সত্য ঘটনা পর্দায় তুলে আনতে নীরজ পান্ডের জুড়ি নেই। ‘আ ওয়েডনেসডে!’, ‘স্পেশাল ২৬’, ‘বেবি’র দর্শকমাত্র তা ভালোই জানেন। হালে বড় পর্দায় সেভাবে নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারছেন না, তবে ওটিটিতে ‘স্পেশাল ওপস’, ‘দ্য ফ্রিল্যান্সার’-এর মতো জনপ্রিয় সিরিজে ঠিকই নিজের ছাপ রেখেছেন নীরজ। ২০২২ সালে মুক্তি পাওয়া তাঁর আরেকটি আলোচিত সিরিজ ‘খাকি: দ্য বিহার চ্যাপটার’। সেই সিরিজের পশ্চিমবঙ্গ সংস্করণ ‘খাকি: দ্য বেঙ্গল চ্যাপটার’। সিকুয়েল হলেও দুই কিস্তির গল্পে মিল নেই। তবে দুর্নীতি, অপরাধচক্র আর বেপরোয়া পুলিশের গল্পের দিক থেকে ‘বেঙ্গল চ্যাপটার’–কে আগেরটির আধ্যাত্মিক সিকুয়েল বলা চলে। ২০ মার্চ নেটফ্লিক্সে এসেছে ‘খাকি: দ্য বেঙ্গল চ্যাপটার’। মুক্তির পর থেকেই নানা কারণে আলোচনায় সাত পর্বের সিরিজটি। আদতে কেমন হলো সিরিজটি?
একনজরেসিরিজ: ‘খাকি: দ্য বেঙ্গল চ্যাপটার’ধরন: পলিটিক্যাল ক্রাইম থ্রিলারক্রিয়েটর: নীরজ পান্ডেপরিচালনা: দেবাত্মা মণ্ডল, তুষারকান্তি রায়পর্ব: সাতরানটাইম: ৪০-৫০ মিনিটস্ট্রিমিং: নেটফ্লিক্সঅভিনয়: শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, চিত্রাঙ্গদা সিং, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, জিৎ, শুভাশীষ মুখোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, ঋত্বিক ভৌমিক, আদিল জাফর খান
এককথায় বলতে গেলে ‘খাকি: দ্য বেঙ্গল চ্যাপটার’ চলনসই একটা সিরিজ। প্রতি সপ্তাহে মুক্তি পাওয়া এন্তার সিরিজের মধ্যে বিচার করলে এতে বিশেষ কিছু নেই। অপরাধ আর রাজনীতি নিয়ে দুনিয়ার নানা প্রান্তে সিরিজ হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে এটি তেমন আলাদা কিছু নেই। তবে ‘বেঙ্গল চ্যাপটার’ এ অঞ্চলের মানুষের কাছে আলাদা পশ্চিমবঙ্গ-যোগের কারণেই। ভারতের এই রাজ্যের রাজনীতির খোঁজখবর যাঁরা রাখেন, তাঁরা তাই সিরিজের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে ভালোভাবেই মেলাতে পারবেন।
তার আগে গল্প সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। নির্বাচন এলেই রাজনৈতিক দলগুলোর নড়েচড়ে বসার দৃশ্য খুব চেনা। বিরোধীপক্ষের সব প্রশ্নের জবাব দিতে ঘটতে থাকে একের পর এক পালাবদল। নেতারা হাত ধুয়ে ফেলতে চান সব অপকর্ম থেকে। দলের মধ্যেও ঘটতে থাকে রদবদল। পুলিশ ডিপার্টমেন্ট ত্রস্ত হয়ে ওঠে ওপর থেকে আসা অর্ডারের চাপ সামলাতে।
রেইড, ধরপাকড় আর একের পর এক বের হতে থাকা কুকীর্তি—নির্বাচনী হওয়া বইতে শুরু হলে এসব চলতেই থাকে। সিরিজে এর সবই উঠে এসেছে। নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু করে চলতি শতকের শুরুর দিকের পটভূমিতে নির্মিত হয়েছে সিরিজটি। গল্প শুরু হয় এক বড় রাজনৈতিক নেতার নাতির ভুল অপহরণ নিয়ে। ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসে। কিন্তু রাজ্যে একের পর এক মানুষ অপহৃত হলেও সেসব কেস কখনো সমাধান হয় না। বিরোধী দলের নেত্রীর তীব্র সমালোচনায় এ ঘটনার পর নড়েচড়ে বসেন নেতা আর মন্ত্রীরা। ঘটনার মোড় ঘোরাতে পুলিশ ডিপার্টমেন্টে আনা হয় ‘ক্লিন ইমেজ’-এর পুলিশ অফিসার সপ্তর্ষিকে। তাঁর ওপর দায়িত্ব পড়ে রাজ্যকে ‘জঞ্জালমুক্ত’ করার।
