জাহিদ হাসান
জাহিদ হাসান

আমি বরাবরই ফর্মে ছিলাম, না ডাকলে খেলব কীভাবে: জাহিদ হাসান

‘উৎসব’ সিনেমায় খাইস্টা জাহাঙ্গীর চরিত্রে অভিনয় করে নতুন করে আলোচনায় জাহিদ হাসান। এর আগে ওয়েব সিরিজ ‘আমলনামা’য় তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হয়েছে। তাঁর সঙ্গে বলেছেন মনজুর কাদের

প্রশ্ন

অনেক দিন আপনি সেভাবে অভিনয় করেননি। চলতি বছর ‘আমলনামা’ আর ‘উৎসব’ দিয়ে ব্যাপক প্রশংসা পাচ্ছেন। এই সাফল্য কীভাবে উপভোগ করছেন?

জাহিদ হাসান : এই বয়সে এসেও কাজ করছি, এটাই কম কিসের। সত্যি বলতে, আমাকে তো ঠিকঠাকভাবে কেউ কাজে ডাকে না। কোভিডের পর থেকে এই অবস্থা। ভাবটা এমন, ইনি আবার কে, ইনি তো একটা ডেড হর্স। আমার যে দীর্ঘ অভিনয়জীবন, চেয়ে চেয়ে কাজ করতে পারি না! বলতে পারি না, কাজ দেন, কাজ দেন। এখন কোনো নির্মাতা যদি মনে না করে, কীইবা করার আছে। তারপরও আমি কয়েক জায়গায় গিয়ে গিয়েছি কিন্তু কেউ মনে করেনি। আল্লাহ তাআলার কাছে কৃতজ্ঞতা, তিনি আমাকে দুটি কাজ দিয়েছেন, আমিও চেষ্টা করেছি প্রমাণ করার। সে রকম যদি সামনেও কাজ আসে, করব। আমি তো কাজই করতে চাই।

জাহিদ হাসান
প্রশ্ন

আপনার মতো অভিনয়শিল্পীকে এখনো প্রমাণ করতে হয়...

জাহিদ হাসান : নির্মাতারা কী ভাবছেন, তা তাঁরাই ভালো করে জানেন। এসব আমি সময়ের হাতে ছেড়ে দিলাম।

প্রশ্ন

আপনি বলছিলেন, কোভিড ১৯–এর পর থেকে আপনাকে ডাকে না। কী কারণে ডাকে না বলে মনে হয় আপনার?

জাহিদ হাসান : কোভিডের পর আমাদের সামাজিক অবস্থা বদলে গেছে। কেন জানি সবাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছি। কোভিডের সময় আমাদের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেছে একা একা। কারও সঙ্গে কারও কোনো যোগাযোগ নেই। এর পর থেকে দেখেছি, কাছাকাছি যারা, যারা যাদের সংস্পর্শে, তাদের ডাকা হতো। এই যে দূরত্ব, হয়তো ভেবেছি, সিনিয়রদের দরকার নেই। নতুন প্রজন্ম উঠে এসেছে—তারা হয়তো ভেবেছে, আমরাই রাজা, আর কোনো রাজা নেই দেশে। আর ওরা (আমরা) ছিল কাগজপত্রের রাজা—এটাই আমার কাছে মনে হয়েছে।

জাহাঙ্গীর ও জেসমিনের দুই বয়সের চরিত্রে অভিনয় করছেন সৌম্য জ্যোতি, জাহিদ হাসান এবং সাদিয়া আয়মান ও আফসানা মিমি।
প্রশ্ন

আপনার তিন যুগের অভিনয়জীবন। শিল্পীর বয়স বাড়ার সঙ্গে অভিজ্ঞতাও বাড়ে। অনেক পরিণত হয়। আরও ভালো কাজ উপহার দেয়। আপনার কী মনে হয়?

