‘আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে, ভোরের আলো মেঘের ফাঁকে ফাঁকে’ খালি কণ্ঠে গাওয়া আবিদের গানের আওয়াজ এখনো শুনতে পাই! শুনতে পাই ‘কারে দেখাব মনের দুঃখ গো আমার বুক চিরিয়া...।’ সেদিন শীতের রাত, কুয়াশাজড়ানো নদীর বুকে পটুয়াখালীগামী লঞ্চে ছিলেন আবিদ। কেবিনে সারা রাত আড্ডা, একের পর এক গান শুনিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ, লালন থেকে রাধারমণ ছিল সেই তালিকায়। আজ সেই রাতের কথা মনে পড়ছে।
সত্যিকার গানপাগল মানুষ ছিলেন আবিদ। ‘ক্লোজআপ ওয়ান তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতায় ‘পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে পাগল আমার মন জেগে ওঠে’ গানটি গেয়ে আলোচনায় আসেন খুলনার ছেলে আবিদ শাহরিয়ার, পোশাকি নাম মিনা আবিদ শাহরিয়ার। বাবা মিনা মিজানুর রহমান, মা রমা রহমান। গান দিয়ে মানুষের মন জয় করেছিলেন আবিদ। প্রতিযোগিতায় বাংলা চলচ্চিত্রের গান পর্বে আবিদ গেয়েছিলেন, ‘আমি সাত সাগর পাড়ি দিয়ে কেন সৈকতে পড়ে আছি/ কোন অশ্রুভেজা স্বপনে মনে তাজমহল গড়েছি...’। তারপর এমন এক শ্রাবণের দুপুরে সাগরে যান তিনি। সেখানে থেকে আর নিজের ইচ্ছায় ফেরেননি। একসময় সৈকতে পড়েছিল তাঁর নিথর দেহ, ঢাকায় ফিরেছেন কফিনে। কাফনে জড়ানো আবিদ ফিরে গেছেন তাঁর জন্মভূমিতে, খুলনায়।
সেদিন সমুদ্র থেকে ফিরে এলে, আর কোনো বিপদ না ঘটলে আজ আবিদের বয়স ৩৭ বছর পূর্ণ হতো। ১৯৮৬ সালের ১৮ জুলাই খুলনায় প্রথম কেঁদেছিলেন আবিদ। সেটি ছিল জন্মদিনের স্বাভাবিক কান্না। এই শ্রাবণেই তিনি সবাইকে কাঁদিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন। ২০১১ সালের ২৯ জুলাই শেষবারের মতো পৃথিবীর বাতাসে নিশ্বাস নেন ও ছাড়েন আবিদ। ফেসবুকে আজ নানাজনের স্মৃতিতে ফিরে এসেছেন আবিদ। এ কথাগুলো আজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানাভাবে বলছেন আবিদের ফেলে যাওয়া বন্ধু, সহশিল্পী, ভক্ত আর স্বজনেরা। আবিদের বন্ধু, কণ্ঠশিল্পী পুতুল লিখেছেন, ‘প্রিয় আবিদ, তোর অনুপস্থিতিতে তোর ১২তম জন্মদিন! এক যুগ ধরে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা নিয়েই যাচ্ছিস। ঋণ কিন্তু বাড়ছে তোর। ভালোবাসা বন্ধু আমার। শুভ জন্মদিন...।’
সব আড্ডায় মধ্যমণি হয়ে যেতেন আবিদ গান গেয়ে ও কথা বলে। নিজে হাসতে জানতেন, আরেকজনকে হাসাতে পারতেন। অপরের দুঃখে সমব্যথী হতেন।
মনে পড়ে প্রথমবার আয়োজিত ‘ক্লোজআপ ওয়ান তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতার কথা। সেবার শীর্ষ ১৬ জন প্রতিযোগী নিয়ে প্রশিক্ষণশিবিরের (গ্রুমিং সেশন) আয়োজন করেন আয়োজকেরা। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, একটি ছেলে সবার থেকে আলাদা। নম্র, বিনয়ী ও হাস্যোজ্জ্বল। শিশুসুলভ সারল্য ছিল তাঁর।
