আজকাল গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন না জেমস। কনসার্টের বাইরে আয়োজন করে ছবিও তোলা হয় না। রেকর্ডিং না থাকলে ঘরেই থাকেন, নিজের মতো সময় কাটান। কথাও বলেন কম। সেই জেমসকেই গত ২৩ মার্চ পাওয়া যায় আড্ডার মেজাজে। সেখানেই উঠে আসে তাঁর জীবনের নানা জানা-অজানা কথা। আজ জেমসের ৬১তম জন্মদিনে সে সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।
জেমসের বাবা মোজাম্মেল হক ছিলেন সরকারি চাকুরে। পরিবারের কেউ কখনো গানের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। ফলে বড় ছেলে জেমসের গায়ক–জীবন চাননি বাবা মোজাম্মেল হক ও মা জাহানারা খাতুন। কিন্তু কলেজজীবনের পর জেমসের মাথায় ঢোকে গানের পোকা। আর তাই অভিমানী জেমসকে ঘর ছেড়ে পথে নামতে হয়। আড্ডার শুরুতেই তাই জানতে চাওয়া হয় ‘বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। নিশ্চয়ই তিনি চাইতেন পড়াশোনা করে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবেন। ব্যান্ডসংগীতে জড়ালেন কীভাবে?’ জেমস বললেন, ‘তা তো জানি না, কীভাবে জড়িয়ে পড়লাম। সংগীতের সঙ্গে আসলে মানুষ কীভাবে জড়ায়? তখন বাইরের গান প্রচুর শুনতাম। এভাবে ওয়েস্টার্ন গানের সঙ্গে পরিচয় হয়, সংগীতের প্রতি ভালো লাগা জন্মায়। এ ভালো লাগা থেকেই জড়িয়ে পড়া।’
এ উত্তর পাওয়ার পরই লোভ জন্মায় কাদের গান তাঁকে আজকের ‘নগরবাউল’ বানিয়েছে। কাদের ডাকেই তিনি ঘর ছেড়ে আজিজ বোর্ডিংয়ের জীবন বেছে নিয়েছিলেন। ‘কাদের গান বেশি শুনতেন তখন?’ স্বভাবসুলভ মাপা হাসি হেসে বললেন, ‘অনেক লম্বা তালিকা। ৬০-৭০ দশকের রক ঘরানার সব ব্যান্ডের গানই শোনা হতো। কয়েকজনের কথা বলতে গেলে, জিমি হেনড্রিক্স, ডায়ার স্ট্রেইট, ডিপ পার্পল, পিংক ফ্লয়েডসহ অনেকেই।’
নব্বই দশক থেকে গান ফেরি করছেন জেমস। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বুঁদ হয়েছে তাঁর গানে। দেশ-বিদেশের মঞ্চে তাঁর যেন আর গাইতে হয় না। শুরু করতেই গেয়ে দেন শ্রোতারা। শুনতে শুনতে তাঁর সব গান যেন মুখস্থ ‘দুষ্টু ছেলেদের’। ‘লেইস ফিতা লেইস’ থেকে ‘তারায় তারায় রটিয়ে দেব’, ‘দুঃখিনী দুঃখ করো না’, ‘আসবার কালে আসলাম একা’ একস্বরে গেয়ে ওঠেন হাজার হাজার ভক্ত। কিন্তু শ্রোতা হিসেবে এসব গান কি জেমস শোনেন? তাঁর গাড়িতে কি নিজের গান বাজে? উত্তরটা দিতে একটু সময় নিলেন। বলেন, ‘গাড়িতে আমার গান শোনা হয় না। তবে পুরোনো গানগুলো বেশি শুনি। ৬০-৭০ দশক, আমাদের সময়েরগুলোই বাজে।’
এই শহরেই জেমস থাকেন, কিন্তু থেকেও যেন এই শহরে তিনি নেই। কনসার্ট না থাকলে ঘরেই থাকেন। ঘরবন্দী এ রুটিনে ‘নগরবাউল’–এর মাঝে কি ক্লান্তি চেপে বসে? হ্যাঁ ক্লান্তি তাঁকেও ভর করে। তাই তো বারবার ফিরতে চেয়েছেন কোনো শান্ত গ্রামে, কিন্তু ফিরতে চেয়ে এ শহরের মায়ায় তিনি বাঁধা পড়েছেন। জেমসের কথায়, ‘নাগরিক জীবনের ক্লান্তি বলতে আমার মধ্যে দুই ধরনের বিষয় কাজ করে। এখানে থাকতে বিরক্ত লাগে, আবার দূরে গেলে মিস করি। মানে একটা দোটানা। একবার শহর ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছা হয়, শহর ছেড়ে চলে গেলে মনে হয় এ শহর আমাকে ডাকছে। তবে খুব ইচ্ছা আছে শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার। সব সময় মনে হয় শান্ত কোথাও চলে যাই।’
হাতিরপুল, এলিফ্যান্ট রোড, বেইলি রোড থেকে মগবাজারের অলিগলিতে একসময় জেমসের পদচারণ ছিল, রেকর্ডিং থেকে আড্ডায় সময় কাটত। এখন আর যেন তাঁকে পাওয়া যায় না কোনো আয়োজন, কোনো আড্ডায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবার থেকে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, এই যে একাকিত্ব, তাঁকে কি ভোগায়? জেমসের কথায় ‘কোথায় একাকিত্ব? কখনো এমন অনুভব করিনি। হয়তো আমার সার্কেল অনেক ছোট। তবে আমি যাদের সঙ্গে মিশি, খুব ক্লোজ যারা, তাদের সঙ্গে আমি তো সব সময় আছি।’ পুরোনো সময়গুলো নিয়ে তাঁর উত্তর, ‘অনেক মিস করি। অনেক আড্ডা, গল্প, রাত জাগার স্মৃতি। সেসব জায়গায় একবার যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু কিছুই চিনতে পারছিলাম না। সব পরিবর্তন হয়ে গেছে, সুউচ্চ ভবন, নতুন নতুন মার্কেট—সবখানে। এই জন্য আর ওই দিকে যাই না। স্মৃতিতে যতটা আছে, এটাই থাকুক, এটাই রাখতে চাই।’
খ্যাতি, অর্থ থাকার পরও মানুষের জীবনে অপূর্ণতা থাকে। পৃথিবীতে কেউ কি পূর্ণতা পায়? একটা পেলে তো মানুষ আরেকটা চায়। দেশের সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক নেওয়া সংগীতশিল্পী জেমসের জীবনে কি অপূর্ণতা আছে? মাপা উত্তর তাঁর, ‘অপূর্ণতা এখনো বোধ করছি না। চাওয়া যদি তোমার বেশি কিছু না থাকে, তাহলে অপূর্ণতা আর কীভাবে গ্রাস করবে? এত চাওয়ার দরকারই তো নেই। আর আমার চাওয়া নেই, অপূর্ণতা আসবে কোত্থেকে!’