জাহিদ হাসান : একটা গল্প বলি। ১৫ বছর আগের কথা। নেপালের চিতোয়ান বলে একটা জায়গা আছে, সেখানে গিয়েছিলাম বেড়াতে। পুরোনো জায়গা। জঙ্গল টাইপের। আমার প্রস্রাবের বেগ পায়, সঙ্গে আরেকজন ছিল যে আমার বন্ধু কাম আত্মীয় নাম মিঠু। পথ চলতে চলতে সে একটা পুরোনো গাছের গোড়ায় প্রস্রাব করতে যায়। আমি বলেছি, না। সে তখন বলে, কেন জাহিদ ভাই। বললাম, এই গাছের বয়স আনুমানিক কয়েক শ বছর হবে। এ সময়ের ঝড়, বৃষ্টি, রোদ—সবকিছু কত কিছুর সঙ্গে ফাইট করে দাঁড়িয়ে আছে। এ রকম গাছের নিচে এই ধরনের কাজ করতে পারো না। সে রকমই একজন অভিনয়শিল্পী যখন দীর্ঘ সময় টিকে থাকে, তখন তাকে অনেক কিছুর সঙ্গে ফাইট করতে হয়। তার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি, তাকে অসম্মান করা উচিত না, এটা আমি মনে করি।

প্রশ্ন

অনেক দিন কাজ থেকে দূরে ছিলেন কেন?

জাহিদ হাসান : ওই যে বললাম, আমি তো গিয়ে বলতে পারি না, আমাকে কাজে নেন। আমি জীবনে অভিনয়টাই করেছি। অভিনয়ের জন্য তো অন্য কোনো পেশাতেও যাইনি। আমার ভাইয়েরা সবাই প্রকৌশলী, পিএইচডি ডিগ্রিধারী। আমাকে অভিনয়ের কারণে তখন তো বাসা থেকে বেরও করে দিয়েছিল। যত দিন সুস্থ থাকি, অভিনয় চালিয়ে যাব। অসুস্থ থেকে তো অভিনয় সম্ভব না। অভিনয়ের ক্ষেত্রে সম্মানের বিষয়টাও থাকতে হবে। সম্মান যেখানে থাকবে না, সুস্থ থাকলেও কাজ করব না।

প্রশ্ন

যখন আপনি কাজ থেকে দূরে ছিলেন, সে সময়টায় কী ভাবছিলেন?

জাহিদ হাসান : অনেক সময় মনে হতো, তাহলে এই জীবনে কী করলাম। নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ হয়েছে। নিজে নিজেই আবার স্বপ্ন দেখেছি। আবার মনে হতো, আমি কি ভুল করলাম, ওরাই কি ঠিক? পরে তো চিন্তা করলাম, আমি তো এমন না। ওরাই আমাকে ভুল বুঝছে। নিজের সঙ্গে নিজের রক্তক্ষরণ হলো। নিজের সঙ্গে অভিমান হয়েছে। কাছের লোক, যাদের হেল্প করেছি, তারা পল্টি দিয়েছে। উল্টো তারা আমাকেই বোঝানোর চেষ্টা করেছে, দিস ইজ লাইফ—তখন কষ্টটা লেগেছে বেশি। তবে ওই সময়টায় নিজের ওপর নিজেকে ছেড়ে দিয়েছি; কারণ, আমি আল্লাহকে বিশ্বাস করি, তিনি সবচেয়ে বড় পরিকল্পনাটা করে রেখেছেন।

‘উৎসব’ সিনেমার বিশেষ প্রদর্শনীতে জাহিদ হাসান, আফসানা মিমি, সাদিয়া আয়মান ও সৌম্য জ্যোতি
প্রশ্ন

যখন ‘উৎসব’–এ অভিনয় করলেন, তখন কি মনে হয়েছিল এতটা সাফল্য পাবে?

