
চন্দ্রা কোনো সাধারণ নারী নন—এই ধারণাই যেন চলচ্চিত্রের শুরু থেকেই পরিষ্কার করে দেন পরিচালক। শহরের অন্ধকার এক গলিতে, যেখানে সাধারণত পেশিবহুল পুরুষদের আধিপত্য, সেখানে একা দাঁড়িয়ে চন্দ্রা। পার্কিং লটে দুর্ধর্ষ মারপিটে তিনি যেভাবে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করেন, সেটি শুধু দৃশ্যত নয়; ভাবনাতেও নতুন। আশপাশের পুরুষেরা—কেউ প্রতিবেশী, কেউ পথচারী—বিস্ময়ে শুধু বলতে পারে, ‘এই মেয়ে আলাদা।’
একনজরেসিনেমা: ‘লোকাহ চ্যাপ্টার ১: চন্দ্রা’ধরন: সুপারহিরো, অ্যাকশনপরিচালক: ডোমিনিক অরুণঅভিনয়ে: কল্যাণী প্রিয়দর্শন, স্যান্ডি, নাসলেনস্ট্রিমিং: জিও হটস্টারদৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট
বলছিলাম ‘লোকাহ চ্যাপ্টার ওয়ান: চন্দ্রা’র কথা। ২০২১ সালে ‘মিননাল মুরালি’ দিয়ে চমকে দিয়েছিলেন বাসিল জোসেফ। তবে সেই সুপারহিরো সিনেমার কেন্দ্রে ছিলেন পুরুষ চরিত্র (টোভিনো থমাস)। তবে এবার নারীকেন্দ্রিক সুপারহিরো সিনেমা বানিয়ে সব অর্থেই চমকে দিয়েছেন ডোমিনিক অরুণ। মাত্র ৩০ কোটি রুপি বাজেটের সিনেমা আয় করেছে ৩০০ কোটি রুপির বেশি! এটিই এখন সবচেয়ে বেশি আয় করা মালয়ালম সিনেমা। চলতি বছরের ব্যাপক আলোচিত সিনেমাটি এসেছে ওটিটিতে। বাংলাদেশের দর্শকেরাও কথা বলছেন দক্ষিণি সিনেমাটি নিয়ে।
সিনেমায় কাল্যাণী প্রিয়দর্শনের অভিনয় করেছেন চন্দ্রা চরিত্রে; যিনি একই সঙ্গে দেবী, আবার ধ্বংসের দূতও। কেউ তাঁকে পূজা করে, কেউ তাঁকে ভয় পায়। শহরের এক নোংরা অ্যাপার্টমেন্টে সদ্য উঠে আসা এই মালয়ালি নারীকে যতই সাধারণ ভেবে নেওয়া হোক, গল্প যত এগোয়, ততই স্পষ্ট হয়—চন্দ্রা এক রহস্যময় শক্তির ধারক।
অনেক সময় দেখা যায়, ‘সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স’ তৈরি করতে গিয়ে ছবিগুলো কৃত্রিম লাগে। কিন্তু ‘লোকাহ’-এর জগৎ একেবারেই তা নয়। এটি কেবল সুপারহিরো সিনেমা নয়, বরং এক সমৃদ্ধ ইউনিভার্স তৈরির নমুনা। ছবিজুড়ে ‘লাল’ রং যেন চন্দ্রার স্বাক্ষর বয়ে বেড়ায়। কখনো তাঁর চুলে একটুকরো দাগ, কখনো জ্যাকেটের গাঢ় মেরুন, আবার কখনো অ্যাকশনের দৃশ্যে নিওন লাল ধোঁয়ার বিস্ফোরণ। এই রং শুধুই সাজসজ্জা নয়, বরং চন্দ্রার আত্মপরিচয়ের প্রতীক।
ছবির পটভূমি বেঙ্গালুরু —ভারতের এই শহরকে নির্বাচনও একেবারে সচেতন। এখানে ভাষা, সংস্কৃতি, পরিচয়—সবকিছুই মিশে গেছে এক অনন্য বৈচিত্র্যে। একদিকে মালয়ালি সুপারহিরো, অন্যদিকে কন্নড়ের অপরাধ চক্র, সঙ্গে তামিল পুলিশ অফিসার—সবাই এক শহরে মিলেমিশে গল্পের জাল বুনেছে। এই শহর অভিবাসীদের নিঃসঙ্গতাকেও প্রতিফলিত করে, আর চন্দ্রার নিঃসঙ্গতা সেই অনুভূতির প্রতিধ্বনি।
চন্দ্রা উড়তে পারেন, যুদ্ধকৌশলে পটু, দুর্বলদের রক্ষা করেন। কিন্তু তাঁর অতীত? পরিচালক সচেতনভাবেই সেটি গোপন রাখেন। গল্পের মাঝপথে এক সূক্ষ্ম ব্যবধান তৈরি করে ‘ইন্টারভ্যাল’—যেখানে চন্দ্রার অতীত ও বর্তমান মিশে যায় নাটকীয়ভাবে। এখানেই দেখা যায়, লোকাহর মূল সত্তা গভীরভাবে জড়িত কেরালার কিংবদন্তি ও লোককথার সঙ্গে—যেখানে রাজা, যক্ষী, চাঠান ও দেবীরা একত্রে মিশে যায় কল্পনার জগতে। এই মিথ ও বাস্তবের মেলবন্ধনই ছবির সবচেয়ে শক্তিশালী দিক।
