নারীপ্রধান চরিত্রকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে খুব একটা কাজ দেখা যায় না। গত বছরের শেষে মুক্তি পাওয়া শঙ্খ দাশগুপ্তর ‘প্রিয় মালতী’ ছিল উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। ২০২৪ সালের মাঝামাঝিতে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল ধ্রুব হাসানের ‘ফাতিমা’। নারীপ্রধান এ সিনেমাটি সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বঙ্গতে।
ভিন্নধর্মী এক গল্পের মাধ্যমে তিনি আজকের দিনের এক নারীর সংগ্রামকেই তুলে ধরেননি, পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ের নারীদের সংগ্রামকেও। এ সিনেমায় এভাবে দুটি ভিন্ন সময়ের গল্পের সমন্বয় ঘটেছে। এ যেন গল্পের মধ্যে অন্য এক গল্প!
একনজরেসিনেমা: ‘ফাতিমা’ধরন: ড্রামাচিত্রনাট্য ও পরিচালনা: ধ্রুব হাসানস্ট্রিমিং: বঙ্গরানটাইম: ১ ঘণ্টা ৪৩ মিনিটঅভিনয়: তাসনিয়া ফারিণ, ইয়াশ রোহান, তারিক আনাম খান, মানস বন্দ্যোপাধ্যায়, সুমিত সেনগুপ্ত
ঢাকা শহরে একটা মেয়ের দৈনন্দিন সংগ্রাম দেখানোর মাধ্যমে ‘ফাতিমা’র শুরু। গল্পের প্রধান চরিত্রের নামও ফাতিমা। সে একজন মডেল ও উঠতি অভিনেত্রী। বিদেশ যেতে চায়। নারী হিসেবে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাঁকে। বাড়িওয়ালা বিনা কারণে হেনস্তা করে। একমাত্র আশ্রয় রুমমেট আপু। কিন্তু তিনিও একদিন বাসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
এদিকে ফাতিমা একটি নতুন সিনেমায় অভিনয় করা শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের নারীদের গল্প বলে সেই সিনেমা। সুবর্ণা নামের যে চরিত্রে ফাতিমা মনপ্রাণ দিয়ে অভিনয় করতে থাকে। সুবর্ণার চরিত্রের মধ্যে যেন বাস করতে থাকে সে। কিন্তু সে নতুন করে সব শুরু করতে চাইলেও অতীত তাঁর পিছু ছাড়ে না। একটা সময় ফাতিমা দেখতে পায়, তাঁর জীবনের গল্প আর সুবর্ণার গল্পের কোথাও যেন রয়েছে অদ্ভুত মিল! কী আছে অতীতে, যা তাঁকে এখনো পেছনে টানছে? ফাতিমা কি আটকা পড়ে যায় সে অতীতে?
প্রচলিত গল্পের ধারার বাইরের একটা গল্প ‘ফাতিমা’। প্রথম সিনেমাতেই নিজের ছাপ রাখতে পেরেছেন ধ্রুব হাসান। এ সিনেমার প্রধান চরিত্রে রয়েছেন তাসনিয়া ফারিণ। তবে এ সিনেমা বানানো শুরু হয়েছিল প্রায় আট বছর আগে। ২০১৭ সালে। নানা জটিলতায় তখন সিনেমার কাজ এগোয়নি। পরবর্তী সময়ে ২০২৩ সালে সিনেমার কাজ আবার শুরু হয়। তবে নতুন করে শুটিং করতে গিয়ে বদলে নিতে হয়েছে গল্পের মোড়। সেই সময়ের অভিনেতাদের অনেকেই তখন আর পুরোনো চিত্রনাট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলেন না। তাই পরিচালককে নতুন করে চিত্রনাট্যও লেখতে হয়েছে।
তখনকার ফারিণকে কেউ তেমন চিনতেন না বললেই চলে। কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করা ছাড়া ফারিণ অভিনয়জগতে তেমন পরিচিত ছিলেন না। এ ক্ষেত্রে বলতে হবে, ধ্রুব হাসান শুরুতেই এমন উঠতি এক অভিনেত্রীকে সিনেমাতে কাজ দিয়ে সাহসিকতাই দেখিয়েছেন। ফারিণের অভিনয় সময়ের সঙ্গে পরিণত হলেও সেই সময়ের ফারিণও মানিয়ে গেছেন চরিত্রের সঙ্গে।
কেউ বলে না দিলে আপনি ধরতেই পারবেন না আগের আর পরের ফারিণকে। ছবিতে ফারিণকে নিয়ে নির্মাতা জহুরির পরিচয় দিয়েছেন। আর ফারিণও এ মান রেখেছেন পুরোদমে। কিছু দৃশ্যে ফারিণ এতটাই ভালো অভিনয় করেছেন, সিনেমা শেষ হওয়ার পরেও কিছু দৃশ্যগুলো চোখে লেগে থাকে।
ফারিণের বিপরীতে অভিনয় করেছেন ইয়াশ রোহান। পর্দায় তাঁর উপস্থিতি কম হলেও তাঁর সঙ্গে ফারিণের রসায়ন জমেছিল। বিশেষ করে রোমান্টিক গান ‘শুধু যে তোমার’-এ তাঁদের দেখতে ভালো লেগেছে। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন সংগীতশিল্পী কোনাল। ‘ওরে ও হাওয়া’ নামে আরেকটি গান গেয়েছেন চিরকুট ব্যান্ডের শারমীন সুলতানা সুমী। গান দুটিতে সুর দিয়েছেন পাভেল অরিন।
তা ছাড়া এ সিনেমায় সংগীতশিল্পী পান্থ কানাইকে দেখা গেছে অভিনেতা হিসেবে। তাঁর চরিত্রটি ছোট হলেও তিনি নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছেন। অন্যান্য চরিত্রে তারিক আনাম খান, মানস বন্দ্যোপাধ্যায়, সুমিত সেনগুপ্ত, আয়শা মনিকা, গাউসুল আলম শাওন, রিজভী রিজুও যোগ্য সংগত দিয়েছেন।
‘ফাতিমা’তে দুটি সময়ের গল্প পাশাপাশি এগিয়ে যায়। প্রথম দিকে যদিও এই ব্যাপারটা ধরতে সময় লাগে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গল্প সুন্দরভাবেই এগিয়ে যায়। তবে বেশ কিছু দৃশ্যে অসামঞ্জস্য চোখে পড়েছে কয়েকবার। যখন ফাতিমার অতীতের গল্প দেখানো হচ্ছিল, তখন আগের গল্প নাকি বর্তমান সময়ের গল্প তা বোঝা যাচ্ছিল না। সম্পাদনা আরও ভালো হতে পারত। তবে চিত্রগ্রাহক তুহিন তমিজুলের কথা বলতে হয় আলাদা করে। তাঁর ক্যামেরা গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
দেশে মুক্তির আগে বাইরের বেশ কয়েকটি উৎসব ঘুরে এসেছে ‘ফাতিমা’। প্রিমিয়ার হয় ইরানের ৪২তম ফজর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। সেখানে নিজের অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রী হিসেবে ক্রিস্টাল সিমোর্গ অ্যাওয়ার্ড পান তাসনিয়া ফারিণ। পুরস্কারটি যে বাড়াবাড়ি ছিল না, সিনেমাটি দেখার পর আপনিও এ কথায় একমত হবেন।