‘ডিপার্টমেন্ট কিউ’–এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স
‘ডিপার্টমেন্ট কিউ’–এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

দুর্দান্ত এই থ্রিলার আপনাকে নাড়িয়ে দেবে

বিষণ্ন সুন্দর। নতুন এই ব্রিটিশ সিরিজকে এককথায় বোঝাতে এর চেয়ে উপযুক্ত শব্দবন্ধ পাওয়া মুশকিল। ফি সপ্তাহে ওটিটিতে আসা এন্তার ক্রাইম-থ্রিলারের মতো ঝাঁ-চকচকে ব্যাপার নেই, দর্শককে বুঁদ রাখতে অপ্রয়োজনীয় চমক নেই, শর্টস আর রিলসপ্রেমীদের কথা ভেবে ছোট ছোট সেট পিস আর হাজারো জাম্প কাটে ত্যক্তবিরক্ত হওয়ার সুযোগ নেই। নির্মাতার যেন কোনো তাড়াহুড়াই নেই। তিনি যেন আপনাকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন, ধূসর এক দুনিয়ায় ঢুকে পড়ার। যে দুনিয়া বড্ড ধীর, চরিত্ররা মেজাজে শান্ত। নিষ্ঠুর অপরাধ, চতুর অপরাধী সবই আছে, কিন্তু আলাদা গ্ল্যামার ছাড়াই সেগুলো আপনার সামনে হাজির করা হয়েছে।

একনজরেসিরিজ: ‘ডিপার্টমেন্ট কিউ’ধরন: ক্রাইম-থ্রিলারস্টিমিং: নেটফ্লিক্সক্রিয়েটর: স্কট ফ্র্যাঙ্ক ও চাঁদানি লাখানিঅভিনয়ে: ম্যাথু গুড, জেমি সিভস, কেটি ডিকি, অ্যালেক্সিস মানভেলভ, লিয়া বায়ার্ন, ক্লোয়ে পেরি পর্ব সংখ্যা: ৯রানটাইম: ৪২-৭১ মিনিট

`ডিপার্টমেন্ট কিউ' প্রখ্যাত ড্যানিশ ক্রাইম-থ্রিলার লেখক ইউসি অ্যালার-ওলসেনের বহুল পঠিত ‘ডিপার্টমেন্ট কিউ’ সিরিজ থেকে নির্মিত। নরডিক নোয়া উপন্যাস সিরিজটি থেকে ডেনমার্কে ছয়টি সিনেমা হয়েছে। প্রথম চারটি দারুণ, বাকি দুটি ঠিক পাতে দেওয়ার মতো নয়। তবে এবারই প্রথম ‘ডিপার্টমেন্ট কিউ’ থেকে তৈরি হলো সিরিজ। গত ২৯ মে নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে একই নামের সিরিজটির প্রথম মৌসুম। নরডিক নোয়ার গন্ধের সঙ্গে সিরিজটির ক্রিয়েটর স্কট ফ্র্যাঙ্ক আর চাঁদনি লাখানি জুড়ে দিয়েছেন ব্রিটিশ হাস্যরস; সব মিলিয়ে ডিপার্টমেন্ট কিউ হয়ে উঠেছে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার মতো এক সিরিজ।

অনেকেরই হয়তো মনে নেই ২০০৭ সালের সিরিজ দ্য লুকআউট-এর কথা। ওটিটির রমরমার আগেই বুদ্ধিদীপ্ত সিরিজটি বানিয়ে আলোচনায় আসেন স্কট ফ্র্যাঙ্ক। সেই সিরিজের প্রাণভোমরা ছিলেন ম্যাথু গুড; সিরিজে তাঁর করা চরিত্রটি এখনো মনে রেখেছেন অনেক ভক্ত। প্রায় ১৮ বছর পর ডিপার্টমেন্ট কিউ-তে আবার একসঙ্গে কাজ করলেন ফ্র্যাঙ্ক–গুড; বলাই বাহুল্য, মনে রাখার মতোই হলো তাঁদের প্রত্যাবর্তন। স্কট ফ্র্যাঙ্ক এর আগে গডলেস, দ্য কুইনস গ্যাম্বিট-এর জন্য আলোচিত ছিলেন, এবার তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হলো ডিপার্টমেন্ট কিউ-এর নাম।