চন্দ্রার প্রতিবেশী সানি (নাসলেন) ও ভেনু (চন্দু সালিমকুমার)—এই দুই ‘অকর্মণ্য’ ব্যাচেলর তাঁর জীবনে মজার আবহ এনে দেয়। তাদের ফ্ল্যাটের নোংরা ঘর, পানীয়র বোতল, এক মাতাল অতিথি ও বিড়াল ‘জ্যাঙ্গো’কে ঘিরে তৈরি হয় ছবির মজার মুহূর্তগুলো। চন্দ্রা যখন এই জগতে পা রাখেন, তখন সবকিছু উল্টে যায়—অদ্ভুত, কিন্তু স্নিগ্ধভাবে।
অন্যদিকে, স্যান্ডি অভিনীত নাচিয়াপ্পা গৌড়া, এক নারীবিদ্বেষী পুলিশ অফিসার, যিনি নারী বসের আদেশ শুনে বিরক্ত হন এবং নারীদের নিয়ে কটাক্ষ করেন। সংলাপে কিছুটা কাঠিন্য থাকলেও, চন্দ্রার বিপরীতে তিনি এক কার্যকর প্রতিপক্ষ—চন্দ্রার নারীবাদী প্রতিচ্ছবির সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা এক চরিত্র।
ছবির দ্বিতীয় অধ্যায়ে কিছুটা ভারী। নতুন চরিত্র, সংলাপ দিয়ে পরের কিস্তির পূর্বাভাস দিতেই বেশি মনোযোগী ছিলেন নির্মাতা। তবু এর মধ্যে জ্যাক্স বিজয়ের সুর ও ইয়ানিক বেনের অ্যাকশন কোরিওগ্রাফি ছবির মেজাজ ধরে রাখে। এই যুগলের মেলবন্ধন যেন এক সিম্ফনি—যেখানে বাস্তব ও অ্যানিমেশন মিলেমিশে চন্দ্রাকে ঘিরে রহস্য তৈরি করে। বেন অত্যন্ত সচেতনভাবে কিছু দৃশ্য সরাসরি না দেখিয়ে কল্পনার জায়গা রেখে দেন, ফলে চন্দ্রার শক্তির আভা কখনো পুরোপুরি ধরা পড়ে না—এই অপূর্ণতাই তাঁকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
চন্দ্রা চরিত্রে কল্যাণী প্রিয়দর্শন দারুণ। তাঁর চোখের ভাষায় মিশে আছে দেবীর ক্রোধ ও নারীর নিঃসঙ্গতা। ‘লোকাহ’ কেবল তাঁর সুপারহিরো অভিষেক নয়, বরং দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমায় নারী-নেতৃত্বাধীন অ্যাকশন ঘরানার এক সাহসী সংযোজন। নাসলেনও সানির চরিত্রে প্রাণ এনেছেন। স্যান্ডি মাস্টারের নাচিয়াপ্পা গৌড়া চরিত্রটি আংশিকভাবে কার্যকর হলেও ভয় পাওয়ায় না।
‘লোকাহ’-এর চিত্রনাট্যের আবেগের জায়গাগুলো কিছুটা দুর্বল। চন্দ্রা ও সানির সম্পর্কের শুরুটা মজবুত হলেও পরের ভাগে সেটি গভীরভাবে বিকশিত হয়নি। ভালো সুপারহিরো ছবির জন্য একজন শক্তিশালী প্রতিপক্ষ জরুরি। নাচিয়াপ্পা গৌড়া চরিত্রটি উত্তেজনা তৈরি করতে পারে না। দ্বিতীয়ার্ধে ছবির গতি হঠাৎ কমে যায়। একইভাবে চন্দ্রাকে ঘিরে অনেক পার্শ্বচরিত্র থাকলেও সেগুলো ঠিকভাবে লেখা হয়নি।
ভারতীয় সিনেমা—বিশেষত মালয়ালম ইন্ডাস্ট্রি—এর আগে খুব কমই নারীকে কেন্দ্র করে সুপারহিরো গল্প বলেছে। ‘লোকাহ’ সেই সাহস নিয়েছে এবং বেশির ভাগ জায়গায় সফলও হয়েছে। এখানে গল্পের মূল লক্ষ্য কোনো ভয়ংকর খলনায়কের সঙ্গে লড়াই নয়; বরং এক নতুন জগৎ গড়ে তোলা। পরিচালক ডমিনিক অরুণ সুপারহিরো ঘরানার প্রচলিত ছক ভেঙে এক ‘সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স’ গড়ে তুলতে চেয়েছেন।
কেরালার লোককথা ও দেবদেবীর মিথকে এভাবে আধুনিক সুপারহিরো কাঠামোর মধ্যে যে মিশিয়ে দেওয়া যায়, সেটা কে ভাবতে পেরেছিল।