‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’–এর বিভিন্ন চরিত্র। কোলাজ
‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’–এর বিভিন্ন চরিত্র। কোলাজ

২০০ বছরের পুরোনো সেই দানব ফিরল পর্দায়, কেমন হলো ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’

তাঁর সিনেমায় দানব থাকে, তবে গিয়ের্মো দেল তোরোর দর্শকমাত্রই জানেন এই দানব হয় অন্য রকম। এই দানব শুধু ভয় দেখায় না, বরং অনেক বেশি মানবিক। ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ দেল তোরোর স্বপ্নের প্রকল্প; বহু বছর ধরে মেরি শেলির উপন্যাসকে পর্দায় নিয়ে আসতে চান তিনি। দুই শ বছরের বেশি সময় আগে লেখা উপন্যাসটি থেকে দুনিয়ার নানা প্রান্তে এন্তার সিনেমা-সিরিজ, কমিকস হয়েছে; তবু দেল তোরো নিজের ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ বানাতে মরিয়া ছিলেন। ‘আমি স্বপ্ন দেখি সর্বকালের সেরা “ফ্রাঙ্কেনস্টাইন” বানাতে পারি, কিন্তু তৈরি করলেই তা শেষ হয়ে যায়। সেটা ভালো হোক বা না হোক; আর স্বপ্ন দেখার সুযোগ নেই। এটাই নির্মাতার ট্র্যাজেডি,’ বহু বছর আগে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি। সেই স্বপ্ন অবশেষে বাস্তব হলো, গত ৭ নভেম্বর নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে গথিক হরর সিনেমার এই ওস্তাদ নির্মাতার ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’।

একনজরেসিনেমা: ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ধরন: গথিক সায়েন্স-ফিকশনপরিচালনা: গিয়ের্মো দেল তোরোঅভিনয়: অস্কার আইজ্যাক, জ্যাকব এলর্ডি, মিয়া গথ, ফেলিক্স কামারার ও ক্রিস্টফ ভালৎজস্ট্রিমিং: নেটফ্লিক্সরানটাইম: ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট

সিনেমাটি তিনটি অংশে বিভক্ত—শুরুর বয়ান, ভিক্টরের গল্প আর মনস্টারের গল্প। একুশ শতকের এই সিনেমা দু শ বছর আগে লেখা মূল গল্পের কাছাকাছি থেকেও নতুনত্ব তৈরি করেছে। মেসি শেলির উপন্যাস ১৮১৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, সিনেমার সময়কাল ১৮৫৭; লেখকের মৃত্যুর কিছু বছর পর। ভিক্টোরিয়ান যুগে গল্পকে স্থান দেওয়ায় তা বর্তমান দর্শকের কাছে পরিচিত প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে।

সিনেমার শুরু হয় আর্কটিক অঞ্চলে, যেখানে স্রষ্টা ও সৃষ্টি একে অপরের শিকার হয়ে চলেছেন। কিন্তু দেল তোরো সেটা যেভাবে দেখিয়েছেন তা কেবল চমকপ্রদ আর ভয়ানকই নয় বরং হৃদয়বিদারক। দেল তোরো মনস্টারকে একধরনের অতিপ্রাকৃত রূপ দিয়েছেন। একটু পরে মনস্টার নিজেই যখন তাঁর জীবনের গল্প বলা শুরু করে; সিনেমা নতুন রূপ পায়।

‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’–এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের (অস্কার আইজ্যাক) শৈশব ছিল সব অর্থেই দুঃস্বপ্নের। সন্তান জন্ম দিতে দিতে গিয়ে মায়ের মৃত্যু আর বাবার (চার্লস ড্যান্স) অত্যাচারে বড় হয় সে। ভিক্টরের বাবা ছিলেন চিকিৎসক। বাবার কঠোর আচরণই ভিক্টরকে প্ররোচিত করে স্রষ্টার বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াতে। বড় হওয়ার পর ভিক্টর যখন এক তরুণ চিকিৎসক; ইলেকট্রিক চার্জের মাধ্যমে মৃতদেহকে জীবিত করে সবাইকে স্তম্ভিত করে দেয়।

ভিক্টরের ছোট ভাই উইলিয়াম (ফেলিক্স কামারার) আর তাঁর বাগ্‌দত্তা এলিজাবেথ (মিয়া গথ) ভিক্টরের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বুঝতে পারে। ভিক্টরের কৃত্রিম মানব প্রকল্পে অর্থায়ন করে বিত্তশালী অস্ত্র নির্মাতা হ্যারল্যান্ডার (ক্রিস্টফ ওয়াল্টজ)। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মৃতদেহের বিভিন্ন অংশ নিয়ে নিজের সৃষ্টিকে জীবন্ত করতে চায় ভিক্টর। একটা সময় সত্যিই প্রাণ পায় ভিক্টরের দানব (জ্যাকব এলর্ডি)। শুরুতে নতুন দুনিয়ার রূপে মুগ্ধ হলেও ক্রমেই দানব বুঝতে পারে সমাজের নিষ্ঠুরতা। বুঝতে পারে, শেকলবন্দী থেকে অত্যাচারের নিয়তি অপেক্ষা করতে তাঁর জন্য।

‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’–এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

অভিনয়ের বিচারে ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’-এ একজন আরেকজনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। দানবের চরিত্রে সংবেদনশীলতা আর অন্তর্নিহিত কোমলতা অদ্ভুত মিশ্রণ ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। একটি দৃশ্যে তিনি যখন ইঁদুরকে ধরে আদর করেন; চোখ ফেরানো যায় না। সদ্যোজাত শিশু, ‘পশু’, মানুষ ও বিপজ্জনক মনস্টারের মিশ্র অভিব্যক্তি—সবই এলর্ডির নৈপুণ্যে ফুটে উঠেছে। তাঁর ত্বক নীলাভ, যেন মৃতদেহের মতোই।

উন্মাদ বৈজ্ঞানিক চরিত্রে অস্কার আইজ্যাকও দারুণ। নিজের সৃষ্টির পেছনে নাছোড়বান্দা মনোভাব, ক্ষোভ, ক্রোধ আর হতাশার দৃশ্যগুলোয় তিনি যথাযথ। আগের সব কাজ বিবেচনায় নিয়েও বলা যায়, পর্দার সেরা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের একজন তিনি। ক্ষোভে ফেটে পড়ার দৃশ্যগুলো ছিল চ্যালেঞ্জিং, কিন্তু আইজ্যাকের পরিমিত অভিনয়ে সেটা অতিরঞ্জিত মনে হয় না।

‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’–এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

ভিক্টরের মেন্টরের চরিত্রে ক্রিস্টফ ওয়াল্টজও চমৎকার। ইদীনিং হরর সিনেমায় নাম কামানো মিয়া গথ দেল তোরোর দুনিয়ায় এসে দারুণভাবে মানিয়ে গেছেন। অনেকে ধরে নিয়েছিলেন, তাঁর অভিনীত এলিজাবেথ বুঝি সেই চেনা, ‘নিখুঁত’ রূপসী হবেন। কিন্তু মুক্তির পর দেখা গেল, তাঁকে ভিন্নভাবে হাজির করেছেন নির্মাতা; মলিন, ধূসর ভিক্টোরিয়ান দুনিয়ায় তাঁর বসবাস। প্রথম আবির্ভাবে তাঁর পোশাকের নীল-সবুজ দীপ্তি উজ্জ্বল নীল গুবরেপোকার খোলসের মতো ঝিলমিল করে।

‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’-এর ভিজ্যুয়াল তাক লাগানো। তামারা ডেভেরেলের সেট ডিজাইন আর কেট হাওলির কস্টিউমও চমকে দেয় বারবার। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের শরীর যেন একত্রিত প্লেটের মতো আর এলিজাবেথের পোশাকে সবুজ দ্বীপগুলো একে অপরের সঙ্গে স্পর্শ করছে।

‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’–এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

সিনেমার প্রতিটি ফ্রেমে দেল তোরোর প্রিয় লাল ও কালো রঙের ব্যবহার আছে। আলেকজান্ডার ডেসপ্লাটের আবহ সংগীতও সিনেমার মেজাজের সঙ্গে মানিয়ে গেছে। ড্যান লাউস্টসেনের ক্যামেরা ভিক্টরের ল্যাব থেকে আর্কটিক অঞ্চলের বিস্তৃত তুষারভূমি আর আগুনের শিখা পর্যন্ত সবকিছুর রং ধারণ করে দর্শকের সামনে জীবন্ত করেছে
তবে সিনেমার মাঝের অংশের কিছু দৃশ্য অতি-বক্তব্যের ভারে ভারী, তখন সিনেমাটি কিছুটা গতি মন্থরতায় ভোগে। অপ্রত্যাশিতভাবে সিজিআইও বেশ দুর্বল, যেমন নেকড়ের দৃশ্যটিকে একেবারেই বাস্তবসম্মত মনে হয় না।

এসব ছোটখাট দুর্বলতা সরিয়ে রাখলে ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ চলতি বছরের অন্যতম সেরা সিনেমা। যেখানে মেরি শেলির উপন্যাসের কাঠামো আছে, কিন্তু রক্ত-মাংস দেল তোরোর। যিনি মানবিকতা আর নৃশংসতা দুটো দারুণভাবে দেখিয়েছেন। তাঁর এই ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ শুধুই হরর নয়; বরং রোমান্স আর ট্র্যাজেডির মিশেলে এক দার্শনিক অন্বেষণ।

‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’–এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

সিনেমায় নির্মাতা দানব আর ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দুজনকেই সহানুভূতিশীলভাবে উপস্থাপন করেছেন। একবার দর্শক ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে, আরেকবার দানবের প্রতি।

আর শেষে আসে সেই অবধারিত প্রশ্ন—ভিক্টর নাকি মনস্টার; কে প্রকৃত দানব?