লেখাপড়ায় মেধাবী ছিলেন। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফলাফল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেও দেখা যেত আবিদের উজ্জ্বল উপস্থিতি। ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ বা চারুকলা অনুষদের করিডরে। ক্লাস শেষে প্রায় সময় চারুকলায় আসতেন, আবিদের প্রিয় এক বন্ধু পড়তেন সেখানে। সব আড্ডায় মধ্যমণি হয়ে যেতেন আবিদ গান গেয়ে ও কথা বলে। নিজে হাসতে জানতেন, আরেকজনকে হাসাতে পারতেন। অপরের দুঃখে সমব্যথী হতেন। কত দিন তাঁকে দেখা গেছে অসহায় কোনো মানুষের জন্য কথা বলতে, নিজের মতো পাশে দাঁড়াতে।
সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আবিদের বেড়ে ওঠা। আবিদ গান শিখেছেন খুলনার প্রদীপ রাহা, নারায়ণ চন্দ্র রায়, সাধন রঞ্জন ঘোষ ও ভারতী ঘোষের কাছে। ঢাকায় মিতা হকের কাছেও শিখেছেন কিছুদিন। খুব স্নেহ করতেন মিতা হক। ছায়ানটের রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সম্মেলনের রবীন্দ্রসংগীত প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম, মানে প্রথম হয়েছিলেন।
সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার বীণা সিক্রি। এ প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার পুরস্কার হিসেবে তিন মাস পরই ভারতীয় হাইকমিশন থেকে একটি সম্মাননা দেওয়া হয় আবিদকে।
নানা গুণের মানুষ ছিলেন আবিদ। কয়েক ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে জানতেন। হাতের লেখা ছিল খুব সুন্দর।
লেখার হাতও ছিল ভালো। একুশে বইমেলায় পাঠসূত্র প্রকাশনা থেকে একটি উপন্যাসও প্রকাশ পেয়েছিল আবিদের। বেশ মনোযোগ দিয়ে পরিশ্রম করে বইটির কাজ করেছিলেন। শুরু করেছিলেন আরেকটি উপন্যাস লেখার কাজ। নিজেই বইয়ের প্রচ্ছদ পরিকল্পনা করেছিলেন। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়ে মামুনুর রশীদের পরিচালনায় ‘সুন্দরী’ নাটকে অভিনয় করেন। নতুন গানের সুরের প্রতি তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। প্রায়ই বলতেন, ‘গান করার চেয়ে সুর করতে বেশি ভালো লাগে, সৃষ্টির আনন্দ পাই।’
৩৭ বছর কী আর এমন বয়স? তা–ও পূর্ণ করে যেতে দেয়নি তাঁকে মহাকাল। আক্ষরিক অর্থে মৃত্যুকে জয় করার উপায় না থাকলেও নানাভাবে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে ওঠেন কেউ কেউ। গড়ে ওঠার জন্য খুব অল্প সময় পাওয়া আবিদ হয়তো সংগীতের ক্ষেত্রে এমন কোনো মৌলিক সৃষ্টি রেখে যেতে পারেননি, নিজের মেধার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটাতে পারেননি, যা তাঁকে দীর্ঘদিন মানুষের মনে বাঁচিয়ে রাখবে। কিন্তু মানুষ হিসেবে আবিদ এবং অল্প সময়ে তাঁর যে মেধা ও মননের পরিচয় মিলেছে; মানুষ হিসেবে যতটা প্রকাশ নিজেকে করতে পেরেছেন; সেই বিচারে ধরে নেওয়া যায়, আবিদ মৃত্যুঞ্জয়ী এক তরুণ। শুভ জন্মদিন আবিদ!
(এ লেখার কিছু অংশ প্রথম আলোতে আবিদকে নিয়ে প্রকাশিত ফিচার থেকে নেওয়া)