বাপ্পা মজুমদার
বাপ্পা মজুমদার

বাবার গ্রেপ্তার হওয়া, একরাতে মায়ের সংসারের হাল ধরা জীবনের গল্প বললেন বাপ্পা

সংগীতসাধক পণ্ডিত বারীণ মজুমদারকে ফিল্মি স্টাইলে মিউজিক কলেজ থেকে বের করে দেওয়া হয়। বাসায় ফেরার পর তিনি গ্রেপ্তার হন। মিউজিক কলেজ থেকে তাঁর বাবাকে বের করে দেওয়ার পর পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে মা ইলা মজুমদারের ওপর। তিনিও সবকিছু অসাধারণভাবে সামলে নেন। মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে কথাগুলো নিজের ফেসবুকে লিখেছেন বাপ্পা মজুমদার।

এ মুহূর্তে বাপ্পা মজুমদার আছেন কানাডায়। সেখানকার কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে কনসার্টে অংশ নিতে গত মাসে বাংলাদেশ ছাড়েন। আগামী সপ্তাহে তাঁর ঢাকায় ফেরার কথা রয়েছে। এদিকে আজ ৩ মে বাপ্পার মা ইলা মজুমদারের ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী।

দিনটিতে বাপ্পা তাঁর ফেসবুকে মায়ের সঙ্গে তোলা একটি স্থিরচিত্র পোস্ট করে লিখেছেন, ‘এই দিনে মা চলে গেলেন! আজ ১৪ বছর...। কুটিন সোনা বলে আর কেউ ডাকবে না! মা গো মা! ভালো থেকো যেখানেই থাকো! ভালো থেকো অনন্তে!’

সংগীতসাধক পণ্ডিত বারীণ মজুমদার ও তাঁর স্ত্রী ইলা মজুমদার, জনপ্রিয় শিল্পী বাপ্পা মজুমদারের মা–বাবা।

পরে আরেকটি পোস্টে বাপ্পা তাঁদের জীবনের দুঃসহ সময়ের স্মৃতিকথা তুলে ধরেছেন। সেখানে বাবার কারাবরণ ও মায়ের শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরার বিষয়টি উঠে এসেছে।

বাপ্পা লিখেছেন, ‘আমার ছোটবেলার সেই প্রিয় মিউজিক কলেজ থেকে যেদিন আমাদের ফিল্মি স্টাইলে রাস্তায় ছুড়ে ফেলা হয়েছিল, সেই দিনটি আজও আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে! বাবা মিউজিক কলেজের দোতলায়, এলোমেলো চুল, গায়ে সেই পরিচিত কোটটা নেই, টাইটা গলায় ঝুলছে—বাবা আমাদের দোতলা থেকে চিৎকার করে বলছেন, ‘তোমরা যাও, আমি আসছি...।’ তখনকার আমি সদ্য নার্সারিতে পড়ি...! একটা রিকশায় তুলে দেওয়া হলো আমাদের! মা ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে আছেন বাবার দিকে! দোতলা থেকে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে আমাদের ব্যবহৃত আসবাব আর সবকিছু! একরাতে হয়ে গেলাম বাস্তুহারা! ’

বাবা বারীণ মজুমদার, মা ইলা মজুমদারের সঙ্গে দুই ভাই–বোন পার্থ ও মিতু।

বাপ্পা জানালেন, সংগীত মহাবিদ্যালয় থেকে তাদের বের করে দেওয়ার পর মগবাজারের একটি বাসায় ঠিকানা হয় তাঁদের। সেখানে থেকে পরে তাঁদের নতুন জীবন শুরু হয়।

বাপ্পা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মিউজিক থেকে থেকে বের করে দেওয়ার পর আমাদের আচমকা ঠিকানা হলো মগবাজারের একটি বাসায়। মেজদা, ফারুক কাকু আর বাবার কিছু ছাত্র গুণগ্রাহীর সহায়তায়! বাবা সেই বাসায় আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রেপ্তার হলেন মিথ্যা মামলায়! কারাগার থেকে বাবা ফিরলেন ১৮ দিন পর! কাজকর্মহীন মানুষটি হয়ে পড়লেন ভীষণ মানসিক যন্ত্রণায়, চরমতম হতাশ আর দিকহারা! মা ইলা মজুমদার সব সামলে নিতে পা বাড়ালেন! সংসার বাঁচাতে মরণপণ যুদ্ধে নামলেন সেই অতিমানবী! চাকরি নিলেন উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে! সব যুদ্ধ জয় করলেন সেই মানুষটি! এক ভয়ংকর যুদ্ধে সব সামলে ধরলেন সংসারের হাল! আজ আমাদের অস্তিত্ব যদি টিকে থাকে তার সর্বময় কৃতিত্ব আমার মায়ের, যার নাম ইলা মজুমদার! ইলা মজুমদার শুধু একটি নাম নয়, তিনি একজন উদাহরণ! তিনি শুধু একজন স্ত্রী বা মা নন, বরং তার চেয়েও বড় একজন মানুষ—যিনি সবকিছু তুচ্ছ করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি কতটা শক্তিশালী! তিনি একজন সুপার হিউম্যান! এবং আমি গর্ব করে বলি, আমি ইলা মজুমদারের ছেলে!’

