‘স্ট্র’ সিনেমার দৃশ্য। নেটফ্লিক্স
‘স্ট্র’ সিনেমার দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

রিভিউ

যে মায়ের সংগ্রাম কাঁদতে বাধ্য করবে

একজন একা মা, সন্তান অসুস্থ। সন্তানের চিকিৎসার খরচ জোগাতে হিমশিম খান। দুটি চাকরি করেও মেটাতে পারছেন না সংসারের খরচ। বাসাভাড়া বাকি, বাড়িওয়ালা প্রতিদিন হুমকি দেন ঘর থেকে বের করে দেবেন। সাহায্য করার মতো পাশে কেউ নেই। তার ওপর গায়ের রঙের কারণে হতে হয় বর্ণবাদের শিকার। মেয়ের স্কুলের টিফিনের জন্য মাত্র ৪০ ডলারও দিতে পারেন না তিনি। তা নিয়ে ছোট্ট মেয়েকে কথা শুনতে হয়। সকালে স্কুলে মেয়েকে পৌঁছে দেওয়ার সময় মা বলেন, আজকেই তিনি স্কুল টিচারকে টাকাটা দিয়ে দেবেন।

একনজরেসিনেমা: ‘স্ট্র’পরিচালক: টেইলর পেরিগল্প ও চিত্রনাট্য: টেইলর পেরিস্ট্রিমিং: নেটফ্লিক্সধরন: সাইকোলজিক্যাল ড্রামা, থ্রিলাররানটাইম: ১ ঘণ্টা ৪৮ মিনিটঅভিনয়: তারাজি পি. হেনসন, টেয়ানা টেইলর, শেরি শেপার্ড

মেয়ের কাছে এমন এক প্রতিজ্ঞা করে সুপারশপে কাজে যান মা জানিয়া (তারাজি পি. হেনসন)। কিন্তু একের পর এক দুর্ঘটনা বিধ্বস্ত করে দিতে থাকে তাঁকে। আপনার চিন্তাশক্তির মধ্যে একটা দিন যতটা খারাপ হওয়া সম্ভব, তার থেকেও বেশি ঘটনা ঘটতে থাকে জানিয়ার সঙ্গে। প্রথমে মেয়ের স্কুল থেকে ফোন আসে। স্কুলে রওনা দিলেও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজে পৌঁছাতে হবে। তাই জোরে গাড়ি চালাতে গেলে অতিরিক্ত গতির কারণে পুলিশ জরিমানা করে। অথচ জানিয়া একেবারেই কপর্দকশূন্য।

বাসাভাড়া আর মেয়ের স্কুলের খাবারের টাকা দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করে আছে বেতন পাওয়ার। কিন্তু সে বেতন পাওয়া নিয়েও সমস্যা সৃষ্টি হয়। অজান্তে ঘটে যায় দুর্ঘটনা। একের পর এক হৃদয়বিদারক আর রুদ্ধশ্বাসকর ঘটনার পর জানিয়ার যখন সংবিৎ ফিরে আসে তখন তিনি দেখেন, সবাই তাঁকে ভয় পাচ্ছে। নিজের অজান্তেই তিনি হয়ে উঠেছেন এক ভয়ংকর অপরাধী।

‘স্ট্র’ সিনেমার দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

কিন্তু জানিয়ার চিন্তাজুড়ে আছে তাঁর ছোট্ট মেয়ে। তাকে দেখার মতো এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। জানিয়া কি পারেন তাঁর মেয়ের কাছে ফিরে যেতে? নাকি এর চেয়ে ভয়াবহ এক সত্য এসে নাড়া দিয়ে যায়?
এক মায়ের এক দিনের সংগ্রামের কাহিনিই দেখানো হয়েছে ‘স্ট্র’ সিনেমাতে। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সে গত ৬ জুন সিনেমাটি মুক্তি পায়। এই একই দিনে বিশ্বজুড়ে নেটফ্লিক্সে আরও ১৮টি সিনেমা মুক্তি পায়। কিন্তু মুক্তির এক মাস পেরিয়ে গেলেও সিনেমাটি নেটফ্লিক্সের ‘গ্লোবাল টপ টেন’ তালিকায় তৃতীয় স্থানে আছে। এক মাসের বেশি সময় পরও সিনেমাটি যেভাবে শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছে। তাতেই বোঝা যায়, সিনেমাটি কেমন সমাদৃত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী।

