভবিষ্যৎ কোনো শিল্পী বলতে পারে না। আমি মনে করি, সংগীত তো নিজের গতিতে চলে, শক্তিতে চলে। তবে সারা পৃথিবীতে মিউজিক কিন্তু এখন নিম্নমুখী, তাই কী হবে বলতে পারব না। এটা বলতে পারি, সারা পৃথিবীতে সংগীতের খরা চলছে। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো জায়গা থেকে এমন কোনো গান বের হচ্ছে না, যা পৃথিবীব্যাপী আলোড়ন তৈরি করছে। আমেরিকার কথা বলছি না, কারণ ওটা পুরোপুরি ব্যবসায়ী দেশ। কিন্তু জার্মানি, ব্রিটেন, ফ্রান্স—এরা তো সংগীতকে অন্যন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে গত ২০ বছরে তো এমন কোনো গান পাইনি। হয় তারা কাভার করছে, নয়তো পুরোনো গান ভেঙেচুরে কিছু একটা করছে, মৌলিক এমন কোনো গান পাচ্ছি না।