এদিকে দেখা যায় কুখ্যাত গ্যাংস্টার বাঘাকে। পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত অনৈতিক কাজের যে একমাত্র নেতা। তার দুই শাগরেদ সাগর আর রঞ্জিত। তার সব অনৈতিক কাজের পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা বরুণ রায়ের হাত। সবাই সব জানলেও কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খোলে না। রহস্য সমাধান করতে গিয়ে সপ্তর্ষি অকালে মারা পড়ে। তার মৃত্যুর কেস সমাধান করতে ডাক পড়ে এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট অর্জুন মৈত্রর। সে সৎ পুলিশ কর্মকর্তা হলেও রাজনীতিকদের দাবার ঘুঁটি হতে নারাজ। কিন্তু ‘শর্ষের মধ্যে ভূত’ যেখানে, সেখানে কেস সমাধান যে শুধুই আইওয়াশ, তা শিগগিরই বুঝতে পারে অর্জুন। হাত-পা বাঁধা অবস্থাতেও সে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় গোটা সিস্টেমকে। অর্জুন কি পারে এত দিন ধরে চলে আসা চক্রকে ভাঙতে? নাকি রাজনীতির এ নোংরা খেলায় হার মানতে বাধ্য হয় সে?
‘খাকি’–তে নির্মাতা দেখিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের এমন এক সরকারকে, যারা তিন দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আছে। দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকতে থাকতে তাদের বিরুদ্ধে জমা হয়েছে বিস্তর অভিযোগ। রাজ্যের সব ধরনের অপরাধের পেছনে ক্ষমতাসীন দলের হাত আছে; সেটা দেখানো হয়েছে পর্দায়, যা দিয়ে নির্মাতা যে দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় থাকা বামফ্রন্টকে বুঝিয়েছেন, সেটা স্পষ্ট, কেবল নামটাই যা বলেননি। অন্যদিকে দেখানো হয়েছে দুঁদে এক বিরোধীদলীয় নেত্রীকে। সাদামাটাভাবে জীবন কাটান, শাসক দলের সব ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার, যেকোনো পরিস্থিতিতেও মাঠ ছাড়েন না; বোঝাই যাচ্ছে চরিত্রটি লেখা হয়েছে সেই সময়ের বিরোধীদলীয় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা মাথায় রেখে।
সিরিজের চিত্রনাট্য লিখতে বিস্তর গবেষণা করেছে ‘খাকি’ টিম। অপহরণের পর মানুষের অঙ্গ পাচার, পরে মৃতদেহের প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে কঙ্কাল পাচার; সেটা খুঁজতে গিয়ে এক অনুসন্ধানী সাংবাদিকের মৃত্যু—আশি আর নব্বইয়ের দশকের পশ্চিমবঙ্গে এর সবই হয়েছে।
‘খাকি: দ্য বেঙ্গল চ্যাপটার’-এ মোট ৭টি পর্ব। একেকটির দৈর্ঘ্য ৪০ মিনিটেরও বেশি। ছয় ঘণ্টা লম্বা এ সিরিজের শুরুটা একটু ধীর হলেও দুই পর্বের পরেই জমে ওঠে সিরিজটি। অনেকগুলো প্লটের গল্প একসঙ্গে চলতে থাকায় সিরিজটি থেকে চোখ সরানো যায় না। পুলিশ, গুন্ডা আর রাজনীতিবিদদের ত্রিভুজ গল্পের এ প্লট চেনা হলেও গল্পের একের পর এক রোমাঞ্চ টান টান উত্তেজনায় কোনো ভাটা পড়ে না।
‘খাকি: দ্য বেঙ্গল চ্যাপটার’ যেন তারকাদের মেলা। একঝাঁক তারকাকে যেন নতুন করে পরিচয় করালেন নীরজ পান্ডে। শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, চিত্রাঙ্গদা সিং, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, জিৎ, শুভাশীষ মুখোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়—সবাই অনবদ্য। চরিত্রের প্রয়োজনে নিজেদের তাঁরা এমনভাবে ভেঙেছেন, পরিচিত অভিনেতাদের দর্শকেরা চিনছেন নতুন করে।
তবে এই সিরিজে আলাদা করে বলতে হয় ঋত্বিক ভৌমিক, আদিল জাফর খানের কথা। বাঘার ডান আর বাঁ হাত। সাগর চরিত্রের ঋত্বিক ঠান্ডা মাথার, পারিবারিক ছেলে অথচ বেপরোয়া হলে তাঁর মতো নৃশংস আর কেউ নেই। অন্যদিকে রঞ্জিতের মাথা গরম, রেগে গেলে হেন কাজ নেই, যা করতে পারে না। সিরিজের সবচেয়ে বড় চমক হলো সাগর চরিত্রে ঋত্বিকের অভিনয়। কে বলবে অ্যামাজনের তুমুল আলোচিত মিউজিক্যাল সিরিজ ‘ব্যান্ডিটস বন্দিশ’-এ ধ্রুপদি সংগীতশিল্পীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি!