সিরিজের শুরুটাই হয় হত্যাকাণ্ড দিয়ে। ক্রাইম সিনে গিয়ে আক্রমণের শিকার হন ডিটেকটিভ চিফ ইন্সপেক্টর কার্ল মর্ক (ম্যাথু গুড) আর টিম। আততায়ীর গুলিতে মারা যান এক পুলিশ সদস্য, কার্লের সহকারী জেমস (জেমি সিভস) পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। কার্লের নিজেরও গলায় গুলি লাগে। অস্ত্রোপচার শেষে কাজে ফেরেন তিনি। তবে এ ঘটনা তাঁকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দেয়। এক সহকর্মীর মৃত্যু আর প্রিয় সহকারীর এই অবস্থার জন্য নিজেকেই দায়ী করেন কার্ল।

‘ডিপার্টমেন্ট কিউ’–এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

মনোবিদের সঙ্গে তাঁর থেরাপি চলতে থাকে। এর মধ্যেই কার্লের বস মোরিয়া (কেট ডিকি) জানান যে সরকার থেকে নতুন এক বিভাগ চালু করতে বলা হয়েছে। বাজেট, সুযোগ-সুবিধাও মন্দ নয়। সেই বিভাগে পুরোনো অমীমাংসিত রহস্যগুলো নিয়েই কেবল কাজ হবে। কার্লকে পাঠানো হয় সেই বিভাগের প্রধান করে। গোয়েন্দা কার্যালয়ের বেজমেন্টে অফিস। নতুন বিভাগের প্রধান করে মোরিয়া যে তাঁকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছেন, কার্লের বুঝতে অসুবিধা হয় না। নতুন কাজে তাঁর সঙ্গী হন সিরিয়া থেকে আসা শরণার্থী আকরাম সেলিম (অ্যালেক্সিস মানভেলভ) এবং ডিটেকটিভ কনস্টেবল রোজ ডিকসন (লিয়া বায়ার্ন)।

‘ডিপার্টমেন্ট কিউ’ প্রথমেই তদন্তের জন্য বেছে নেয় চার বছর আগে নিখোঁজ হওয়া আইনজীবী মেরিট লিংগার্ডের (ক্লোয়ে পেরি) কেস, যিনি রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যান। চার বছর পরও কি তিনি বেঁচে আছেন? কার্ল আর টিম তদন্তে নেমে জড়িয়ে পড়েন জটিল এক রহস্যে।

‘ডিপার্টমেন্ট কিউ’–এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

জমাটি চিত্রনাট্য, ধারালো সংলাপ, বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় আর দুর্দান্ত নির্মাণের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ডিপার্টমেন্ট কিউ। এ ধরনের সিরিজে গোয়েন্দারা ব্যক্তিগত ট্রমায় ভোগেন, ক্লিশে এ ব্যাপারটি এ সিরিজেও আছে। তবে কার্ল চরিত্রটি এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যে বহুল চর্চিত ট্রমাও আপনার কাছে বিরক্তিকর লাগবে না। দুই দশকে ব্রাইডশেড রিভিজিটেড, ডাউনটন অ্যাবি থেকে দ্য ক্রাউন-এর মতো ড্রামা সিরিজে পাওয়া গেছে ম্যাথু গুডকে। এবার যেন তিনি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। ডার্ক সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারে তিনি সুযোগ পেলেন ব্যতিক্রমী এক চরিত্রে। সিরিজে কার্ল চরিত্রের অভিব্যক্তি, সংলাপ বলা, অসহায়ত্ব দারুণ দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন গুড। কার্ল হতাশায় ভোগেন, সহকর্মীকে হারানোর জন্য অপরাধবোধও তাঁকে তাড়া করে, কিন্তু সেটা কাউকে বুঝতে দেন না। ধারালো ও বিদ্রূপাত্মক তুখোড় সংলাপের আড়ালে নিজের অসহায়ত্বকেই লুকাতে চান তিনি।