বাপ্পা মজুমদার ও পার্থ মজুমদার। ছবি: কবির হোসেন

বাপ্পা মজুমদারদের বাড়িতে সারাক্ষণই সংগীতচর্চা হতো। সারাক্ষণই রেওয়াজ করতেন কেউ না কেউ। বড়রা যখন করতেন না, তখন করতেন ছোটরা, অর্থাৎ শিষ্যরা। ১৭ সিদ্ধেশ্বরীর বাড়িতে থাকতেন সংগীতসাধক পণ্ডিত বারীণ মজুমদার ও তাঁর স্ত্রী ইলা মজুমদার, জনপ্রিয় শিল্পী বাপ্পা মজুমদারের মা-বাবা। কেমন ছিলেন পণ্ডিত বারীণ মজুমদার? বাপ্পার স্মৃতি থেকে তা–ও জেনে নেওয়া যাক।

বাপ্পা প্রথম আলোকে বলেন, ‘দিনে গড়ে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা রেওয়াজ করতেন বারীণ মজুমদার। শুরু হতো সকাল সাতটায়। এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন ভয়ানক অধ্যবসায়ী। বাড়িতে সংগীতচর্চা হতো সারাক্ষণ। এক ঘরে ছাত্রছাত্রীরা গান শিখছে তো অন্য ঘরে পড়াশোনা করতেন বাপ্পারা। সংগীত এভাবেই মগজে গেঁথে নিয়েছেন তাঁরা। বাপ্পা বলেন, ‘আমাদের কাছে ওটাই ছিল স্বাভাবিক জীবন। বাড়ির পরিবেশ আমাদের শিখিয়েছে, একটা মানুষকে রেওয়াজ করতে হবে। আমাদের ক্ষেত্রে সেটা হয়তো ঠিকঠাকমতো হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ভাবনায় ঢুকে গিয়েছিল যে প্র্যাকটিস ছাড়া উপায় নেই।’

সংগীত তারকা বাপ্পা মজুমদার ফেসবুকে এই ছবিটি পোস্ট করে লিখেছিলেন মায়ের সঙ্গে ছোট বাপ্পা

বারীণ মজুমদার পরিবারের প্রতিও ছিলেন অসম্ভব দায়িত্বশীল একজন মানুষ। বাপ্পার ভাষায়, ‘তিনি অসম্ভব ভালো একজন স্বামী ও পিতা। একজন শিল্পীকে এই কম্বিনেশনে পাওয়া কঠিন। কার কিসের কমতি হলো, সেসব নিয়ে তিনি সজাগ থাকতেন, হয়তো প্রকাশ করতেন না। ছেলে ঠিকমতো পড়ছে কি না, খাচ্ছে কি না, সেসবের খেয়াল রাখতেন। বাবা বাজার ও রান্না করতে পছন্দ করতেন। শিকারে আগ্রহ ছিল, যদিও একপর্যায়ে সেটা ছেড়ে দিয়েছিলেন। মাছ ধরতে পছন্দ করতেন। ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতেন। তিনি ছিলেন শৌখিন মানুষ। বাগান করতে ভালোবাসতেন।

সংগীতসাধক পণ্ডিত বারীণ মজুমদার

বাবা বলতেন, গাছেরা বাবাকে বোঝে। বাগানে নিজ হাতে কোদাল চালাতেন। সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় একটা পরিত্যক্ত জায়গায় বাবা বাগান করেছিলেন। তাঁর হাতে লাগানো গাছে এত বড় ডালিয়া ফুল ফুটেছিল যে আমি নিশ্চিত, এত বড় ডালিয়া ফুল কেউ দেখেনি।’

সংগীতসাধক পণ্ডিত বারীণ মজুমদারকে ১৯৮৩ সালে একুশে পদক এবং ২০০২ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।