প্রযুক্তির ছায়া যখন আমাদের জীবন গ্রাস করছে, তখন সিজন-৭–এ নতুন ঝলক নিয়ে ফিরে এসেছে ‘ব্ল্যাক মিরর’। আগের সিজনগুলোর তুলনায় এবারের গল্পগুলো যতটা প্রযুক্তিনির্ভর, ততটাই মানবিক। এই ভারসাম্য রাখতে গিয়ে সিরিজটির স্রষ্টা চার্লি ব্রুকার ছয়টি এপিসোড যেভাবে সাজিয়েছেন, সেগুলোর মধ্যে দুটির গল্প অনেকটা ‘মাথার ওপর দিয়ে যাওয়ার’ মতো মনে হয়েছে। সবচেয়ে বেশি হতাশ করেছে সিজন-৪-এ জনপ্রিয়তা পাওয়া ‘ইউএসএস ক্যালিস্টার: ইনটু ইনফিনিটি’র সিকুয়েল। বাকি চার পর্বের গল্প, শেষে কী হয়, তা দেখার কৌতূহল তৈরিতে উল্লেখযোগ্যভাবে সফল।
নতুন মৌসুমের শুরুতেই একটি সুখী জীবনের ‘ডিস্টোফিয়া’ বা অন্ধকার ভবিষ্যৎ দেখায় প্রথম এপিসোড—‘কমন পিপল’। যেখানে ক্রিস ও’ডাউড ও রাশিদা জোন্স অভিনয় করেছেন নিম্নমধ্যবিত্ত দম্পতির ভূমিকায়, যাঁদের ঘরে অর্থের চেয়ে ভালোবাসাটাই বেশি। একসময় রাশিদার মস্তিষ্কে টিউমার ধরা পড়ে, যেটির সমাধান নিয়ে হাজির হয় রিভারমাইন্ড নামের একটি প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান। রাশিদার মস্তিষ্ক, স্মৃতিকে একটি ক্লাউড সার্ভারে স্থানান্তর করা হয়, যেটি মাসিক সাবস্ক্রিপশনের মাধ্যমে চলে।
অনেকটা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের মতো এবং এর কমন, প্লাস, আলট্রা-প্রিমিয়াম ভার্সনে আপগ্রেড করার ব্যাপার আছে। যত আপগ্রেড করা হবে, রাশিদার মস্তিষ্ক ততটাই একজন পূর্ণাঙ্গ সুস্থ মানুষের মতো কাজ করবে! গল্পের এই অংশটা খুবই আতঙ্কের।
অসুস্থতা ও চিকিৎসার ব্যাপারগুলোতে আমাদের মন এমনিতেও দুর্বল থাকে। ঠিক এমন একটা আবহ তৈরি করে পরিচালক প্রযুক্তির অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকগুলো এমনভাবে দেখিয়েছেন, যা বাস্তব জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে ভাবতে গেলে একটা অসহায় ও বিষাদময় অনুভূতির তৈরি হয়। যে বিষাদে আমার মনে পড়েছে মহাদেব সাহার ‘মন ভালো নেই’ কবিতার কয়েকটি লাইন। ‘আজ দুঃখ ছুঁয়েছে ঘরবাড়ি/ উদ্যানে উঠেছে ক্যাকটাস্/ কেউ নেই, কড়া নাড়ার মতো কেউ নেই/ শুধু শূন্যতার এই দীর্ঘশ্বাস।’
‘বেত নোয়া’ নামে সিরিজের পরের পর্বটি হাজির হয় দুটি চরিত্রের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই নিয়ে। ফ্রেঞ্চ বাগ্ধারা ‘বেত নোয়া’ দিয়ে আপনি যাকে দুই চোখে দেখতে পারেন না, এমন কাউকে বোঝায়। আপনি চাকরিজীবী হলে এই পর্ব দেখে মজা পেতে পারেন। একসময়কার সহপাঠী ও পরে সহকর্মী হওয়া মারিয়া ও ভেরিটির রেষারেষি দুষ্টু–মিষ্টি অনুভূতির মধ্যে নিয়ে যায়। তবে ‘ব্ল্যাক মিরর’–এর ‘ডিস্টোপিয়ান’ ধাঁচে গল্প বাছাইয়ের প্রচলিত ঢঙের সঙ্গে এপিসোডটির অর্ধেকের বেশি অংশ সাংঘর্ষিক। হতে পারে প্রথম এপিসোডের বিষাদ কাটাতে পরিচালক দর্শককে একটি ভিন্ন স্বাদ দিতে চেয়েছেন। আবার শেষটা যেভাবে করেছেন, তা অতিকাল্পনিক। ক্রিটিক্যালি চিন্তা না করলে আমার কাছে এ পর্বই বেশি উপভোগ্য লেগেছে।