বাকি চরিত্রগুলোর অভিনেতারাও ঠিকঠাক। প্রাণবন্ত, ভোজনরসিক রোজ ডিকসনের চরিত্রে লিয়া বায়ার্ন, নিখোঁজ আইনজীবী মেরিট লিংগার্ডের চরিত্রে ক্লোয়ে পেরিও ভালো। এ ধরনের সিরিজে প্রধান গোয়েন্দা আর তাঁর সহকারীর সম্পর্কের খুনসুটি হয়ে ওঠে উপভোগ্য। এ সিরিজে কার্ল আর আকরামের মধ্যে সেটা ভালোভাবেই করেছেন নির্মাতারা। আকরাম যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে পালিয়ে এসেছেন, অভিবাসনপ্রত্যাশী। তাঁর চরিত্রটি দিয়ে ইউরোপের শরণার্থী পরিস্থিতিও তুলে ধরেছেন নির্মাতা।

‘ডিপার্টমেন্ট কিউ’–এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

সিরিজটিতে একই সঙ্গে যেমন তীক্ষ্ণ হাস্যরস আছে, তেমনি ফুটে উঠেছে পারস্পরিক সম্পর্ক আর অসহায়ত্ব। হাসপাতালের বিছানায় শোয়া জেমসের সঙ্গে কার্ল আর রোজের দৃশ্য, ১৭ বছর বয়সী সৎসন্তানের সঙ্গে কার্লের সম্পর্ক, মনোবিদের প্রতি কার্লের আকর্ষণের বিষয়গুলো নেহাত ক্রাইম সিরিজ থেকে ডিপার্টমেন্ট কিউ-এর পরিসরকে আরও বড় করে তুলেছে। পাশাপাশি সিরিজটিতে এসেছে ব্যাড প্যারেন্টিং, গ্রামীণ নিঃসঙ্গতা, শহুরে নির্মমতা আর পুলিশ প্রশাসনের নানা দুর্নীতি ও অদক্ষতা।

সিরিজের পটভূমি ডেনমার্কের কোপেনহেগেন থেকে স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় নিয়ে এসেছেন নির্মাতা। এডিনবরা এখানে আলাদা একটা চরিত্র হয়ে হাজির হয়েছে। মাটির নিচের বেজমেন্ট, ধূসর আকাশ, পাথরের রাস্তা—সব মিলিয়ে এক চমৎকার ভিজ্যুয়াল আবহ তৈরি হয়েছে, সিরিজটির মেজাজের সঙ্গে যা পুরোপুরি মানিয়ে গেছে।

‘ডিপার্টমেন্ট কিউ’–এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

পুরো সিরিজেই রয়েছে নিখুঁত যত্নের ছাপ। তবে সিরিজটি মাঝেমধ্যেই গতিমন্থরতায় ভুগেছে। শেষের দিকে মনে হয়েছে, পর্ব ৯টি না হলেও হতো। শেষ দৃশ্যটিও বেশ সাদামাটা, বেশ আগে থেকেই অনুমান করা যায়, কী হতে চলেছে।

‘ডিপার্টমেন্ট কিউ’ সিরিজের আরও অনেকগুলো উপন্যাস রয়েছে। জমাটি প্রথম মৌসুমের পর তাই দ্বিতীয় কিস্তির অপেক্ষা করাই যায়।

‘ডিপার্টমেন্ট কিউ’–এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স