সংগীতজীবনে তিনি অসংখ্যবার প্রথম আলোকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন
সংগীতজীবনে তিনি অসংখ্যবার প্রথম আলোকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন

বিউটি, সালমাদের নিয়ে সেই সাক্ষাৎকারে যা বলেছিলেন ফরিদা পারভীন

যাঁর কণ্ঠের মাধুর্যে মুগ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ, লালনের গানের প্রসঙ্গ উঠলে প্রথমেই বাঙালির কানে ভেসে উঠত যাঁর কণ্ঠস্বর, দীর্ঘ সংগীতজীবনে যিনি লালনের গানকে বিশ্বপরিসরে পৌঁছে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের লালনসংগীতের সঙ্গে যাঁর নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে, সেই ফরিদা পারভীন আর নেই। গত শনিবার রাত ১০টা ১৫ মিনিটে ঢাকায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। দীর্ঘদিন ধরে কিডনি রোগের জটিলতায় ভুগছিলেন ফরিদা পারভীন। ৫০ বছরের বেশি সময়ের সংগীতজীবনে তিনি অসংখ্যবার প্রথম আলোকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। ২০০৭ সালের ৭ জুন প্রথম আলো আনন্দ পাতায় প্রকাশিত তাঁর একটি সাক্ষাৎকার আবার প্রকাশ করা হলো।
প্রশ্ন

প্রথমেই জানতে চাইব, লালন আখড়ার বাউলদের সঙ্গে আপনার গায়কির তফাতটা কোথায়? অনেকে বলেন, কোথায় যেন একটু দূরত্ব...

ফরিদা পারভীন: আখড়ার শিল্পীরা পুরোদস্তুর ভাববাদী। তাঁরা ভাবকে প্রাধান্য দিয়ে গান করেন। সুরটাকে খুব একটা বেশি প্রাধান্য দেন না। আমি ভাবটাকে কেন্দ্র করে সুরে লাগিয়ে গান গাই। নিজের ভেতর গানের কথা অনুভব করার চেষ্টা করি। বলতে পারেন, আমি সুরটাকে বেশি প্রাধান্য দিই।

প্রশ্ন

কিন্তু লালনের গান তো ভাববাদী। আপনি সুরের ওপর প্রাধান্য দেন...

ফরিদা পারভীন: অবশ্যই লালনগীতি ভাববাদী। এ জন্যই তো গানটাকে আগে নিজের ভেতর নিই। কথা অনুভব করি। পরে সেটা গাই। আসলে সুরে গাইলে বেশি ভালো লাগে। শ্রোতারা সহজে নিতে পারে। শ্রোতাশ্রুত হয়। আর ভালো লাগলে মানুষ বুঝবে। বুঝলে সে নিজের ভেতর ধারণ করবে।
আসলে আমি সংগীত শিখে এসেছি। শৈশবে নজরুলসংগীতের ওপর তালিম নিয়েছি। সংগীতের সরগম আত্মস্থ করেছি। সরগম হলো গানের ভাষা। একটা ভাষা শিখতে হলে তো আগে বর্ণ শিখতে হবে। বর্ণ জানলে ভাষাটা সহজ হয়। সরগম গানের ভাষা বোঝার সেতু। আমি এ সেতু পাড়ি দিয়েছি ওস্তাদের হাত ধরে। গানের ভাষা বুঝে এসেছি। একটা উদাহরণ দিই। একজন গ্রামের দক্ষ ডাক্তার রোগীর রোগ দেখবেন তাঁর মতো করে। চিকিৎসা করবেন তাঁর সীমাবদ্ধতার ভেতর থেকে। কিন্তু একজন এমবিবিএস ডাক্তার রোগটাকে তাঁর শেখা জ্ঞান দিয়ে বিচার করবেন। আমার অবস্থা এই ডাক্তারেরই মতো।