‘হোটেল রিভারি’ নামে তৃতীয় এপিসোডের গল্পটা আমাদের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎকে ইঙ্গিত করে। দৃশ্যায়ন ভিন্ন হলেও থিমের কিছুটা সাদৃশ্য আছে ২০১৩ সালের ‘হার’ সিনেমার সঙ্গে। পরের পর্ব ‘ইউলজি’ আরও বেশি মন ছুঁয়ে যায়। এই মিষ্টি, দুঃখভরা, সাধারণ গল্পে প্রযুক্তির জটিল বিষয়গুলো খুব একটা প্রভাব ফেলে না। প্রধান চরিত্র ফিলিপ (পল জিয়ামাতি) প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে ঘরের কোনায় পড়ে থাকা ছবি, চিঠি আর ক্যাসেটের মাধ্যমে যৌবনের সুখকর দিনগুলোতে ফিরে যেতে চান। আমাদের জীবনে কিছু মুহূর্ত আসে, যখন আমরা ফেলে আসা দিনগুলো স্মরণ করে কারও খুব সাধারণ চাহনিরও ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করি। আবার কোনো গানের মাধ্যমে ফিরে যাই হারানো দিনগুলোতে। ‘ইউলজি’ তেমনি নস্টালজিয়ার অনুভূতিতে নিয়ে যায়, যখন ধূলি জমা বিবর্ণ কোনো ছবিও খুব মূল্যবান মনে হয়। আধুনিক প্রযুক্তির আধিপত্যের মধ্যেও মানুষের পুরোনো কিছুর প্রতি ভালোবাসার পুনর্জন্মই বলা চলে এ পর্বের উপজীব্য।
বাকি দুই পর্বের মধ্যে ‘প্লেথিং’–এর গল্প নব্বইয়ের দশকের একটি গেমের সূত্র ধরে সন্দেহভাজন অপরাধীকে জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু গল্পটা শুরু হতে হতেই শেষ হয়ে যায়। হতে পারে পরের মৌসুমে সিকুয়েলের জন্য এই এপিসোডে দর্শকের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা হয়নি। আবার এ মৌসুমে সিকুয়েল হয়ে আসা ‘ইউএসএস ক্যালিস্টার: ইনটু ইনফিনিটি’ নতুন গল্পের উত্তেজনা দিতে ব্যর্থ। এটি ‘সাই-ফাই’ ভক্তদের জন্য হয়তো মজার, কিন্তু অনভ্যস্তদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে পারে।
সামগ্রিক বিচার:
‘ব্ল্যাক মিরর: সিজন-৭’ মিশ্র অভিজ্ঞতা দেয়। ‘ইউলজি’, ‘কমন পিপল’ ও ‘হোটেল রিভারি’ হৃদয় ছুঁয়ে যায়; ‘বেত নোয়া’ রোমাঞ্চ দেয়; কিন্তু ‘প্লেথিং’ ও ‘ইউএসএস ক্যালিস্টার’ হতাশ করে। নতুন সিজনটি প্রযুক্তির ভয়ংকর দিকের পাশাপাশি মানুষের ভালোবাসা ও কষ্টের গল্প বলে, যা এটিকে আগের চেয়ে বেশি মানবিক করেছে। তবে কিছু পর্ব আরেকটু হালকা ও পূর্ণাঙ্গ হলে এটি আরও উপভোগ্য হতো।
সতর্কতা ও রেটিং:
দর্শকদের মধ্যে যাঁরা প্রযুক্তির অন্ধকার জগৎ ও মানুষের আবেগের মিশ্রণ পছন্দ করেন, তাঁদের জন্য এ মৌসুম একটি চিন্তার খোরাক। তবে সবাইকে মুগ্ধ করার মতো অনুষঙ্গ কম। তাই কিছু গল্পের শক্তি ও সর্বসাধারণের বোধগম্যতার ঘাটতির দিক বিবেচনায় নিয়ে সিরিজটির এবারের মৌসুম ৫–এর মধ্যে ৩.৮ রেটিং পেতেই পারে।
১০ এপ্রিল নেটফ্লিক্সে প্রকাশ পেয়েছে ‘ব্ল্যাক মিরর’–এর সপ্তম মৌসুম।