জাহিদ হাসান : আমি সততার সঙ্গে শুটিং করার চেষ্টা করেছি। তানিম নূর, এই ছেলেটার সঙ্গে অনেক সময় রাগ করেছি। কিন্তু এত ভালো একটা মানুষ, প্রথমেই এসে আমাকে আর মৌকে বলেছে, ভালো হবে ‘উৎসব’। আপনি শুধু কাজটা করেন মন দিয়ে। যখন বিরক্ত হতাম তানিম আমাকে বলত, ‘ভাইয়া, আপনি কিন্তু ক্যারেক্টারে আছেন।’ তখন আমি বলতাম, ‘ধুর গাধা, আমি আছি বিরক্তির মধ্যে, তুমি বলো ক্যারেক্টারের মধ্যে।’ (হাসি) এত ইতিবাচক চিন্তার মানুষ, এত ইতিবাচক চিন্তা দেখে আমি মুগ্ধ তার প্রতি। সে খুবই সৎ ছেলে, খুবই ডায়নামিক, অসাধারণ নেতৃত্বগুণ রয়েছে—সব মিলিয়ে ভালো লাগছে। আমাদের প্রথম কাজ। এর আগে ‘কাইজার ২’–এ কাজ করার কথা ছিল। আলাপও হয়েছিল, কিন্তু পরে বলল, ‘আপনাকে নিয়ে ছবি করব।’ সেটাই হলো ‘উৎসব’।

প্রশ্ন

‘উৎসব’ যখন মুক্তি পায়, মানুষ ছবিটি নিয়ে কথা বলছিল। আপনি তখন ছিলেন হাসপাতালে। সে সময়টার কথা যদি বলতেন...

জাহিদ হাসান : কারও সঙ্গেই যেন এমনটা না হয়। ছবিটি মুক্তি পেল, সুপারহিট হলো—তখন আমি হাসপাতালে যুদ্ধ করছি। অনেকে হাসপাতালে আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল। কিন্তু হাসপাতাল থেকে নিষেধ ছিল; কারণ, কোভিড সময়, কাউকে যেন না আনি। আমার জন্য বোর্ড বসছিল। এর মধ্যে সৌম্য আসছিল, ওর অভিব্যক্তি দেখে আমার কী যে শান্তি লাগছিল। ও বলল, ‘কাকা ছবি সুপারহিট। আমরা হলে হলে যাচ্ছি। আপনি হাসপাতাল থেকে বের হলেই আমরা একসঙ্গে ছবিটি দেখব।’

প্রশ্ন

‘উৎসব’ কেন এত মানুষ পছন্দ করল, আপনার মূল্যায়ন কী?

জাহিদ হাসান : প্রত্যেক মানুষের জীবনে ভুল আছে। আমরা কেউ সঠিক নই। আমরা আশরাফুল মাখলুকাত, ভালো–মন্দ—দুটোই আমাদের মধ্যে আছে। যে জাহাঙ্গীর খাইস্টামি করে, সে আবার সবাইকে খাওয়ায়। সে তার বউকে ইন্টারভিউ বোর্ডে আটকে দিতে চায়, সেই বউকে নিয়েই আবার অন্য রকম পরিকল্পনাও করে। ভুলত্রুটি করে আমরাই হিরো, আমরাই ভিলেন। ছবিতে যে ভূতদের কথা বলা হচ্ছে, তারা আমাদের বিবেক। সবকিছু মিলিয়ে এত কিছু এই ছবিতে ছিল, যার সঙ্গে মানুষ সহজেই সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছে।

দুই সন্তান জারিফ ও পুষ্পিতার সঙ্গে অভিনয়শিল্পী বাবা জাহিদ হাসান
প্রশ্ন

এই সিনেমার পর তো আপনাকে নিয়ে দর্শকের প্রত্যাশা আরও বেড়ে গেছে। সামনে কী পরিকল্পনা করছেন?

জাহিদ হাসান : পরিকল্পনার বিষয়ে আমি জানি না। সামনে যদি কিছু হয়, তাহলে ভালো কাজ করতে চাই। আমি সবাইকে জানাতে চাই, আমাকে যদি সম্মান দিয়ে কেউ ডাকে, তখন আমার সব শক্তি ও সততা দিয়ে কাজটা করি। করার চেষ্টা ভবিষ্যতেও করব। এখন আমাকে কাজ দিল অনেক কিন্তু সম্মানী দিল কম, তাহলে তো কাজ করতে পারব না। আমি কথা দিচ্ছি, যদি সঠিক সম্মান ও সম্মানী আমাকে দেয়, তাহলে কাজ সর্বোচ্চ শক্তি ও সততা দিয়ে করব।

প্রশ্ন

আপনার স্ত্রী–সন্তানেরা উৎসব দেখে কী বলছেন?

