
নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের সময়টাকে কণ্ঠশিল্পীরা বলেন ‘সিজন’। বড় কনসার্টের বেশির ভাগই হয় বছরের এই সময়ে। চলতি মৌসুমেও ব্যস্ত সময় পার করছেন দেশের সংগীতশিল্পীরা। তবে ওপেন এয়ার কনসার্টের চেয়ে করপোরেট আয়োজনের ব্যস্ততা বেড়েছে। এবারের কনসার্টের মৌসুম কেমন যাচ্ছে, খোঁজ নিয়েছেন নাজমুল হক
গানে, আড্ডায় দারুণ একটি দিন কেটেছে গতকাল। এদিন প্রথমবারের মতো ঢাকায় গান শুনিয়েছে জনপ্রিয় পাকিস্তানি ব্যান্ড কাবিশ। রাজধানীর সেনা প্রাঙ্গণে ‘ঢাকা ড্রিমস: কাবিশ লাইভ ইন কনসার্ট’-এ অংশ নেয় ব্যান্ডটি। শুক্রবার রাতে কাবিশের আগে সংগীতশিল্পী আরমীন মুসা ও ঘাসফড়িং কয়ার, লেভেল ফাইভ, শূন্য, অর্ণব এবং সুনিধি নায়েক গান শুনিয়েছেন। জমজমাট এ আয়োজনে উল্লেখযোগ্য দর্শকের উপস্থিতিও ছিল। এ তো গেল জানুয়ারির শেষ শুক্রবারের চিত্র। সার্বিকভাবে কেমন চলছে কনসার্ট?
দেশের বড় কনসার্টগুলোতে আয়োজকদের চাহিদা থাকে নগরবাউলকে নিয়ে। ছেলে-বুড়ো এখনো জেমস বলতে পাগল। এবারও কনসার্টের মৌসুমে ব্যস্ত সময় পার করছে নগরবাউল। চলতি সপ্তাহে ঢাকা ও এর বাইরে বেশ কিছু শো রয়েছে ব্যান্ডটির। আগামী পয়লা বৈশাখ পর্যন্ত শিডিউল চূড়ান্ত হয়েছে। ব্যান্ডটির মুখপাত্র রুবাইয়াৎ ঠাকুর রবিন গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘শীতের এই সময়টাকে সিজন বলা হলেও আমাদের আসলে বছরজুড়ে একই ব্যস্ততা থাকে। তবে শীতে সবারই শোর চাপ বাড়ে। ঢাকার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে থেকেও অনেক কনসার্টের প্রস্তাব পাচ্ছি। আমাদের মানদণ্ডে যাঁরা ব্যবস্থাপনা করতে পারছেন, তাঁদের কনফার্ম করছি।’
সম্প্রতি কনসার্টে নিরাপত্তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংকট। বেশ কয়েকটি শোতে হয়েছে হট্টগোল। বিষয়টি নিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে নগরবাউল। ব্যান্ডটি মনে করছে, বিষয়গুলো নিয়ে সবাইকে ভাবতে হবে, শুধু এক পক্ষকে দোষারোপ না করে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন। রবিনের কথায়, ‘নব্বইয়ের দশক থেকেই আমরা এ উন্মাদনা দেখে এসেছি। সব ভক্তের যে টিকিট কেটে শো দেখার সামর্থ্য হবে, তা–ও কিন্তু নয়। তবে সহিংস হওয়া যাবে না। কারও ক্ষতি করে ভালোবাসার প্রকাশ ভালো কিছু নয়। তবে আমি এক পক্ষকে দোষারোপের পক্ষে নই। আয়োজকেরা বিষয়গুলো কীভাবে সামলান, তার ওপর সব নির্ভর করে। আয়োজকদের পাশাপাশি ভেন্যু কর্তৃপক্ষেরও অনেক দায়িত্ব রয়েছে, শুধু ভেন্যু ভাড়া দিয়ে বসে থাকলেই হবে না। ভালো একটা শো আয়োজনে তাদেরও সহযোগিতা করতে হবে।’
এবার জলের গানের ব্যস্ততা কিছুটা কম। তবে এ সময় প্র্যাকটিস ও নতুন গান নিয়ে পরিকল্পনা করছে ব্যান্ডটি। জলের গানের সদস্য রানা সরোয়ার বলেন, ‘আমাদের ব্যস্ততা মোটামুটি। অন্য সময় শীতকালে ঘুমানোর টাইম পেতাম না, আর এবার ঘরে অনেকটা শুয়েবসেই কাটাচ্ছি। শো অনেক কম। তবে ব্যান্ডের অন্যান্য কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। নতুন গানের কাজ করছি। নতুন কাজের পরিকল্পনা করছি।’
এ সময়ের তরুণদের অন্যতম পছন্দের ব্যান্ড লালন। ব্যান্ডটির ড্রামার ও দলনেতা থিন হান মং তিতি বলেন, ‘কনসার্টের অনেক প্রস্তাব পাচ্ছি। তবে গোছানো আয়োজন ছাড়া কথা দিচ্ছি না। গণ-অভ্যুত্থানের পর কিছু সংকট দেখা দিচ্ছিল, অনুষ্ঠান কিছুটা থমকে ছিল। এ সংকট অনেকটা কেটে গেছে। নতুন উদ্যমে সবকিছু শুরু হওয়ার ফলে অনেক নতুন আয়োজক এসেছেন। তাঁদের মধ্যে সবাই গুছিয়ে উঠতে পারছেন না। অনেকেই ভালো করছেন, আবার অতি উৎসাহী কিছু আয়োজকের অনুষ্ঠানে কিছু ঝামেলাও হচ্ছে। আশা করি, এসব ঠিক হয়ে যাবে। আমি সরকারের বেশ সহযোগিতা দেখতে পাচ্ছি, যেমন প্রথমবারের মতো শিল্পকলায় আমরা শো করলাম। আগে কিন্তু আমরা এখানে ঘেঁষতেও পারতাম না। এর বাইরে শিল্পকলার সঙ্গে আমাদের বেশ কিছু নতুন উদ্যোগ নিয়ে নিয়মিত বসা হচ্ছে। চলতি মাসে বেশ কয়েকটি ব্যান্ড এখানে পারফর্মও করবে। ছাত্র ও তরুণদের মধ্যে যে অশান্তির ভাব বিরাজ করে, সুষ্ঠু সংস্কৃতিচর্চা ছাড়া এর সমাধান সম্ভব নয়।’
