
বাংলাদেশে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, একসময় সুইডেন আর ভারতের সংগীতাঙ্গনেও ছিল তাঁর সরব উপস্থিতি। কানাডার টরন্টোয় নিভৃত জীবন কাটাচ্ছেন এখন বাংলাদেশের খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক, গীতিকার ও শিল্পী সানী জুবায়ের। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন একসময়ের সহপাঠী কাউসার খান
ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে এল হালকা হাসির আওয়াজ। এরপর খানিক থেমে সানী জুবায়ের বললেন, ‘গানই আমার ঘর। আর সেই ঘরটা একটু নিঃসঙ্গতাই ভালোবাসে।’ নিঃসঙ্গ সেই ঘর থেকেই বেরিয়েছে অনেক সুর। সুরগুলো কখনো মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছে, কখনো শ্রোতার বুকের ভেতর ঢেউ তুলেছে। অথচ শিল্পী নিজে সব সময় থেকেছেন পর্দার আড়ালে, নিজের মতো করে। ‘অনিল বাগচীর একদিন’ চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করে ২০১৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন সানী জুবায়ের। টরন্টোর কাছে গুয়েল্ফ শহরে এখন সংগীতের নির্জন সাধনায় কাটে তাঁর দিনরাত। অনেক দিন পর তাঁর সঙ্গে আলাপ। যদিও বহুদিনের চেনাজানা। নটর ডেম কলেজ থেকে ভারতের নৈনিতালের কুমায়ুন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তরের বহু স্মৃতি আমাদের। আলাপের শুরুতে বললেন, ‘আমি সংগীতকে কেবল শিল্প বলেই দেখি না, আমার কাছে এটি এক গভীরতর সংযোগের মাধ্যম—যে সংযোগ মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির এবং একই সঙ্গে তা হয়ে ওঠে এক অনির্বচনীয় ঐশ্বরিক উপলব্ধি। এই মাধ্যমে তুমি নিজেকে বোঝো, অন্যকেও চেনো। আনন্দ, যন্ত্রণা, ভালোবাসা—সুরের ভেতর সব একসঙ্গে গলে যায়, সৃষ্টি করে এক নিবিড়, অলৌকিক মুগ্ধতা।’
‘অনিল বাগচীর একদিন’ চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করে ২০১৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন সানী জুবায়ের। টরন্টোয় এখন সংগীতের নির্জন সাধনায় নিভৃতে কাটে তাঁর দিনরাত।
মনে পড়ছে, বন্ধু সৈয়দ ফজলে রুমি তখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বলছিলেন, ‘আমাদের সৌরভ (জুবায়েরের ডাকনাম) বাংলা গানের বাগানে যেন এক নিঃশব্দ সুবাস ছড়ানো ফুল।’ তারপর স্মৃতির পট খুলে দিলেন তিনি, ‘নৈনিতালের শীতে, পাহাড়ঘেঁষা সন্ধ্যায় জোছনার আলোয় আমরা তাঁর গাওয়া গান শুনতাম। সেসব রাত আজও মনের গভীরে জমে আছে। কেবল আফসোস হয়, তাঁর সেই সুবাসটা বাংলা সংগীতজগৎ ঠিক করে নিতেই পারল না।’ অন্যদিকে ভারতের নৈনিতালে পড়াশোনার সময়কালেই সানী জুবায়ের জড়িয়ে পড়েন সেখানকার বিখ্যাত থিয়েটার দল ‘যূগমঞ্চ’-এর সঙ্গে। যূগমঞ্চের খ্যাতিমান নাট্যব্যক্তিত্ব জহুর আলম তখন কাছ থেকে দেখেছেন এই প্রতিভাবান শিল্পীকে। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘জুবায়ের ছিল এক অসাধারণ শিল্পী। ধ্রুপদি সংগীতে যেমন ছিল তার গভীর অনুরাগ, তেমনি নাট্যসংগীতেও ছিল স্বতঃস্ফূর্ত দক্ষতা ও স্বাতন্ত্র্য। আজও আমরা তাকে গভীরভাবে মনে করি, মঞ্চে ও ব্যক্তিজীবনে তার অনুপস্থিতি তীব্রভাবে অনুভব করি।’
পাটিয়ালা থেকে সুইডেন
ছোটবেলায় পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু গোবিন্দ রবি দাসের কাছে সানী জুবায়েরের সংগীতচর্চা শুরু। এরপর পাতিয়ালা ঘরানার ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলীর দুই নাতি ওস্তাদ মাযহার আলী খান ও ওস্তাদ যাওয়াদ আলী খানের কাছে তালিম নেন। পড়াশোনা নৈনিতালের কুমায়ুন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর সংগীতের পথ তাঁকে নিয়ে যায় সুইডেনের গোটল্যান্ড স্কুল অব মিউজিক কম্পোজিশন আর স্টকহোমের রয়্যাল কলেজ অব মিউজিকে—যেখান থেকে পাশ্চাত্য ধ্রুপদি সংগীতে মাস্টার্স করেন।