আমার জন্মই হয়েছিল লালনগীতির জন্য। আমি খুব সাধারণ পরিবার থেকে এসেছি। বাবা সরকারি চাকরি করতেন। কুষ্টিয়াতে। ওই সময় লালনগীতি ছিল শুধু আখড়াকেন্দ্রিক। মাঝেমধ্যে যেতাম। ১৯৭৩ সালে রেডিও বাংলাদেশের ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের উদ্বোধনী দিনে আমার ওস্তাদ মোকসেদ আলী সাঁই আমাকে দিয়ে লালনের গান করান। গানটা আমার ভেতর নাড়া দেয়। ওই দিনই বুঝেছিলাম, এটা আমারই জন্য।
প্রশ্ন

তাহলে আপনি নজরুলসংগীত ছেড়ে লালনগীতির দিকে এলেন কেন?

ফরিদা পারভীন: ওপরওয়ালা আমাকে এনেছেন। এটাই আমার ঠিকানা। আমার জন্মই হয়েছিল লালনগীতির জন্য। আমি খুব সাধারণ পরিবার থেকে এসেছি। বাবা সরকারি চাকরি করতেন। কুষ্টিয়াতে। ওই সময় লালনগীতি ছিল শুধু আখড়াকেন্দ্রিক। মাঝেমধ্যে যেতাম। ১৯৭৩ সালে রেডিও বাংলাদেশের ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের উদ্বোধনী দিনে আমার ওস্তাদ মোকসেদ আলী সাঁই আমাকে দিয়ে লালনের গান করান। গানটা আমার ভেতর নাড়া দেয়। ওই দিনই বুঝেছিলাম, এটা আমারই জন্য। সাঁইজির অনুরাগে আসক্ত হয়ে পড়ি। মনে হলো, এটাই আমার আসল ঠিকানা। পরে ওস্তাদ খোদা বক্স সাঁই, ব্রজেন সাঁই, করিম সাঁইয়ের কাছে শিখেছি। এখনো শিখছি। আসলে গানের জন্য আমি অনেক কষ্ট করেছি। যার ফল এখন ভোগ করছি।

অবশ্যই লালনগীতি ভাববাদী। এ জন্যই তো গানটাকে আগে নিজের ভেতর নিই। কথা অনুভব করি। পরে সেটা গাই। আসলে সুরে গাইলে বেশি ভালো লাগে। শ্রোতারা সহজে নিতে পারে। শ্রোতাশ্রুত হয়। আর ভালো লাগলে মানুষ বুঝবে। বুঝলে সে নিজের ভেতর ধারণ করবে।
শিল্পকলা একাডেমিতে লালন উৎসবে
প্রশ্ন

অনেক দিন হলো বাজারে আপনার কোনো অ্যালবাম নেই। কারণ কী?

ফরিদা পারভীন: আমি তো অ্যালবাম করতে চাই। গান গাওয়াই তো আমার কাজ। তবে আমি অ্যালবাম প্রকাশই সংগীতচর্চা-নীতিতে বিশ্বাস করি না। গানটা আমার কাছে ইবাদতের মতো, এটা আমার আত্মার ভেতর। তাই এর প্রতি বিন্দুমাত্র অবহেলা করিনি কখনো। বরং গানের জন্য অনেক সংগ্রাম করেছি। ঢাকায় আমার কোনো ঠিকানা ছিল না। কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় এসে গান করতাম রেডিও-টিভিতে। ১৪ বছর এভাবে চলেছে। পুরান ঢাকার আলুবাজারে, পল্টনে হোটেলে থাকতাম। গান গেয়ে আবার চলে যেতাম।

প্রশ্ন

এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। সংগীত-প্রতিভা অন্বেষণে যে কার্যক্রমগুলো হয়, সেগুলোর ব্যাপারে আপনার মতামত কী?

