‘কে-পপ ডেমন হান্টার্স’–এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স
‘কে-পপ ডেমন হান্টার্স’–এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

২৩ কোটি ৬০ লাখ ভিউ! কী আছে এই সিনেমায়

কে-পপ নিয়ে দুনিয়াজড়ে মাতামাতি, তবে কাল্পনিক দুই ব্যান্ডের গল্প যে এভাবে ঝড় তুলবে, কে জানত। মুক্তির পর নেটফ্লিক্স আর বিলবোর্ডের অনেক রেকর্ড ভেঙে ‘কে-পপ ডেমন হান্টার্স’ এখন নেটফ্লিক্সের ইতিহাসেরই সবচেয়ে বেশি দেখা সিনেমা। ‘রেড নোটিশ’-এর ২৩ কোটি ৯ লাখ ভিউর রেকর্ড টপকে ২৩ কোটি ৬০ লাখ ভিউ নিয়ে নতুন রেকর্ড গড়েছে মিউজিক্যাল অ্যানিমেশনটি।

যদিও এ সিনেমার ব্যান্ড ও চরিত্রগুলো কাল্পনিক, তবে কে-পপের ভক্তদের একটি অংশ ইতিমধ্যেই ব্যান্ড দুটিকে বাস্তব ব্যান্ড হিসেবেই গ্রহণ করতে শুরু করেছে। তাই হানট্রিক্স ও সাযা বয়েজ এখন আর শুধুই পর্দার চরিত্র নয়, তারা বিশ্বজুড়ে কে-পপ শ্রোতাদের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে।

সবার শীর্ষে
মুক্তির আগে সিনেমাটি নিয়ে সেভাবে আলোচনা ছিল না। কিন্তু গত ২০ জুন মুক্তির পর বিশ্বব্যাপী ‘অপ্রত্যাশিতভাবে’ই হিট হয় ‘কে-পপ ডেমন হান্টার্স’। কেবল কি সিনেমা, গানগুলোও সুপারহিট। চলতি মাসের শুরুতে ছবিটির গান ‘গোল্ডেন’ বিলবোর্ড হট ১০০-এর শীর্ষ স্থান দখল করে। ওটিটিতে মুক্তির দুই মাস পর ১২ আগস্ট সিনেমাটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। সেখানেও ঝড় তুলেছে। সপ্তাহান্তে ছবিটি বক্স অফিস থেকে আনুমানিক ১৮ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। এটিই নেটফ্লিক্সের প্রথম সিনেমা, যা প্রথমে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেয়েও পরে বক্স অফিসের শীর্ষে পৌঁছেছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার প্রায় ১ হাজার ৭০০ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। সনি পিকচার্স অ্যানিমেশনের প্রযোজনায় নির্মিত সিনেমাটি তৈরি হয়েছে ম্যাগি ক্যাংয়ের চিত্রনাট্যে। ক্রিস অ্যাপেলহ্যান্সের সঙ্গে সিনেমাটির সহনির্মাতাও তিনি। এই কোরিয়ান-কানাডিয়ান নির্মাতা বলছেন, সিনেমাটি নিয়ে এত সাড়া পেয়ে তাঁরা আপ্লুত। নির্মাণের আগে থেকেই তাঁরা চেয়েছিলেন এমন কিছু করতে, যা নিয়ে ভক্তদের মধ্যে তোলপাড় হবে; তবে স্বপ্ন যে এভাবে সত্যি হবে, সেটা ছিল তাঁদের কল্পনার বাইরে।

কী আছে এই সিনেমায়
গল্পের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে আছে তিন কে-পপ আইডল—রুমি, মিরা ও জোয়ি। তারা ‘হানট্রিক্স’ নামের এক সুপারস্টার গার্ল ব্যান্ডের সদস্য। কিন্তু তাদের এ জীবনের বাইরে আছে এক গোপন পরিচয়। তারা গানের শক্তিকে ব্যবহার করে ডেমনদের মারে।

‘কে-পপ ডেমন হান্টার্স’–এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

কিন্তু ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়, যখন হঠাৎ রুমি গান গাইতে পারে না। হঠাৎ নষ্ট হয়ে যায় তার গানের গলা। ঠিক তখনই আবির্ভূত হয় নতুন এক বয় ব্যান্ড ‘সাযা বয়েজ’। এই ব্যান্ডের সুদর্শন ছেলেদের দেখে রুমি, মিরা, জোয়িও নিজেদের সামলাতে পারে না। কিন্তু সুন্দর চেহারার আড়ালে এই ব্যান্ডের সদস্যরা আসলে ডেমন। এর মধ্যে হানট্রিক্স ব্যান্ডেও ফাটল ধরে। হানট্রিক্স কি পারে সাযা বয়েজকে থামাতে? নাকি তাদের আত্মাও দখল করে নেয় শয়তান? এমন গল্প নিয়েই ‘কে-পপ ডেমন হান্টার্স’।

