
হরর, অ্যাডভেঞ্চার, রহস্য আর একদল কিশোর-কিশোরীর গল্প নিয়ে নির্মিত সিরিজটি মুক্তির পরই ঝড় তুলেছিল সারা দুনিয়ায়। আশির দশকের প্রেক্ষাপটে নির্মিত সিরিজটি যে এ সময়ের তরুণদের পর্দায় বুঁদ করে রাখবে, কে ভেবেছিল! এরপর পেরিয়ে গেছে ৯ বছর, সময়ের সঙ্গে ইতিহাস তৈরি করেছে। ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’ হয়ে উঠেছে গত এক দশকে পপ কালচারে সবচেয়ে চর্চিত নামগুলোর একটি। গত মাসেই এসেছে সিরিজটির পঞ্চম ও শেষ মৌসুমের প্রথম কিস্তি। চলচ্চিত্র–বিষয়ক মার্কিন গণমাধ্যম ভ্যারাইটি জানিয়েছে, বিশ্বজুড়ে ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’–এর এই বিপুল জনপ্রিয়তায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে যোগ হয়েছে ১৪০ কোটি ডলার!
নতুন রেকর্ড
৯ বছরের দীর্ঘ পথচলা শেষে ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’ শেষের পথে। ৩১ ডিসেম্বর রাতে মুক্তি পাওয়ার কথা সিরিজটির চূড়ান্ত পর্ব। এ সময়ে দাঁড়িয়ে গত এক দশকে জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে সিরিজটির প্রভাব উপেক্ষা করা কঠিন। শেষ পর্ব মুক্তির আগেই পঞ্চম ও শেষ মৌসুম দর্শকসংখ্যার নতুন রেকর্ড গড়ে ফেলে।
এরপর মুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই এটি ইংরেজি ভাষার কোনো সিরিজ হিসেবে নেটফ্লিক্সের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ওপেনিং সপ্তাহের রেকর্ড গড়ে। এখন পঞ্চম মৌসুমের প্রথম কিস্তি এক মাসের কম সময়ের মধ্যে ১২০ কোটি ভিউ অতিক্রম করেছে।
এ পরিসংখ্যান নির্ণয় করা হয়েছে সিরিজটির যেকোনো অংশ যত সময় স্ট্রিম হয়েছে, সেই মোট সময়কে সব পর্বের মোট রানটাইম দিয়ে ভাগ করে। এই হিসাবে নেটফ্লিক্সের ইতিহাসে কোনো সিরিজই ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’-কে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি, এমনকি ‘ওয়েডনেসডে’ বা ‘স্কুইড গেম’ও নয়। যদিও একক মৌসুম হিসেবে ‘ওয়েডনেসডে’ ও ‘স্কুইড গেম’-এর কিছু মৌসুম কিছুটা এগিয়ে রয়েছে। তবু সামগ্রিক হিসাবে ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’ এগিয়ে।
পঞ্চম মৌসুম এর মধ্যেই ৯৩টি দেশের মধ্যে ৯০টি দেশে সপ্তাহের সর্বাধিক দেখা কনটেন্ট হয়েছে। একই সঙ্গে এটি দর্শকদের আগের মৌসুমগুলোতেও ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’ ছিল নেটফ্লিক্সের প্রথম সিরিজ, যার একসঙ্গে চারটি মৌসুম টপ টেনে ছিল। পরে এটি পাঁচটি মৌসুম নিয়েই টপ টেনে থাকা প্রথম সিরিজে পরিণত হয়। পঞ্চম মৌসুম মুক্তির চার সপ্তাহ পরও পাঁচটি মৌসুমই তালিকায় রয়েছে।
২০২২ সালে মুক্তি পাওয়া সিরিজটির পঞ্চম মৌসুম এখনো নেটফ্লিক্সের সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় ইংরেজি ভাষার টিভি শোগুলোর তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। ছয় বছরের বেশি পুরোনো তৃতীয় মৌসুম সম্প্রতি সেই তালিকা থেকে বাদ পড়েছে।
সবচেয়ে বেশি আবার দেখা দৃশ্য
