গতকাল বুধবার সকালে প্রথম আলোর ক্যামেরায় ঢাকার গ্রীণরোডের বাসায় মাসুদ আলী খান
গতকাল বুধবার সকালে প্রথম আলোর ক্যামেরায় ঢাকার গ্রীণরোডের বাসায় মাসুদ আলী খান

ওদের কথা বলতে গেলেই কান্না পায়

সাত দশকের অভিনয়জীবন তাঁর। মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র—তিন মাধ্যমে সমানতালে কাজ করেছেন। ‘কূল নাই কিনার নাই’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘একান্নবর্তী’, ‘পৌষ ফাগুনের পালা’ নাটকে যেমন অভিনয় করেছেন, তেমনি ‘নদী ও নারী’, ‘দুই দুয়ারি’, ‘মাটির ময়না’, ‘মোল্লাবাড়ীর বউ’ চলচ্চিত্রেও ছিল তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। চার বছর ধরে অভিনয়ে নেই একসময়ের মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র অভিনয়শিল্পী মাসুদ আলী খান। এই মুহূর্তে দেশের অভিনয় অঙ্গনের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ এই অভিনয়শিল্পীর সময় কাটে গ্রিনরোডের বাসায় শুয়েবসে আর টিভি দেখে। মাঝে হঠাৎ তাঁকে ‘ইত্যাদি’ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে দেখা গেছে। অভিনয়জগতে সাত দশক ধরে পথচলা এই অভিনয়শিল্পী কেমন আছেন, তা জানতে গতকাল বুধবার সকালে তাঁর বাসায় যায় প্রথম আলো। কলবেল চেপে বাসায় ঢুকতেই দেখা তাঁর সঙ্গে। স্বাগত জানালেন। বসতে বললেন। চেয়ারে বসা তিনি তখন টেলিভিশনে ফুটবল খেলা দেখছিলেন।
প্রশ্ন

কার খেলা দেখছেন?

আমি রাত ১০টায় ঘুমিয়ে পড়ি। তাই বিশ্বকাপ ফুটবলের ওই সময়ের খেলাগুলো দেখার সুযোগ হয় না। রাতে না দেখা ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের খেলা এখন দেখছি।

প্রশ্ন

ফুটবল বুঝি আপনার প্রিয় খেলা?

ছোটবেলায় ফুটবল খেলতাম। স্কুল-কলেজে থাকতেও খেলেছি। তাই ফুটবল খেলা বরাবরই ভালো লাগে।

প্রশ্ন

১ ডিসেম্বর আপনার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন। তা এবার কত বছর হবে?

মনে আছে তাহলে তোমাদের। বাহ, ধন্যবাদ। আমার জন্ম ১৯৩১ সালে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের জামিত্তা ইউনিয়নে নানিবাড়িতে। সে হিসাবে বলা যায়, এবার আমি ৯২ বছর পার করব।

গতকাল বুধবার সকালে প্রথম আলোর ক্যামেরায় ঢাকার গ্রীণরোডের বাসায় মাসুদ আলী খান
প্রশ্ন

একেকজনের কাছে জন্মদিন ব্যাপারটা একেক রকম, আপনার কাছে কেমন?

এটা ঠিক, অনেকে জন্মদিনটা ভীতিকর মনে করে। অনেক এ-ও ভাবে, বয়স এত বছর হয়ে গেল! আমার কাছে এটা খুবই সহজাত ব্যাপার। তাই আমি ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করি। বয়স কমে যাচ্ছে, মৃত্যুর দিকে এক বছর এগিয়ে গেলাম, এমনটা কখনোই ভাবি না। মৃত্যুর যথাসময়েই আসবে, এটা নিয়ে অযথা ভেবে মাথা খারাপ করার কোনো মানে হয় না। ছোটবেলায় তো কখনো জন্মদিন উদ্‌যাপন করা হতো না। এখন নাতি-নাতনিরা আছে, ওরা দাদা-নানার জন্মদিন মনে করিয়ে দেয়।

প্রশ্ন

৯১ বছরের জীবন ফেলে এসেছেন। পেছন ফিরে তাকালে কেমন লাগে?

এখন আহ্বান করছি মৃত্যুর। মনে হয়, দেখলাম তো অনেক, আর কীই-বা দেখার আছে, পাওয়ার আছে। যদিও মানুষ বলে, পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা কখনো শেষ হয় না। আমার তা কখনোই মনে হয় না। যথেষ্ট পেয়েছি। আমি সন্তুষ্ট। জীবন নিয়ে কোনো খেদ নেই আমার।

প্রশ্ন

জন্ম ও মৃত্যু বিষয়ে আপনার ভাবনা কী?

জন্মে মানুষের যেমন হাত নেই, মৃত্যুতেও নেই। তবে ইদানীং একটা জিনিস আমাকে খুব কষ্ট দেয়। ভাবতে থাকি, আমার খেলার সাথি যারা ছিল, অভিনয়ে, খেলাধুলায়—চারদিকে তাকালে দেখি, এখন আর কেউ নেই। আমি যাদের কথা মনে করতে পারি, তারা কেউ নেই। কদিন আগে গ্রামে গিয়েছিলাম, সম্পর্কে ভাই হয়, মজিবুর রহমান খান, দেখলাম, তিনি শুধু বেঁচে আছেন। এসব ভাবলে খুব বেদনা দেয়।

মাসুদ আলী খান
প্রশ্ন

এখন তো বাসায়। সময় কাটে কীভাবে?

ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং, বেশির ভাগ সময় কাটে ঘুমিয়ে। চার বছর আগে পড়ে গিয়ে পিঠের হাড় ভেঙে যায়। এর পর থেকে বাসার বাইরে যাই না। পিঠের ব্যথা সেরে গেলেও কোমর থেকে পা পর্যন্ত ব্যথা হয়। মাঝেমধ্যে ব্যথা ভীষণ বাড়ে। শুয়ে থাকলে ব্যথা কম লাগে। তাই ব্যথা ভুলতে শুয়ে থাকি। ঘুমও বেড়ে গেছে তাই। বাকি সময়টায় টেলিভিশন দেখি, গান শুনি। আর বই পড়ি।

প্রশ্ন

কার গান বেশি শোনেন?

মান্না দে আমার সবচেয়ে প্রিয় শিল্পী। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ও আমার প্রিয়। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ও ভালো লাগে। এর বাইরে বাংলাদেশের সৈয়দ আব্দুল হাদী এবং সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠ খুব ভালো লাগে। দেশের বাইরে আমার আরেকজন প্রিয় গায়ক কবীর সুমন। গান গাইতে গাইতে তার কথা বলার যে ব্যাপারটা, এটা দারুণ! ঢাকায় এসেছিল শুনেছি, খুব ইচ্ছা ছিল যাওয়ার। যেতে পারিনি বলে খুব খারাপ লেগেছে। আর ইনস্ট্রুমেন্টের মধ্য সরোদ খুব প্রিয়। ঢাকায় বাহাদুর হোসেন খানের সামনে বসে সরোদ শুনেছি। আমার ‘নদী ও নারী’ ছবিতে তিনি মিউজিক ডাইরেক্টর ছিলেন।

মাসুদ আলী খান
প্রশ্ন

আপনার পরবর্তী সময়ে যাঁরা অভিনয় করেছেন, তাঁদের মধ্যে কাকে ভালো লাগে?

রাইসুল ইসলাম আসাদ, সুবর্ণা মুস্তাফাকে ভালো লাগে। হুমায়ুন ফরীদিকেও খুব ভালো লাগত। তরুণদের মধ্যে অপি করিমকে ভালো লাগে। আমার সঙ্গে যারা অভিনয় করত, তাদেরও খুব ভালো লাগে। শর্মিলী অভিনয় করত, সে মারা গেছে। দিলারা জামান—ওদের কথা বলতে গেলেই কান্না পায়। আমি যদি এখনো অভিনয়ে থাকতে পারতাম (কান্না)! লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন—শব্দগুলো খুব মিস করি। আমার কিন্তু অভিনয় করার সময় মনে থাকত না ক্যামেরার সামনে কিছু করছি। আমি সব সময় ওই চরিত্র হওয়ার চেষ্টা করতাম। ভাবতাম, আমিই যদি বিশ্বাস না করি, তবে দর্শক কেন বিশ্বাস করবে? অভিনয়ে কিন্তু আমরা বানানো কথাই বলি। অন্যের কথা বলি। সেগুলো তখন যদি নিজের কথা ভেবে বলি, যদি না ফিল করতে পারি আমারই কথা, তাহলে তো অভিনয় হবে না। যাদের সঙ্গে অভিনয় করেছি—দিলারা জামান, শর্মিলী—তারা ছিল বন্ধুর মতো। দিলারা এখনো নিয়মিত ফোন করে। আর বেশির ভাগ নায়িকাই আমাকে বাবা বলে ডাকত। আমিও তাদের সন্তানস্নেহে দেখেছি সব সময়।

প্রশ্ন

সাত দশকের অভিনয়জীবন। মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন। এখনো রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি অর্জিত হয়নি। এ নিয়ে কোনো আফসোস আছে আপনার?

মানুষের ভালোবাসা পাওয়াই অভিনয়শিল্পীর সবচেয়ে বড় সার্থকতা। যাঁরা হয়তো বিচারকের দায়িত্বে থাকেন, তাঁরা আমাকে রিকগনিশনের যোগ্য মনে করেননি। তাঁদের দৃষ্টিতে হয়তো আমি পড়িনি। তবে সম্প্রতি শিল্পকলা পদক পেয়েছি। একটা কথা কি, অর্জন কখনো শিল্পীর চলার পথ থামিয়ে রাখতে পারে না। এ নিয়ে আমার কোনো অতৃপ্তি নেই। এটা পেলাম না, ওটা পাইনি কেন—এসবে কোনো খেদ নেই। সব সময় নিজের তৃপ্তি ও মানুষকে আনন্দ দেওয়ার জন্যই কিন্তু কাজ করেছি। কোথাও গেলে মানুষ যেভাবে সম্মান করে, আন্তরিকভাবে মেশে, এটা কয়জনের ভাগ্যে জোটে। অভিনয় করেছি বলেই এটা হয়েছে।

মাসুদ আলী খান
প্রশ্ন

আপনার পরিবারের খবর বলুন?

আমার স্ত্রী শিক্ষকতা করতেন, এখন অবসরে। মেয়ে ঢাকায় থাকে, ওর স্বামী বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে রিটায়ার্ড করেছে। ছেলে যুক্তরাষ্ট্রে থাকে, সেখানে একটা এনজিওতে কাজ করে। আর ছেলের বউ ব্যাংকে চাকরি করে।