ঝানু রাজনৈতিকের চরিত্রে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় দুর্দান্ত; অনেক দৃশ্যই দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সাংহাই’ সিনেমার প্রসেনজিৎকে মনে করিয়ে দেয়। মুখ্যমন্ত্রীর চরিত্রেও দারুণভাবে মানিয়ে গেছেন শুভাশীষ মুখার্জি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদলে তৈরি বিরোধীদলীয় নেত্রীর চরিত্রে চিত্রাঙ্গদাও যথাযথ। তবে তাঁর চরিত্রটি আরও দীর্ঘ হতে পারত। কিছু কিছু দৃশ্যে তাঁকে দেখে পুরোনো চিত্রাঙ্গদার কথা মনে পড়েছে; সুধীর মিশ্রর ‘হাজারো খোয়াইশে অ্যায়সি’–তে যে চিত্রাঙ্গদাকে পাওয়া গিয়েছিল।
সিরিজে প্রসেনজিৎ-জিৎ দ্বৈরথও বেশ উপভোগ্য ছিল। তুখোড় পুলিশ অফিসারের ভূমিকায় জিৎ ছিলেন অনবদ্য।
এদিকে প্রচলিত চরিত্রের বাইরে গিয়ে রং বদলানো রাজনৈতিক নেতা আর ঠান্ডা মাথায় অপরাধ জগৎ চালানো এক লিডার হিসেবে যেন এক নতুন প্রসেনজিৎকে দেখা যায়। অ্যাকশন দৃশ্যেও তিনি দুর্দান্ত তবে স্ত্রীর সঙ্গে আবেগের দৃশ্যে জিৎ ছিলেন একেবারেই গড়পড়তা। জিৎ যখনই নীরজ পান্ডের সঙ্গে কাজ করেন, নতুন কিছু হয়। এর আগে নীরজের লেখা ও প্রযোজিত বাংলা সিনেমা ‘দ্য রয়েল বেঙ্গল টাইগার’-এ ভিন্ন জিৎকে পাওয়া গিয়েছিল, এবার নতুনভাবে হাজির হলেন তিনি।
‘খাকি: দ্য বেঙ্গল চ্যাপটার’ পুরোপুরি বাণিজ্যিক ঘরানার কাজ। কলকাতার অপরাধ জগৎ নিয়ে ‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী’–তে দিবাকর যে ডার্ক আবহ তৈরি করেছিলেন, এখানে সেটা নেই। এই সিরিজের সবকিছুই ঝাঁ–চকচকে। ‘খাকি’ খুবই দ্রুত গতির সিরিজ, প্রায় সব দৃশ্যের দৈর্ঘ্য ৫ থেকে ১০ সেকেন্ড করে; বোঝাই যায় রিলস আর শর্টসে বুঁদ তরুণ প্রজন্মের কথা ভেবে বানানো হয়েছে সিরিজটি। ‘খাকি’ আপনাকে ভাবাবে না, নির্মাতাদের উদ্দেশ্যও সেটা ছিল না। সিরিজের সবকিছুই চামচ দিয়ে খাওয়ানোর মতো করে গুলে খাইয়ে দিয়েছেন নির্মাতা, দর্শকদের আলাদা করে ভাবার কষ্ট করতে হবে না। সিনেমাটোগ্রাফিও মোটামুটি, শহরকে এখানে আলাদা চরিত্র হিসেবে হাজির করার চেষ্টা নেই। সে সময়ও অবশ্য ছিল না, কিছু বুঝে ওঠার আগেই একের পর এক ঘটনা ঘটে; এত এত জাম্প কাট; শান্ত হয়ে বসাই মুশকিল।
পশ্চিমবঙ্গর রাজনীতি, অ্যাকশন, অভিনয় আর পরতে পরতে রোমাঞ্চ মিলিয়ে ছয় ঘণ্টার বেশি দৈর্ঘ্যের ‘খাকি: দ্য বেঙ্গল চ্যাপটার’ একবার দেখাই যায়!