
প্রিয়জনের সঙ্গে লং ড্রাইভে গেছেন, ঘুরতে ঘুরতে কোনো জায়গা দেখে ভালো লাগল। গাড়ি থামিয়ে হয়তো একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন। কিন্তু আপনি তখনো জানেন না, কাছেপিঠে কোথায় ওত পেতে আছে ভয়ংকর এক আততায়ী। গাড়িতে থাকা প্রেমিক যুগলদের যে বেছে বেছে হত্যা করে। দুনিয়ার নানা প্রান্তে রহস্যময় সব খুনের ঘটনা ঘটেছে, জানা গেছে কুখ্যাত সব ক্রমিক খুনির কথা। হালে এসব মীমাসিংত ও অমীমাংসিত ঘটনা নিয়ে তৈরি হচ্ছে তথ্যচিত্র। গত ২২ অক্টোবর নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে সত্য ঘটনা অবলম্বনে তেমনই একটি সিরিজ ‘দ্য মনস্টার অব ফ্লোরেন্স’। যে সিরিজের পটভূমি আজ থেকে পঞ্চাশ বছরেরও আগে। কী ঘটেছিল তখন? সিরিজটিতেই–বা কী দেখানো হয়েছে?
রহস্যময় এক খুনি
১৯৬৮ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে ইতালির ফ্লোরেন্স ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ভয়ংকর কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। এক অজানা হত্যাকারী বিশেষ করে শহরের নির্জন অঞ্চলে গাড়িতে থাকা যুগলদের হত্যা করতেন। বেশ কয়েকটি ঘটনায় ভুক্তভোগীর নারীর যৌনাঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছিল। রহস্যময় সেই আততায়ীকে ডাকা হয় ‘ফ্লোরেন্সের মনস্টার’ নামে। হত্যাকারীর পরিচয় আজও ফাঁস হয়নি; এটি আজও ইতালির ইতিহাসের অন্যতম রহস্যময় অধ্যায়।
নেটফ্লিক্সের নতুন চার পর্বের লিমিটেড সিরিজ ‘দ্য মনস্টার অব ফ্লোরেন্স’ তৈরি করেছেন লিওনার্দো ফাসোলি ও স্টেফানো সোলিমা। গল্পের শুরু ১৯৮২ সালের একটি ঘটনা দিয়ে। এক তরুণ প্রেমিক যুগল নিজেদের গাড়িতে খুন হন। পুলিশ তখন ১৯৬৮ সালের একটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এটির মিল পায়। কারণ, দুই ঘটনাতেই পয়েন্ট ২২ ক্যালিবার বেরেটা পিস্তল দিয়ে খুন করা হয়েছিল। অনেকে ভেবেছিলেন, এবার বুঝি রহস্য শেষ। কিন্তু তদন্তকারী আর সাংবাদিকেরা জানতেন না, এক জটিল ধাঁধার চক্করে পড়েছেন তাঁরা।
সিরিজ নির্মাণ ও সত্যিকার তদন্ত
পরিচালক সোলিমা টাইম সাময়িকীতে জানিয়েছেন, সিরিজটিতে কেসের প্রাথমিক বছরগুলোর ঘটনাই প্রাধান্য পেয়েছে; কারণ, পুরো ঘটনা ছিল বেশ জটিল। তিনি বলেন, ‘১৬টি হত্যার জন্য কোনো একক ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হয়নি। তাই আমরা গল্পটা শুরু থেকেই বলতে চেয়েছি, যখন তদন্তকারীরা ধীরে ধীরে মিল খুঁজে পাচ্ছিলেন এবং বুঝতে পারছিলেন, এটি হয়তো কোনো সিরিয়াল কিলারের কাজ।’
সিরিজটি কেবল তদন্তের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়নি, বরং সন্দেহভাজন চরিত্রগুলোর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানো হয়েছে। এটি দেখায় গুজব কীভাবে সত্য আর মিথ্যার মধ্যে সীমারেখা মুছে দেয়। সোলিমা বলেন, ‘আমরা সেই দানবের গল্প বলতে চেয়েছি, কিন্তু তার প্রকৃত পরিচয় নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। বরং প্রতিটি পর্বে যাদের সন্দেহ করা হয়েছিল, তাদের জীবনের দিকে মনোযোগ দিয়েছি।’
ভুক্তভোগীরা
আলোচিত এই ঘটনার প্রথম হত্যাকাণ্ড ঘটে ২১ আগস্ট, ১৯৬৮ সালে। বারবারা লোচি (৩২) ও তাঁর প্রেমিক অ্যান্টোনিও লো বিআঙ্কো (২৯) গাড়িতে বসে ছিলেন। খুব কাছ থেকে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। তবে বারবারার ছয় বছরের ছেলে গাড়ির পেছনের সিটে তখন দিব্যি ঘুমাচ্ছিল; ও বেঁচে যায়।
