
দুই বছর আগে একমাত্র ছেলে নিবিড় দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হওয়ার পর থেকেই গান থেকে অনেকটাই দূরে কুমার বিশ্বজিৎ। গেল কয়েক বছর স্টেজ শোতে ব্যস্ত সময় কাটানো এই সংগীতশিল্পী ছেলের অসুস্থতায় সেখান থেকেও নিজেকে সরিয়ে নেন। ছেলের জন্য স্ত্রীসহ দুই বছরের বেশি সময় ধরে তাঁর বসবাস এখন কানাডায়। কুমার বিশ্বজিৎ–ভক্তদের জন্য সুখবর, আবার স্টেজ শোতে ব্যস্ত হতে যাচ্ছেন এই সংগীতশিল্পী। আগামী মাস থেকে এই ব্যস্ততা শুরু হচ্ছে।
কুমার বিশ্বজিৎ গতকাল রোববার রাতে কানাডা থেকে প্রথম আলোকে জানালেন, কানাডার টরন্টো দিয়ে তাঁর স্টেজ শো শুরু হতে যাচ্ছে। এরপর প্যারিস, নিউজিল্যান্ড, কাতার এবং অস্ট্রেলিয়ার বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে তিনি দলবল নিয়ে স্টেজ শো করবেন।
কুমার বিশ্বজিৎ বললেন, ‘অনেক দিন ধরে আয়োজকেরা চাইছিলেন, দেশে ও দেশের বাইরের স্টেজ শোতে ফিরি। কিন্তু মানসিক অবস্থা এমন ছিল যে কোনোভাবে ইচ্ছা করছিল না কোথাও গাওয়ার। গান তো ইমোশন দিয়ে করার ব্যাপার, সেই ইমোশন সত্যি বলতে কাজ করছিল না। এর মধ্যেও অনুরোধে গত দুই বছরে দু–একটা স্টেজ শো করতে হয়েছে। এখন যেহেতু নিবিড়ের পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে, তাই কয়েকটি স্টেজ শোতে পারফর্ম করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বেশ কিছুদিন ধরে কয়েক দেশের আয়োজক স্টেজ শোর ব্যাপারে যোগাযোগ করছিলেন। পরিস্থিতি বুঝেশুনে তাঁদের আয়োজনে গাইতে সম্মত হয়েছি। নতুন কয়েকটি গান নিয়েও পরিকল্পনা চলছে।’
কুমার বিশ্বজিৎ এ–ও বললেন, ‘শ্রোতারাও আমার পরিবারের একটা অংশ। চার দশকের বেশি সময় ধরে তাঁদের সঙ্গে গানে গানে সুরে সুরে সুখ–দুঃখ ভাগ করে নিয়েছি। সেই পরিবার থেকেও দূরে আছি। চিন্তা করে দেখলাম, শ্রোতাদের জন্য গান করা উচিত। তাই এ বছরেই স্টেজ শোতে ফিরছি। আগামী ২২ জুন কানাডার টরন্টোতে একটি কনসার্টে গাইব। জুলাইতে প্যারিসে কনসার্ট করব। নিউজিল্যান্ডেও কনসার্ট নিয়ে কথা চলছে। আগস্টে অস্ট্রেলিয়ায় বেশ কয়েকটি কনসার্ট কনফার্ম করেছি। ২৩ আগস্ট মেলবোর্নে, ৩০ আগস্ট সিডনিতে, ৩১ আগস্ট ব্রিসবেনে এবং ৬ সেপ্টেম্বর পার্থে গান গাইব। আমার সঙ্গে যারা নিয়মিত বাজায়, তারাই থাকবে।’
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঘটে যাওয়া একটি দুর্ঘটনা কুমার বিশ্বজিতের জীবনের সব হিসাব–নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। তাঁর একমাত্র সন্তান কুমার নিবিড় কানাডায় মারাত্মক দুর্ঘটনায় আহত হন। সেই থেকে এতটা সময় ধরে কানাডার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গেল এক বছর কানাডার মিসিসাগার একটি রিহ্যাব সেন্টারে আছেন নিবিড়। ২০২৪ সালের শুরুর দিকে ছেলের সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে কথা হয়েছিল কুমার বিশ্বজিতের সঙ্গে। তখন তিনি জানিয়েছিলেন যে দ্রুতই নিবিড়কে রিহ্যাব সেন্টারে নেওয়া হবে। সেখানেই তাঁর জীবনের পরবর্তী সব চিকিৎসাসেবা শুরু হবে। এখন জানা গেছে, এক বছর ধরে নিবিড় রিহ্যাব সেন্টারে আছেন।