বন্ধু সৈয়দ ফজলে রুমি বলছিলেন, ‘আমাদের সৌরভ বাংলা গানের বাগানে যেন এক নিঃশব্দ সুবাস ছড়ানো ফুল।’ তারপর স্মৃতির পট খুলে দিলেন তিনি, ‘নৈনিতালের শীতে, পাহাড়ঘেঁষা সন্ধ্যায় জোছনার আলোয় আমরা তাঁর গাওয়া গান শুনতাম। সেসব রাত আজও মনের গভীরে জমে আছে।
৮২ জন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীর মধ্য থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন সানী জুবায়ের। তিনি বলেন, ‘ভর্তি হওয়ার সুযোগটাই ছিল আমার কাছে সবচেয়ে বড় সম্মান।’ সোজাসাপটাই বললেন, ‘আমাকে নিয়ে কিছু ভুল তথ্য চালু আছে। অনেকে বলেন, আমি নাকি সরকারি স্কলারশিপে সুইডেনে পড়েছি। আসলে সুইডেনে তখন স্কলারশিপ বলে কিছু ছিল না। ভর্তি হতে পারলে কোনো ফি লাগত না, এটাই তখন নিয়ম ছিল। আরেকটা কথা, অনেকে বলেন, পণ্ডিত রবিশঙ্করের পর আমিই নাকি পড়েছি স্টকহোমের রয়্যাল কলেজ অব মিউজিকে—এটাও ঠিক নয়। আমি চাই, আমার পরিচয় হোক কাজ দিয়ে, সত্যিকারের অর্জন দিয়ে।’
একেকটি গান, একেকটি অনুভব
১৯৯৫ সালে প্রস্তুত হয় তাঁর প্রথম অ্যালবাম ‘সারা’, সংগীত আয়োজন করেছিলেন প্রয়াত সংগীতশিল্পী লাকী আখান্দ্, কিন্তু অ্যালবামটি তখন আর প্রকাশ হয়নি। পরে নতুন করে বাপ্পা মজুমদার ও সানী জুবায়েরের সংগীত পরিচালনায় ‘সারা’ অ্যালবামটি ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর ‘নির্জন স্বাক্ষর’, ‘আপনা খায়াল’, ‘অদ্ভুত আঁধার এক’, ‘যুগলসন্ধি’, ‘অজস্র কবিতা’—প্রতিটি অ্যালবাম যেন নতুন আবেগের জানালা খুলেছে। সেই সময়ে অডিও বাজারে সানীর আলাদা পরিচিতি ছিল। ‘আজ আমার মন ভালো নেই’ গানটি তো রীতিমতো ভাইরাল! নজরুলসংগীতের অ্যালবাম ‘কেন মেঘেরও ছায়া’ শ্রোতাদের টেনেছে নতুন ঘোরে।
আমি সংগীতকে কেবল শিল্প বলেই দেখি না, এটা আত্মা থেকে আত্মায় যাওয়ার সেতু। এই মাধ্যমে তুমি নিজেকে বোঝো, অন্যকেও চেনো। আনন্দ, যন্ত্রণা, ভালোবাসা—সুরের ভেতর সব একসঙ্গে গলে যায়।সানী জুবায়ের
সানী জুবায়ের চলচ্চিত্রেও রেখেছেন স্বতন্ত্র স্বাক্ষর। ‘ঘাসফুল’ দিয়ে শুরু, এরপর ‘আঁখি ও তার বন্ধুরা’, ‘কালের পুতুল’ ও ‘অনিল বাগচীর একদিন’। একসময় সুইডেন থেকে দেশে ফিরে আন্তর্জাতিক সংগীত ইনস্টিটিউট গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে একই সঙ্গে শেখানো হবে উপমহাদেশীয় ও পাশ্চাত্য সংগীত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় সব প্রস্তুতিও ছিল। ‘ফান্ড ছিল, পরিকল্পনাও ছিল। কিন্তু সরকারের আমলারা সেটা নিতে চায়নি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সব আটকে দিল,’ ক্ষোভের সঙ্গে বললেন তিনি। ‘এটা শুধু আমার স্বপ্ন নয়, দেশের জন্যও ছিল বড় সুযোগ।’
একসময় সুইডেন থেকে দেশে ফিরে আন্তর্জাতিক সংগীত ইনস্টিটিউট গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে একই সঙ্গে শেখানো হবে উপমহাদেশীয় ও পাশ্চাত্য সংগীত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় সব প্রস্তুতিও ছিল। ‘ফান্ড ছিল, পরিকল্পনাও ছিল। কিন্তু সরকারের আমলারা সেটা নিতে চায়নি।
আজও প্রতিদিন সংগীত
‘সংগীত শুধু গাওয়ার জন্য নয়, এটা আত্মচর্চা,’ বললেন সানী জুবায়ের। ‘আমি কানাডায় আছি, কিন্তু সংগীত তো প্রতিদিন আমার সঙ্গেই থাকে। শিখি, শেখাই। দারুণ আছি এখানে’ বাংলাদেশের এক প্রবীণ সংগীতজ্ঞ বলেছিলেন, ‘সানী জুবায়েরের মতো শিল্পীরা নিভৃতে কাজ করেন, তাঁদের সৃষ্টি অনেক দূর পর্যন্ত ধ্বনি তোলে।’ জুবায়ের আরও বলেন, ‘আমার দেশ তো বাংলাদেশই। এখানে স্থায়ীভাবে থাকলেও প্রয়োজনে, বেড়াতে বাংলাদেশে তো যাবই। কিন্তু একটা কথা—ফুল তো সেই বাগানেই ফোটে, যেখানে আলো পড়ে।’ অদ্ভুত সুন্দর এ উত্তর যেন তাঁর জীবন আর সংগীতের সারাংশ। সানী জুবায়ের, বাংলা সংগীতের নিভৃত সৌরভ। তিনি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না কেন—কণ্ঠে, সুরে, ছায়ায় তিনি ছড়িয়ে থাকেন সর্বত্র।