ফরিদা পারভীন: পুরোটাই ফাঁকিবাজি। ওরা যা ইচ্ছা তা-ই করছে। মাঝেমধ্যে ইচ্ছা হয়, চিৎকার করে ওদের থামতে বলি। আমি বলব এভাবে প্রতিভাগুলো নষ্ট করা হচ্ছে। একেবারে অল্প জানা শিল্পীরা হঠাৎ করে একটা অবস্থানে চলে আসছে। যোগ্যতার বাইরে রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যাচ্ছে। যা দরকার নেই তার চেয়ে বেশি পাচ্ছে। আর এসএমএস দিয়ে তো প্রতিভার বিচার করা যায় না। এসএমএসের সাহায্যে একজন শাহনাজ রহমতউল্লাহ, ফেরদৌসী রহমান হননি, হবেনও না। এসএমএসের মাধ্যমে ক্ষণিকের আলোচিত তারকা হতে পারবে। কিন্তু ‘শিল্পী’ হওয়া অনেক বড় পরিসরের ব্যাপার। এটাকে এত হালকা মাপে পরখ করা উচিত নয়।

প্রশ্ন

বিউটি, সালমা তো আপনার একই এলাকার সন্তান। ওরা কেমন করছে?

ফরিদা পারভীন: দুজনেরই গলা মিষ্টি। কিন্তু গাইতে গেলে ঠিক সেই রকম যথাযথ গাইতে পারে না। ওদের প্রতিভা আছে; কিন্তু ওরা জ্ঞানী নয়। জানার বিষয়টা সম্পূর্ণ আলাদা। এখন ওদের শেখার সময়। সময়টাকে কাজে লাগানো উচিত।

প্রশ্ন

গান নিয়ে আপনার আগামী পরিকল্পনা কী?

ফরিদা পারভীন: নতুন বেশ কয়েকটি প্রকল্প চালু করেছি। ফরিদা পারভীন ট্রাস্টের কার্যক্রম চলছে। এ ট্রাস্টের অধীন লালনের গানের নোটেশন করে একটি স্বরলিপি বের করব। কাজও এগিয়ে গেছে। এ মুহূর্তে এটাকে আমি সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছি। আর বিটিভিতে আমি একটি অনুষ্ঠান করছি। ‘আদি অকৃত্রিম’ নামে অনুষ্ঠানটিতে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা বাউলদের নিয়ে আসা হচ্ছে। বাউলেরা তাঁদের নিজস্ব ধারায় গান করছেন। তাঁদের স্বকীয়তা বজায় থাকছে। এতে ওই গানগুলোর মৌলিকত্ব ঠিক থাকছে। ইতিমধ্যে লালনগীতি নিয়ে একটি পর্ব করেছি, যেখানে আখড়া থেকে বাউলেরা এসে গান গেয়েছিলেন।

ফরিদা পারভীন
প্রশ্ন

একটা বিষয় প্রায়ই লক্ষণীয়। জনপ্রিয় হয়ে গেলে রেডিও-বিটিভির মতো প্রচারমাধ্যমগুলোতে শিল্পীরা যেতে চান না কেন?

ফরিদা পারভীন: অন্যদের কথা জানি না। তবে আমি এ ব্যাপারে সচেতন। আমি বিশ্বাস করি, রেডিও-টেলিভিশনের জন্য আজ আমি এ অবস্থানে। আমি প্রথমে রেডিওতে গান করেছিলাম। ওখান থেকে আমার পরিচিতি, আজকের এ অবস্থান। কাজেই আমি নিয়মিত কাজ করি এই দুটি মাধ্যমে। অন্যদের কথা বলতে পারছি না। তবে একটা বিষয় সত্য যে শিল্পীদের যথাযথ সম্মানী দেওয়া হয় না বেতারে। এখনো মাত্র ৩৭৫ টাকা নিয়ে গান গাই আমি।

প্রশ্ন

নবীন অনেক শিল্পী লালনের গান গাইছেন। ব্যান্ডের শিল্পীরাও গাইছেন ভিন্ন আঙ্গিকে। আপনি ব্যাপারটাকে কীভাবে দেখছেন?