২৬ মাস ধরে কুমার বিশ্বজিৎ অবস্থান করছেন কানাডার টরন্টোয়। শুরুর দিকে সেখানকার সেন্ট মাইকেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তাঁর একমাত্র সন্তান কুমার নিবিড়। ২০২৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সড়ক দুর্ঘটনায় নিবিড় মারাত্মক আহত হলে মা–বাবা দুজনেরই ঠিকানা সেই সেন্ট মাইকেল হাসপাতাল। মাঝখানে কয়েকবার অল্প সময়ের জন্য ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। গেল বছরও একবার এসেছিলেন। ছেলের এখন যে অবস্থা, তাতে আপাতত বাংলাদেশের আসার কোনো চিন্তা নেই। তবে জরুরি প্রয়োজনে আসা হতেও পারে জানালেন গতকাল রোববার রাতে।
নিবিড়ের সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা প্রসঙ্গে কানাডা থেকে কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, খুবই ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। এতটাই ধীরে হচ্ছে যে এটাকে কোনোভাবেই অনেক বেশি অগ্রগতি বলা যাবে না। বছরখানেক ধরে রিহ্যাবে আছে। এখানে স্পিচথেরাপি, ফিজিওথেরাপি, স্টিমিউলেটেড থেরাপি চলছে। স্বাভাবিক জীবনের জন্য যা যা করণীয়, সবই করার চেষ্টা হচ্ছে। প্রতিদিনই নিবিড়কে বাইরের পরিবেশ দেখানোর চেষ্টা চলে। এখনো কিছু শারীরিক সমস্যা আছে। নিজের পায়ে এখনো দাঁড়াতে পারে না।
মাঝেমধ্যে মেশিনের মাধ্যমে দাঁড় করানোর চেষ্টা হয়। চিকিৎসকেরা বলেছেন, কিছু কিছু মাসল পাজম জায়গায় আছে। কথা বলার ব্যাপারটা কবে কখন হবে, কেউ বলতে পারে না। নানা সমস্যা থাকলেও অন্যদিকে উন্নতি হয়েছে বলে জানান কুমার বিশ্বজিৎ। তিনি বলেন, ‘ডাকলে সে তাকায়। ঘাড় ডানে-বাঁয়ে ঘোরায়। মাঝেমধ্যে হাত-পা নিজে থেকে নাড়ে। খাবারদাবার কৃত্রিম উপায়ে দিতে হয়। শরীরে এখন অক্সিজেন দিতে হয় ২ পারসেন্ট। এই ২ পারসেন্ট অক্সিজেন ছাড়াই নিবিড় ৭-৮ আট ঘণ্টা থাকতে পারে। এটাই–বা কম কিসের!’
কানাডার মিসিসাগার যে রিহ্যাব সেন্টারে নিবিড়ের চিকিৎসা চলছে, তা নিয়ে সন্তুষ্ট কুমার বিশ্বজিৎ। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের মেডিকেল সাপোর্টের রিহ্যাব পুরো কানাডায়ও কম আছে। এমনিতে দীর্ঘমেয়াদি আরও অনেক ধরনের রিহ্যাব সেন্টার আছে। সেখানে অপেক্ষাকৃত ভালো রোগী যাঁরা, তাঁরা সেখানে থাকেন; যাঁরা খেতে পারেন, সাড়া দিতে পারেন। নিবিড়কে তো অনেক ওষুধ দিতে হয়, যার জন্য সার্বক্ষণিক নার্স দরকার। ইনএনটি সাপোর্টও দরকার। নিবিড় যেখানে আছে, ওদের রিহ্যাবে সাফল্যের হারও ভালো। এমনও আছে যে এ ধরনের রোগী পাঁচ বছর রিহ্যাবে থাকার পর পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছে। আমরা যেমন আশাবাদী, রিহ্যাবের ওরাও আশাবাদী। এখন দেখা যাক, কী হয়।’