‘কে-পপ ডেমন হান্টার্স’-এর গানগুলো নিয়ে আলাদাভাবে কথা বলতেই হয়। ১২ গান নিয়ে তৈরি পুরো সিনেমাই যেন এক দারুণ উপভোগ্য ‘মিউজিক্যাল জার্নি’। এ কারণেই সিনেমার বাইরে গিয়েও বিশ্বব্যাপী আলোচিত এখন এর সাউন্ডট্র্যাক। বিশেষ করে এ সিনেমার দুটি প্রধান গান ‘গোল্ডেন’ ও ‘ইয়োর আইডল’ এখন বিশ্বজুড়ে সংগীতপ্রেমীদের মুখে মুখে। ‘গোল্ডেন’ জুলাই মাসে স্পটিফাইয়ের গ্লোবাল ডেইলি চার্টে ১ নম্বরে উঠে আসে। গানটি স্পটিফাইয়ের যুক্তরাষ্ট্র চার্টেও শীর্ষ স্থান দখল করে। বিলবোর্ড জানিয়েছে, এটিই প্রথম কোনো সিনেমার সাউন্ডট্র্যাক, যার একসঙ্গে চারটি গান সেরা দশে জায়গা করে নিয়েছে।

ওপর থেকে দেখলে ‘কে-পপ ডেমন হান্টার্স’কে একটি কাল্পনিক ফ্যান্টাসি সিনেমা ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। কিন্তু সিনেমা যত এগোতে থাকে, শক্তিশালী হাস্যরসাত্মক সংলাপ, কে-পপ দুনিয়ার নানা খুঁটিনাটি, দুর্দান্ত সব গান আর কোরীয় লোকগল্পের সঙ্গে কল্পবিজ্ঞানের মিশেল চোখে পড়ে। দুই নির্মাতা ক্রিস অ্যাপেলহ্যান্স ও ম্যাগি ক্যাংয়ের শ্রম সব বয়সী দর্শকের কাছে সিনেমাটি করে তুলেছে দারুণ উপভোগ্য। সিনেমাটি দিয়ে আসলে কোরীয় কমিকস, কার্টুনকে ট্রিবিউট দিয়েছেন তাঁরা।

কোরিয়ান লোককথা অনুযায়ী, একটি প্রাচীন সংগীতচর্চা রয়েছে, যা দিয়ে অতিপ্রাকৃত শক্তিকে পরাজিত করা যায়। সিনেমাতে এ গল্পকেই আধুনিক কে-পপ গানের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সাযা বয়েজের সদস্যদের দেখার পর হানট্রিক্সের নারী সদস্যদের মনে যখন ‘লাড্ডু ফুটতে থাকে’, তা দেখে জেন-জি আর আলফা প্রজন্মের কে-পপ ক্রেজ সম্পর্কে ধারণা মেলে। এ সিনেমায় হিংসা রক্তাক্ত নয়; বরং চোখজুড়ানো। হানট্রিক্স যখন দৈত্যদের মারে, তখন তারা ছিন্নবিচ্ছিন্ন না হয়ে কনফেত্তির মতো বিস্ফোরিত হয়।

‘কে-পপ ডেমন হান্টার্স’–এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

গানের জাদু
‘কে-পপ ডেমন হান্টার্স’-এর গানগুলো নিয়ে আলাদাভাবে কথা বলতেই হয়। ১২ গান নিয়ে তৈরি পুরো সিনেমাই যেন এক দারুণ উপভোগ্য ‘মিউজিক্যাল জার্নি’। এ কারণেই সিনেমার বাইরে গিয়েও বিশ্বব্যাপী আলোচিত এখন এর সাউন্ডট্র্যাক। বিশেষ করে এ সিনেমার দুটি প্রধান গান ‘গোল্ডেন’ ও ‘ইয়োর আইডল’ এখন বিশ্বজুড়ে সংগীতপ্রেমীদের মুখে মুখে। ‘গোল্ডেন’ জুলাই মাসে স্পটিফাইয়ের গ্লোবাল ডেইলি চার্টে ১ নম্বরে উঠে আসে। গানটি স্পটিফাইয়ের যুক্তরাষ্ট্র চার্টেও শীর্ষ স্থান দখল করে। বিলবোর্ড জানিয়েছে, এটিই প্রথম কোনো সিনেমার সাউন্ডট্র্যাক, যার একসঙ্গে চারটি গান সেরা দশে জায়গা করে নিয়েছে।

যদিও এ সিনেমার ব্যান্ড ও চরিত্রগুলো কাল্পনিক, তবে কে-পপের ভক্তদের একটি অংশ ইতিমধ্যেই ব্যান্ড দুটিকে বাস্তব ব্যান্ড হিসেবেই গ্রহণ করতে শুরু করেছে। তাই হানট্রিক্স ও সাযা বয়েজ এখন আর শুধুই পর্দার চরিত্র নয়, তারা বিশ্বজুড়ে কে-পপ শ্রোতাদের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে।