সিরিজটির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আবার দেখা দৃশ্যগুলোর বেশির ভাগই এসেছে তৃতীয় ও চতুর্থ মৌসুম থেকে। প্রথম স্থানে রয়েছে চতুর্থ মৌসুমের সপ্তম পর্বের ন্যান্সি (নাটালিয়া ডায়ার) ও ভেকনারের (জেমি ক্যাম্পবেল বাওয়ার) সেই দৃশ্য।
দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে তৃতীয় মৌসুমের অষ্টম পর্বে ডাস্টিন (গেটেন মাতারাজ্জো) ও সুজির (গ্যাব্রিয়েলা পিজোলো) ‘নেভার এন্ডিং স্টোরি’ গান গাওয়ার দৃশ্য।
পঞ্চম মৌসুমের রেকর্ড
২৬ নভেম্বর মুক্তির পর মাত্র ২৫ দিনে ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস ৫ ভলিউম ১’ অর্জন করেছে ১০ কোটি ২৬ লাখ ভিউ। সব ইঙ্গিত বলছে, আগামী মাসেই এই মৌসুম সর্বকালের ভিউ তালিকায় জায়গা করে নেবে।
নেটফ্লিক্স কোনো সিরিজের চূড়ান্ত পর্ব মুক্তির ৯১ দিন পর্যন্ত ভিউ গণনা করে, অর্থাৎ নববর্ষের রাতে চূড়ান্ত পর্ব মুক্তির পরও তিন মাস ধরে এ মৌসুমের ভিউ বাড়তেই থাকবে। সেই হিসাবে ২০২৬ সালের প্রথম দিকেই এটি ১ নম্বরে পৌঁছানোর জোর সম্ভাবনা রয়েছে।
পঞ্চম মৌসুম মুক্তির পর এ প্রভাব আরও জোরালো হয়েছে। স্পটিফাই জানিয়েছে, ভলিউম ১–এ ব্যবহৃত বেশ কয়েকটি পুরোনো গানের স্ট্রিমিং নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। স্পটিফাই আরও জানিয়েছে, ২০১৬ সালে প্রথম মৌসুম মুক্তির পর থেকে ব্যবহারকারীরা ২ লাখ ৫ হাজার ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’-থিমভিত্তিক প্লেলিস্ট তৈরি করেছেন।
পঞ্চম মৌসুম এর মধ্যেই ৯৩টি দেশের মধ্যে ৯০টি দেশে সপ্তাহের সর্বাধিক দেখা কনটেন্ট হয়েছে। একই সঙ্গে এটি দর্শকদের আগের মৌসুমগুলোতেও ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’ ছিল নেটফ্লিক্সের প্রথম সিরিজ, যার একসঙ্গে চারটি মৌসুম টপ টেনে ছিল। পরে এটি পাঁচটি মৌসুম নিয়েই টপ টেনে থাকা প্রথম সিরিজে পরিণত হয়। পঞ্চম মৌসুম মুক্তির চার সপ্তাহ পরও পাঁচটি মৌসুমই তালিকায় রয়েছে।
২০২১ সালে নেটফ্লিক্স টপ টেন চালুর পর থেকে সিরিজটির পাঁচ মৌসুম মিলিয়ে ৭৮ বার বৈশ্বিক টপ টেনে জায়গা পেয়েছে। ৯৩টি দেশেই কোনো না কোনো সময়ে শীর্ষ ১০–এ ছিল সিরিজটি।
সংগীত ও সংস্কৃতিতে প্রভাব
নেটফ্লিক্সের বাইরেও সিরিজটির প্রভাব ব্যাপক। চতুর্থ মৌসুমে ব্যবহৃত কেট বুশের ‘রানিং আপ দ্যাট হিল’ গানটি মুক্তির ৩৮ বছর পর যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম টপ টেন হিট হয়ে ওঠে। একইভাবে মেটালিকার ‘মাস্টার অব পাপেটস’ গানটি যুক্তরাজ্যের টপ টেনে প্রথমবারের মতো জায়গা করে নেয়।
২০২২ সালে শুরু হওয়া লাইভ ইভেন্ট ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস: দ্য এক্সপেরিয়েন্স’–এর টিকিট বিক্রি হয়েছে ৮ লাখ ৫০ হাজার। পঞ্চম মৌসুমকে ঘিরে ২৩ দেশের ৩২ শহরে আয়োজিত ইভেন্টে অংশ নিয়েছেন ৩ লাখের বেশি ভক্ত।
পঞ্চম মৌসুম মুক্তির পর এ প্রভাব আরও জোরালো হয়েছে। স্পটিফাই জানিয়েছে, ভলিউম ১–এ ব্যবহৃত বেশ কয়েকটি পুরোনো গানের স্ট্রিমিং নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। স্পটিফাই আরও জানিয়েছে, ২০১৬ সালে প্রথম মৌসুম মুক্তির পর থেকে ব্যবহারকারীরা ২ লাখ ৫ হাজার ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’-থিমভিত্তিক প্লেলিস্ট তৈরি করেছেন।