জাহিদ হাসান : মৌ ছিল কানাডায়, দেশে এল মাত্র। দু–তিন দিনের মধ্যে দেখবে। আমার ছেলে জারিফ গতকাল (বুধবার) বলল, ‘বাবা বন্ধুদের নিয়ে ছবি দেখতে যাব, কিন্তু টিকিট তো পাচ্ছি না।’ বললাম, ‘আমি টিকিটের ব্যবস্থা করে দিই।’ সে বলল, ‘না না বাবা, আই অ্যাম সো হ্যাপি, এই কারণে যে ছবির টিকিট নেই।’ মেয়ে পুষ্পিতা তো লন্ডনে, পড়াশোনা করছে বিজনেস ম্যানেজমেন্টে, সেখানে মুক্তি পেলে দেখবে।

জাহিদ হাসান। ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন

‘উৎসব’–এর অভিনয়শিল্পীদের অনেকে আপনার সমসাময়িক। কিন্তু নির্মাতা, লেখকেরা এ সময়ের, মূলত ওটিটিতে কাজ করেন। তাঁদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কী?

জাহিদ হাসান : প্রথমে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই, আমার সমসাময়িক বা আমার চেয়ে একটু ছোট মিমি, জয়া, অপি, চঞ্চল সবাইকে—তারা প্রত্যেকে জাতীয়ভাবে পুরস্কার পাওয়া শিল্পী। আলাদাভাবে তারা সবাই অনেক বড়। এখানে তো কেন্দ্রীয় চরিত্র আমি, এরপরও তারা যে সবাই আমার পাশে দাঁড়িয়ে অভিনয় করেছে। তারা চাইলে না–ও করতে পারত। তাই তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আর পরিচালক তানিম নূর বা কৃষ্ণেন্দু—তারা যে আমার ওপর আস্থা রাখছে, তানিম তো শুরু থেকেই বলেছে, আপনি শুধু একটু মাথা ঠান্ডা রাখেন, এই কাজ সুপারহিট হবে। তার একটাই টেনশন, আমার মাথা গরম নিয়ে। আমার ওপর যে ওর কী আস্থা!

প্রশ্ন

মাথা গরম করতেন কী কারণে?

জাহিদ হাসান : আমি ১২ ঘণ্টার বেশি সময় টানা কাজ করতে পারি না। এটাই আমার শরীরের সঙ্গে মানিয়ে গেছে। ৩০ বছরের বেশি সময় যে কাজ করছি, এভাবেই চলেছে। কিন্তু ‘উৎসব’–এ আমাকে ১৮–২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়েছে। রোজার সময়, ইফতার করতে বাসায় আসি, এরপর আবার যাই। রাত চারটা পর্যন্ত কাজ করেছি। এভাবে আমি পারিনি, পারব না। আমার শরীর অভ্যস্ত না। এ কারণে মাথা গরম হতো।

প্রশ্ন

সবাই বলছে, এ বছর ‘আমলনামা’ আর ‘উৎসব’ দিয়ে আপনার দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হলো। আপনি কী বলবেন?

জাহিদ হাসান : আমি তো বলব, সব সময় আমার ইনিংস ছিল। সমস্যা হচ্ছে, আমাকে মাঠেই ডাকেনি। আমি বরাবরই ফর্মে ছিলাম, না ডাকলে খেলব কীভাবে। না খেলতে পারলে মানুষ জানবে কীভাবে, কতটা ভালো কিংবা খারাপ খেলি। এখন কোচ এবং অধিনায়ক যদি মাঠে না নামায়, তাহলে কীভাবে কী!