কনসার্ট নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন আরেক জনপ্রিয় শিল্পী কনা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নভেম্বরে চাপ একটু কম ছিল, ডিসেম্বর–জানুয়ারি ভালোই চাপ গেছে, আর ফেব্রুয়ারির শিডিউলও দেখছি বুকড হয়ে যাচ্ছে।’ কনসার্টে কোন গানের অনুরোধ বেশি আসছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এবার আমার ক্যারিয়ারে “দুষ্টু কোকিল” যুক্ত হয়েছে। সবখানেই এই গানের অনুরোধ আর সাড়া পাই। অনেক কনসার্টে দুবারও এই গান করতে হচ্ছে। এ ছাড়া সবশেষ “প্রেমের দোকানদার” গানেও অনেক সাড়া পেয়েছি। অন্যান্য গানের সঙ্গে শ্রোতারা এই দুটি গানের বেশি অনুরোধ রাখছেন।’
কনা অবশ্য নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা দেখছেন না। তাঁর ভাষ্যে, ‘সবকিছু আগের মতোই আছে। যেহেতু অনেক সময় যাবৎ এই ইন্ডাস্ট্রিতে আছি, বিষয়গুলো নিয়ে আমি ও আমার টিম সব সময় সতর্ক ও সচেতন। কাদের আয়োজনে যাচ্ছি, তাঁরা কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন, তা নিশ্চিত করেই আমরা শো নিয়ে থাকি। ওপেন এয়ার কনসার্টে তো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকলেই আমরা যাচ্ছি।’ মৌসুমে ব্যস্ত সময় পার করছেন ইমরান মাহমুদুল।
তবে এর বাইরে নতুন গান ও সিনেমার গান নিয়েও ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। প্রথম আলোকে ইমরান বলেন, ‘শীতের মৌসুম আলহামদুলিল্লাহ ভালোই যাচ্ছে। শোর ওপরেই আছি। তবে আমার ব্যস্ততা এখন সিনেমা আর ফিকশনের গান নিয়ে। ভালোবাসা দিবসে কিছু ফিকশনের জন্য কাজ করছি, এর বাইরে আমার একটা প্রজেক্ট আসছে ফুয়াদ আল মুক্তাদির ভাইয়ের সঙ্গে।’
ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, আর্টিস্ট ম্যানেজমেন্ট নিয়ে কাজ করে মেলোডি এন্টারটেইনমেন্ট। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ওমর মির্জা জানান, প্রচুর করপোরেট শো হলেও ওপেন এয়ার কনসার্ট কিছুটা কম। সবার আগে নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখন ওপেন শোগুলোর ক্ষেত্রে আমরা শিল্পীদের নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিচ্ছি। নতুন কিছু আয়োজক এসেছেন, তাঁদের স্বাগত জানাই। তবে তাঁদের অনেকেই যথাযথ অনুমতি নিয়ে শো করছেন না, সেগুলোতেই মূলত সমস্যা হচ্ছে।’
কনসার্টের হালহকিকত জানতে কথা হয় অডিও ডিজাইন বাংলাদেশের শব্দ প্রকৌশলী মোহাম্মদ শরিফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কিছু শিল্পী প্রচুর শো করছেন, আবার কেউ কেউ একদম বসা। আমার সাউন্ড ইন্ডাস্ট্রির কথা যদি বলেন, বলব, রুচির উন্নতি হচ্ছে না। অনেক বড় বড় শোতেও বাজে সাউন্ড দেখা যাচ্ছে। এতে পুরো ইন্ডাস্ট্রি ক্ষতিগ্রস্ত যেমন হচ্ছে, তেমনি শ্রোতাদের সঙ্গে প্রতারণা হচ্ছে।’
সব মিলিয়ে চলতি মৌসুমকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন সবাই। সামনে আরও ভালো সময় আসবে। শীত শেষে পবিত্র ঈদুল ফিতর ও পয়লা বৈশাখের সময়টা ভালো কাটবে বলে আশা তাঁদের। যে সংকটগুলো এখনো আছে, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেটে যাবে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।