ফরিদা পারভীন: ভালো করে গাইলে তো ভালো। আখড়া থেকে শহরের ড্রয়িংরুমে অনেক আগেই লালনগীতি এসেছে। আমিই করেছি এটা। আধুনিকতার নামে আজকাল লালনের গান বিকৃত করে গাইছে। আমি ওদের বলব গানের সন্ত্রাসী। লালনের গান বিকৃত করার অপরাধে ওদের শাস্তি হওয়া উচিত। আমার মতে, লালনের গান গাওয়ার অধিকার আছে সবারই, কিন্তু বিকৃত করার অধিকার কারও নেই।

প্রশ্ন

সবশেষে ‘আমি ধূপের মতো’ শিরোনামে একটি আধুনিক গানের একক বেরিয়েছিল; কিন্তু পরে আর করা হয়নি কেন?

ফরিদা পারভীন: লালনগীতিতে পুরোপুরি আবিষ্ট আমি। ওই অ্যালবামটিও অনেকটা জোর করে আমাকে দিয়ে করানো হয়েছিল। অনেকটা পরীক্ষামূলক গান ছিল। ভয়ে ভয়ে ছিলাম কী হবে, কী হবে। পরে দেখলাম ভালোই হয়েছে। এখনো অনুরোধ আছে। ভাবছি একটা মৌলিক গানের অ্যালবাম করব।

প্রশ্ন

গান নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?

ফরিদা পারভীন: স্বপ্ন তো অনেক। মনে হয় ১৪ কোটি মানুষের ১৪ কোটি স্বপ্ন আমি দেখছি। লালনের গান যেন কখনো হারিয়ে না যায়, সেই কাজই করতে চাই। আমাদের অনেক প্রতিভাবান শিল্পী আছে; কিন্তু দিকনির্দেশনার অভাবে তারা সঠিকভাবে গাইতে পারে না। আমি তাদের শেখাতে চাই। আমার ওস্তাদের মধ্যে আমি যেমন আছি, তেমনি আমার মধ্যে তারা থাকবে। এভাবে লালনের গান বছরের পর বছর টিকে থাকবে।

ফরিদা পারভীন
প্রশ্ন

চার দশক ধরে গান করেছেন। সংক্ষেপে প্রাপ্তিটা বলবেন?

ফরিদা পারভীন: সবচেয়ে বড় পাওয়া মানুষের ভালোবাসা। এই তো গতকাল (২০০৭ সালের জুন মাসের কথা) নারায়ণগঞ্জে গিয়েছিলাম ‘লালন সাঁইজি মানবকল্যাণ কেন্দ্র’র একটা অনুষ্ঠানে। অনেক সাঁইজি এসেছিলেন। অনুষ্ঠানে আমাকে একটা সাদা শাড়ি উপহার দেওয়া হলো। এক সাঁইজি বললেন, ‘মা, এটা তোমাকেই মানায়।’এ জীবনে এটাই তো অনেক বড় পাওয়া। দেশে-বিদেশে অগণিত মানুষের ভালোবাসা আমাকে অনেকবার মুগ্ধ করেছে। বাজারে গেলে দোকানদাররা আমাকে সম্মান জানিয়ে ডাকে, ভালো জিনিসটা আমার জন্য রেখে দেয়। কোনো সিএনজি টাক্সিচালক আমাকে ‘না’ করেনি। যেখানে যেতে চেয়েছি, গেছে। মানুষের ভালোবাসা আর সম্মান অনেক বড় পাওয়া বলে মনে করছি। বাড়ি-গাড়ির শূন্যতা কখনো অনুভব করিনি। চোখ বন্ধ করে যখন গাই ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি...’ তখন মনে পড়ে যায় নশ্বর জীবনে চাওয়ার খুব বেশি কিছু থাকতে পারে না। কারণ, কোনো কিছুই তো স্থায়ী নয়।