এই সিনেমার নির্মাতা টেইলর পেরি। তিনি একই সঙ্গে সিনেমাটির লেখক, চিত্রনাট্যকার ও প্রযোজকও। পেরি মূলত আফ্রিকান-আমেরিকান সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে সিনেমা ও টিভি শো বানান। মাঝখানে ‘আর জ্যাজম্যানস ব্লুজ’, ‘দ্য সিক্স ট্রিপল এইট’ দিয়ে কিছুটা ইতিহাস-নির্ভর কাজ করলেও কিন্তু ‘স্ট্র’ দিয়ে তিনি আবার ফিরে এসেছেন তাঁর পরিচিত মেলোড্রামার ঘরে। ‘স্ট্র’ দেখতে দেখতে ২০০২ সালে মুক্তি পাওয়া নিক ক্যাসাভেটসের ‘জন কিউ’-এর কথাও মনে পড়তে পারে, যেখানে ডেনজেল ওয়াশিংটন অভিনীত অসুস্থ ছেলের জীবন বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে একটি হাসপাতালের জরুরি বিভাগকে জিম্মি করে। দুই সিনেমার মূল সুর এক হলেও ‘স্ট্র’তে অনেক নতুনত্ব যোগ করেছেন নির্মাতা।

‘স্ট্র’ সিনেমার দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

টেইলর পেরি নিজের কাজের জন্য প্রায়ই সমালোচিত হলেও বক্স অফিসে তাঁর সফলতা চোখে পড়ার মতো। ‘স্ট্র’ সিনেমার সাফল্য তাঁর ক্যারিয়ারে আরেকটি মুকুট যোগ করল।

সিনেমায় সিঙ্গেল মাদার জানিয়া চরিত্রে অভিনয় করেছেন তারাজি পি. হেনসন। এ সিনেমায় তিনি তাঁর ক্যারিয়ারের সেরাটা দিয়েছেন বললে ভুল বলা হবে না। একজন সংগ্রামী অথচ এক ক্লান্ত, বিষণ্ন মায়ের চরিত্রের আবেগের ওঠা-নামা তিনি যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তা অনবদ্য। তিনি এ চরিত্রের মাধ্যমে দর্শকদের মধ্যে এতটাই ছাপ ফেলেছেন যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁকে অস্কারে মনোনীত করার দাবি উঠেছে।

‘স্ট্র’ সিনেমার দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

গোয়েন্দা চরিত্রে তিয়ানা টেইলরও ভালো করেছেন। এ ছাড়া ব্যাংক কর্মকর্তা হিসেবে শেরি শেপার্ডের অভিনয় নজর কেড়েছে আলাদাভাবে। তিনি যেভাবে শান্ত, দায়িত্বশীল, সহমর্মী আচরণ ফুটিয়ে তুলেছেন, তা গল্পটাকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে।
‘স্ট্র’ সিনেমাটির নির্মাণ আঁটসাঁট। এখানে একের পর এক ঘটনা দ্রুত ঘটতে থাকে। সহজেই বোঝা যায়। তবে একটার থেকে আরেকটা হৃদয়বিদারক ঘটনা উপস্থাপন করে যাওয়া কিছুটা অতিরঞ্জিত মনে হয়। তবে নির্মাণের গুণে গল্প কখনো একঘেয়ে লাগে না। এখানে বর্ণবাদ, গরিব লোকদের অপরাধী ভাবার প্রবণতা, ব্যাংকিং খাত ও সমাজের ভেতরের নানা সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে। তবে আপনার মনে হতে পারে, একজন নারীর ওপর পৃথিবীর সব দুঃখ চাপিয়ে না দিলেও পারতেন নির্মাতা।

সন্তানের জন্য একটা মা কত দূর পর্যন্ত যেতে পারেন, ‘স্ট্র’ সিনেমা সেটা তুলে ধরেছে। যদিও ‘স্ট্র’ আমাদের দেশের পটভূমিতে নির্মিত নয়, তবু জানিয়ার লড়াইয়ের সঙ্গে আপনি প্রতিটা মুহূর্তে নিজেকে মেলাতে পারবেন। তবে দুঃখের গল্প থেকে দূরে থাকতে চাইলে এ সিনেমা না দেখাই ভালো। কারণ, শেষটা আপনাকে কাঁদতে বাধ্য করবে।