ভক্ত-তারকার সম্পর্ক বিনোদন–দুনিয়ার সবচেয়ে অনন্য অভিজ্ঞতা। তাই ছবির চূড়ান্ত মুহূর্তে ভক্তদেরই সমাধানের অংশ বানানো হয়েছে; তাঁদের চিৎকার ও সংগীতই এখানে শক্তির উৎস।
ম্যাগি কাং

‘হানট্রিক্স’ ব্যান্ডের গানগুলো গেয়েছেন ইজে, অড্রে নুনা ও রেই। আর ‘সাযা বয়েজ’-এর গান গেয়েছেন অ্যান্ড্রু চোই, কেভিন উ ও স্যামুয়েল লি। যদিও চরিত্রগুলো কাল্পনিক, তবে কে-পপের ভক্তদের একটি অংশ ইতিমধ্যেই ব্যান্ড দুটিকে বাস্তব ব্যান্ড হিসেবেই গ্রহণ করতে শুরু করেছে।

‘কে-পপ ডেমন হান্টার্স’–এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

টিকটক, ইনস্টাগ্রাম রিলস, ইউটিউব শর্টসে লাখো ভক্ত ‘গোল্ডেন’ ও ‘ইয়োর আইডল’ গানগুলোর ড্যান্স চ্যালেঞ্জে অংশ নিচ্ছেন। সিনেমার গানগুলো প্রযোজনা টিমে ছিলেন ব্ল্যাকপিঙ্কের সঙ্গে কাজ করা টেডি পার্ক ও বিটিএসের সহযোগী লিন্ডগ্রেন। তাই এর সাফল্য একেবারে অপ্রত্যাশিত নয় বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

কেন আলাদা
মার্কিন প্রযোজনা হলেও চলচ্চিত্রটি যেভাবে কোরীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছে, সেটিকেও বিশ্বব্যাপী এর গ্রহণযোগ্যতার একটা বড় কারণ বলে মনে করেন জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম টক টু মি ইন কোরিয়ানের সহপ্রতিষ্ঠাতা হিউন-উ সন। তাঁর ভাষ্যে, ‘এতে অনেক সূক্ষ্ম খুঁটিনাটি রাখা হয়েছে। কোরীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে যাঁরা ধারণা রাখেন, তাঁরা সহজেই এটা বুঝতে পারবেন।’ উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘যেভাবে শিল্পীদের কোরিয়ান ভাষায় সংলাপ বলার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, এমনকি একটি প্রাইভেট জেটের দৃশ্যে রাখা হালকা সবুজ থালাবাসনও রাখা হয়েছে, সবই কোরিয়ানদের খুব চেনা। এই সূক্ষ্ম বিষয়গুলো দেখলে বোঝা যায়, নির্মাতারা তাঁদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ঢেলে দিয়েছেন গল্পে।’

‘কে-পপ ডেমন হান্টার্স’–এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

গায়িকা ইজে মনে করেন, চলচ্চিত্রের পটভূমি কোরিয়া হলেও বার্তা বিশ্বজনীন। তাঁর ভাষ্যে, ‘সিনেমায় কে-পপ বিষয়টিকে খোলস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, আসল কথাটা হলো নিজেকে ভালোবাসা।নিজের ভুলত্রুটি মেনে নিয়ে সৌন্দর্যটা খুঁজে নেওয়া। এই সিনেমা মনে করিয়ে দেয়, আপনি একা নন; প্রিয়জনের ওপর ভরসা করাটা দুর্বলতা নয়।’

প্রযোজক অ্যাপেলহ্যান্স জানান, তাঁরা জানতেন দর্শক নতুনত্ব খোঁজে। সিনেমাটিতে সেটাই দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

‘কে-পপ ডেমন হান্টার্স’–এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

চলচ্চিত্রের মূল শক্তি কেবল ভিজ্যুয়াল বা গান নয়; বরং কে-পপ নিয়ে বিশ্বজুড়ে মাতামাতির প্রতিফলন এখানে আছে। সহপরিচালক কাংয়ের মতে, ‘ভক্ত-তারকার সম্পর্ক বিনোদন–দুনিয়ার সবচেয়ে অনন্য অভিজ্ঞতা। তাই ছবির চূড়ান্ত মুহূর্তে ভক্তদেরই সমাধানের অংশ বানানো হয়েছে; তাঁদের চিৎকার ও সংগীতই এখানে শক্তির উৎস।’
সিনেমার ইতিবাচক বার্তাও পছন্দ করেছেন দর্শক। গায়িকা ইজে বলেন, ‘আজকের পপ বা কে–পপ গানগুলোয় আশার কথা তেমন থাকে না। “গোল্ডেন” গানটি সবাইকে আত্মবিশ্বাসের রসদ জোগায়।’

তথ্যসূত্র: টাইম, বিবিসি