ব্র্যান্ড ও ব্যবসায়িক প্রভাব
১৯৫৬ সাল থেকে বাজারে থাকা ফ্রোজেন ওয়াফেল ব্র্যান্ড ইগো নতুন করে জনপ্রিয়তা পায় সিরিজে ইলেভেন চরিত্রের প্রিয় খাবার হিসেবে দেখানোর পর। নেটফ্লিক্সের দাবি, ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’ মুক্তির পর থেকে ‘ডানজিয়নস অ্যান্ড ড্রাগনস’–এর প্রতি আগ্রহ বেড়েছে ৬৭৩ শতাংশ। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে গেমটির বিক্রি বেড়েছে ৯৬ শতাংশ করে। যদিও এই ফ্র্যাঞ্চাইজি এমনিতেই জনপ্রিয়। তবু এর উত্থানে ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’-এর ভূমিকা বড়।
অর্থনীতিতে অবদান
২০১৬ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’ সৃষ্টি করেছে ৮ হাজারের বেশি চাকরির সুযোগ, যা দেশটির জিডিপিতে যুক্ত করেছে ১৪০ কোটি ডলার। টিভি স্পিন–অফ মুক্তির আগেই ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’ নিজস্ব একটি দুনিয়া গড়ে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রে বই, কমিকসহ বিভিন্ন প্রকাশনা বিক্রি হয়েছে ৩১ লাখের বেশি কপি।
মিলি ববি ব্রাউনের ইনস্টাগ্রাম ফলোয়ার যেখানে শুরুতে ছিল ২১ লাখ, এখন তা ছাড়িয়েছে ৬ কোটি ৮০ লাখ। স্যাডি সিঙ্কের ফলোয়ার ১১ লাখ থেকে বেড়ে হয়েছে ২ কোটি ৬৮ লাখ। অন্যদের ক্ষেত্রেও বৃদ্ধি ছিল চোখে পড়ার মতো।
২০২২ সালে শুরু হওয়া লাইভ ইভেন্ট ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস: দ্য এক্সপেরিয়েন্স’–এর টিকিট বিক্রি হয়েছে ৮ লাখ ৫০ হাজার। পঞ্চম মৌসুমকে ঘিরে ২৩ দেশের ৩২ শহরে আয়োজিত ইভেন্টে অংশ নিয়েছেন ৩ লাখের বেশি ভক্ত।
এর আগেই এক অভূতপূর্ব ঘোষণায় নেটফ্লিক্স জানিয়েছে, ৩১ ডিসেম্বর নববর্ষের রাতে সিরিজের শেষ পর্ব যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হবে।
পুরস্কার ও তারকাদের উত্থান
ওয়েস্ট এন্ড ও ব্রডওয়েতে মঞ্চস্থ প্রিকুয়েল নাটক ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস: দ্য ফার্স্ট শ্যাডো’ জিতেছে চারটি টনি, দুটি অলিভিয়েসহ একাধিক পুরস্কার। টিভি সিরিজটি এখন পর্যন্ত পেয়েছে ৭০টি পুরস্কার ও ২৩০টি মনোনয়ন, যার মধ্যে ১২টি এমি রয়েছে।
এই সিরিজ অনেকটা ডিজনি চ্যানেলের মতোই কিশোর অভিনেতাদের তারকাখ্যাতির পথে নিয়ে গেছে। মিলি ববি ব্রাউন আজ নেটফ্লিক্সের অন্যতম বড় মুখ। স্যাডি সিঙ্ক, জোসেফ কুইন, মায়া হক, ফিন উলফহার্ড, জো কিরি—সবার ক্যারিয়ারেই এই সিরিজ ছিল বড় টার্নিং পয়েন্ট।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রভাব
মিলি ববি ব্রাউনের ইনস্টাগ্রাম ফলোয়ার যেখানে শুরুতে ছিল ২১ লাখ, এখন তা ছাড়িয়েছে ৬ কোটি ৮০ লাখ। স্যাডি সিঙ্কের ফলোয়ার ১১ লাখ থেকে বেড়ে হয়েছে ২ কোটি ৬৮ লাখ। অন্যদের ক্ষেত্রেও বৃদ্ধি ছিল চোখে পড়ার মতো।
পর্দা, বই, মঞ্চ, সংগীত আর ব্যবসা—সব মিলিয়ে সংখ্যার হিসাবেই প্রমাণিত, ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’ কেন গত এক দশকের পপ কালচারের অন্যতম প্রভাব বিস্তারকারী সিরিজ। এখনো আরও পর্ব মুক্তি বাকি, সেগুলো মুক্তির পর সব রেকর্ডই যে আরও ফুলেফেঁপে উঠবে, সেটা বলাই বাহুল্য।
ভ্যারাইটি অবলম্বনে