পরের ১৭ বছরে আরও সাত প্রেমিক যুগলকে একইভাবে হত্যা করা হয়। তবে কেউ কেউ সৌভাগ্যবশত বেঁচেও গিয়েছিলেন। আহতদের মধ্যে ছিলেন স্থানীয় ইতালীয় যুবক থেকে জার্মান ও ফরাসি পর্যটক। এই সিরিজ হত্যাকাণ্ডে ১৬ জন নিহত হন। সব ঘটনাতেই পয়েন্ট ২২ ক্যালিবার বেরেটা ও উইনচেস্টার সিরিজ এইচ বুলেট ব্যবহারের কারণে মনে করা হয় এক ব্যক্তি এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী।
শেষ হত্যাকাণ্ড ঘটে ১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, যখন ফরাসি যুগল জাঁ মিশেল ক্রাভিচভিলি ও নাদিন মোরিও ক্যাম্পিং করতে গিয়ে খুন হন। মোরিওর যৌনাঙ্গও কেটে ফেলে দেওয়া হয়।
তদন্ত এবং দ্বিধা
প্রাথমিক তদন্তে অনেক ভুল হয় যা নিয়ে পুরো প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। বারবারার স্বামী স্টেফানো মেলে প্রথমে স্বীকার করেন, তিনি নিজের স্ত্রী ও তাঁর প্রেমিককে হত্যা করেছেন, পরে আবার সেই স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করেন। ফলে শুরুতে এটিকে ‘পরকীয়া’র কারণে হত্যাকাণ্ড মনে করা হলেও ঘটনা আসলে আরও বেশি জটিল। পুলিশের কাছে দেওয়া বয়ানে স্টেফানো দাবি করেন, তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে বেশ কয়েকজনের সম্পর্ক ছিল। তারাই হয়তো হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। যদিও তদন্তে এসব দাবি ভুয়া প্রমাণিত হয়।
বারবারার প্রাক্তন প্রেমিক ফ্রান্সেস্কো ভিঞ্চি প্রথমে আটক হন। পরে আরও কয়েকজন সন্দেহভাজনকে আটক করা হয়। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদ আর বিশদের তদন্তের পর জানা যায়, এদের কেউই হত্যাকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলের আশপাশেও ছিলেন না। সবাইকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৯০-এর দশকে সন্দেহভাজন হিসেবে নাম আসে পিয়েত্রো প্যাকিয়ানির। এর আগে বেশ কয়েকটি যৌন সহিংসতার ঘটনায় তাঁর নাম জড়িয়েছিল। ১৯৯৪ সালে তাঁকে কয়েকটি হত্যাকাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, কিন্তু পরে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগও আপিলের পর খারিজ হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে এপ্রিলে তিনি মুক্তি পান। এর দুই বছর পরেই প্যাকিয়ানির মৃত্যু হয়।
প্যাকিয়ানির সহযোগী জিয়ানকার্লো লোটি ও মারিও ভানি পরে দোষী সাব্যস্ত হন, তবে তাঁদের স্বীকারোক্তি নিয়েও বিশেষজ্ঞেরা প্রশ্ন তোলেন। লোটি ২০০২ সালে ও ভানি ২০০৯ সালে কারাগারেই মারা যান।
আজও এই হত্যাকাণ্ডের সুরাহা হয়নি। ১৯৮৫ সালের হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত বেরেটাও কখনো উদ্ধার হয়নি।
তত্ত্ব ও সত্য
বছরের পর বছর ধরে কেসটি নানা ধরনের তত্ত্বের জন্ম দিয়েছে। কেউ বলেছেন এসব হত্যাকাণ্ড কোনো বিকারগ্রস্ত ক্রমিক খুনির কাজ। কেউ আবার দাবি করেছেন, এটা কোনো সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর কাজ। কিছু তত্ত্বে গোপন সমাজের ধারণাও এসেছে, কিন্তু আদতে কিছুই প্রমাণিত হয়নি।
সোলিমা বলেন, ‘সত্য এত ধূসর ছিল যে সিরিজ বানানো সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিল। বিভিন্ন মানুষ গল্প ভিন্নভাবে বলেছে, তাই একটি তত্ত্ব গ্রহণ না করে উপস্থাপন করা কঠিন ছিল। আমরা সব নাম ব্যবহার করেছি বাস্তব, তাই যা দেখবেন তা সত্য ঘটনা।’
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট
টাইম সাময়িকীতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সোলিমা আরও বলেন, ‘৬০‑ও ৭০-এর দশকের ইতালির সংস্কৃতি আজকের মতো নয়। এটি কৃষিনির্ভর ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। নারীর প্রতি সহিংসতা তখনো ছিল; আজও আছে। তাই এই গল্প এখনো প্রাসঙ্গিক ও সমসাময়িক।’
কী আছে সিরিজে
মুক্তির পর সিরিজটির প্রশংসা করেছেন সমালোচকেরা। সিরিজের প্রতিটি পর্বে আলাদা আলাদা সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে গল্প বলা হয়েছে। প্রথমে মেলে; এরপর বারবারার প্রেমিক ফ্রান্সেস্কো ভিঞ্চি; এরপর মেলের ভাই জিওভানি মেলে, শেষ পর্বে আসেন সালভাতরে ভিঞ্চি। এই চারজনকেই ‘মনস্টার’ হিসেবে দেখানো হয়, যেন সিরিজটি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে আসল হত্যাকারী কে—এটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। সব সন্দেহভাজনই বারবারার সঙ্গে নানা ধরনের অবমাননাকর আচরণ করেছেন।
সিরিজটি এগিয়েছে বারবারাকে ধরে, কিন্তু তাঁকে পুরোপুরিভাবে জানা যায় না। কেবল জানা যায়, তাঁকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। মূল চরিত্রের অভাব সিরিজের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।
নির্মাতা সোলিমা মূলত হত্যাকাণ্ডের প্রাথমিক অনুসন্ধানের মধ্যেই সীমিত থেকেছেন। এই সিদ্ধান্তের কারণে সিরিজ কখনোই পুরো হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত সমাধান দেখায় না; সম্ভবত ভবিষ্যতে সিকুয়েল আসবে।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো ভয়ংকর ও পৈশাচিক। ১৯৭৪ সালে ফ্লোরেন্সের উত্তরে এক যুগল গাড়িতে চুম্বন করছিলেন—তাঁদের হত্যা করা হয়। ওই নারীর স্তন ও যৌনাঙ্গকে ৯৭ বার ছুরি মারা হয়। এরপর কয়েক বছর আর কিছু ঘটে না। তবে ১৯৮০-এর দশকে হত্যা বেড়ে যায়। কথিত সেই দানব ১৯৮১, ১৯৮২, ১৯৮৩, ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে আবার হাজির হন। প্রতি হত্যাকাণ্ডেই একই সিরিজের গুলি ব্যবহার করা হয়। ছুরিকাঘাত ও দেহের অংশ কেটে ফেলার ঘটনা গুলির পরে ঘটে।
প্রায় সব হত্যাকাণ্ডই ঘটে নির্জন গ্রামে বা ছোট শহরের আশপাশে। প্রথমে পুরুষকে হত্যা করা হতো, তারপর নারীর যৌনাঙ্গকে নির্যাতন করা হতো।
চার পর্বের সিরিজটি প্রথাগত পুলিশি তদন্ত স্টাইলে এগোয় না। প্রকৃতপক্ষে, পুলিশি ব্যর্থতা এতটাই বড় ছিল যে হত্যাকারী ধরা পড়েনি। সিরিজটি মূলত সেই সামাজিক প্রেক্ষাপটকে তুলে ধরে, যেখানে মানুষ ক্রমিক খুনিতে পরিণত হয়। এমন পরিবেশে বড় হয় সেখানে নারীর প্রতি তাঁর ন্যূনতম সম্মান থাকে না।
বই, সিনেমায় ইতালির ‘দানব’
ভয়ংকর এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো এর আগেও উঠে এসেছে সিনেমা, সিরিজে। লেখা হয়েছে বই। প্রথম বইটি ছিল ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত ‘ইল মোসট্রো ডি ফিরেনজি’, লিখেছিলেন মারিও স্পেজি। ২০০৬ সালে স্পেজি ডগলাস প্রেস্টনের সঙ্গে লিখেছেন ‘ডোলচি কোলিন ডি সানগু’, যেখানে তাঁরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন পিয়েত্রো পচ্চিয়ানি সত্যিকারের মনস্টার ছিলেন কি না। ২০০৮ সালে তাঁরা এই বইয়ের ইংরেজি সংস্করণ ‘দ্য মনস্টার অব ফ্লোরেন্স: আ ট্রু স্টোরি’ প্রকাশ করেন।
সিনেমায় বারবার উঠে এসেছে ইতালির এই দানবের গল্প। ১৯৮৬ সালে সিজার ফেরারিও নির্মাণ করেন ‘ইল মোসট্রো ডি ফিরেনজি’, একই বছর আসে আরেকটি ইতালীয় সিনেমা ‘দ্য কিলার ইজ স্টিল আমাং আজ’। ১৯৯৯ সালে মুক্তি পায় সিনেমা ‘হ্যানিবাল’, পরে আসে একই নামের সিরিজও। ২০০৯ সালে তৈরি হয় ছয় পর্বের টিভি সিরিজ ‘ইল মোসট্রো ডি ফিরেনজি’। ২০১৭ সালে সিরিজ ‘ক্রিমিনাল মাইন্ডস: বিয়ন্ড বর্ডারস’-এও উঠে এসেছে ইতালির এই ঘটনা। ফ্লোরেন্সের সেই রহস্যময় আততাতীয় নিয়ে সবশেষ কাজ নেটফ্লিক্সের ‘দ্য মনস্টার অব ফ্লোরেন্স’।
টাইম ও দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে