‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ সিনেমার একটি দৃশ্য
‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ সিনেমার একটি দৃশ্য

‘আমরা নতুনেরা কী আশা করি ফ্যাব থেকে’

প্রশ্ন উঠতেই পারে কেন আমি এত হতাশার কথা বলছি? খুলেই বলি তাহলে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশের 'কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া' ও স্পেনের 'আপন এন্ট্রি' নামের দুটি ছবি যৌথভাবে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মূল পুরস্কার গোল্ডেন রয়েল বেঙ্গল টাইগার অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয়, বিজয়ীদের দেওয়া হয় প্রায় ৫০ লাখ টাকার একটি চেক। বিজয়ের মাসে দেশের জন্য কত গর্বের একটি ব্যাপার এটি! খুব স্বাভাবিকভাবেই সবাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ছবির নির্মাতা মোহাম্মদ কাইয়ুমকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানাচ্ছেন এবং ছবিটি দেখতে চাইছেন। কিন্তু নির্মাতা নভেম্বর মাসে যখন ছবিটি সিনেমা হলে মুক্তি দিলেন, তার দ্বিতীয় দিনই ছবিটি দেখতে গিয়ে আমি তেমন কোনো দর্শক পাইনি। সর্বসাকল্যে হয়তো ২০ জন ছিলেন হলে। বেচারা নির্মাতা ভীষণ গম্ভীর হয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যে যখন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এই ছবি বড়পর্দা থেকে নামিয়ে দেওয়া হলো, তখন আমার নিজেরই ভীষণ কষ্ট লাগছিল। বারবার একটি প্রশ্নই মনের ভেতর ঘুরেফিরে আসছিল—আমরা জাতি হিসেবে এ কেমন দেশ গড়ছি যেখানে ‘কুড়া পক্ষীদের স্থান নেই?’

রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত
ফ্যাব ফেস্টের পোস্টার

সেদিন থেকেই রিফর্মের প্রয়োজনীয়তা ভীষণভাবে অনুভব করছি। রিফর্ম। শব্দটির বাংলা অনুবাদ 'সংস্কার'। যেকোনো ইন্ডাস্ট্রির টিকে থাকার লড়াইয়ে রিফর্ম কিন্তু ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। চলচ্চিত্রের জন্যও তা প্রযোজ্য। আর রিফর্ম তখনই কাজ করে যখন দেয়ালে পিঠ থেকে যাওয়ার কিছু আগেই অংশীদারেরা এক হয়ে যান এবং ঘুরে দাঁড়ান। আমার মনে হয়, সেই বিবেচনায় আমরা কিছুটা দেরিই করে ফেলেছি, জরাজীর্ণতার দানব আমাদের একেবারে দেয়ালের সঙ্গে ঠেসে ধরেছে। এর দায় আসলে কার? প্রথমত, যাঁরা ক্ষমতার চেয়ারে বসে রয়েছেন, তাদের। পুরোনো সব দেয়াল ভেঙে নতুন পথ তৈরি করে দেওয়া তো দূরের কথা, অনেক ক্ষেত্রে তারা আমাদের চারপাশে নতুন দেয়াল তুলেছেন। তবে একপেশে কোনো বক্তব্য উপস্থাপন করতে আমি আজ কলম ধরিনি। এই যে গোটা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির মানুষেরা, বিশেষ করে নতুন নির্মাতারা আজ হাঁসফাঁস করছেন, তার দায় কিন্তু আরও অনেকের। ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ফিল্ম স্কুল, ক্লাব, ম্যাগাজিন, সমিতি, অ্যাসোসিয়েশন, স্টুডিও, হল মালিক, সমালোচক, এমনকি দর্শকও এর দায় এড়াতে পারেন না। অথচ ইন্ডাস্ট্রির অপরিহার্য এই অঙ্গগুলো যদি নিজ নিজ দায়িত্বে সঠিকভাবে পালন করতেন, তাহলে প্রচুর সম্ভাবনাময় ও প্রাণবন্ত একটি ইকোসিস্টেম আমরা পেতাম।

কেন এই সত্যিকারের রিফর্মের দরকার? এর উদ্দেশ্য ইনোভেশন বা উদ্ভাবনসহায়ক একটি পরিবেশ তৈরি করা। যে পরিবেশে তরুণেরা পাখা মেলে উড়তে পারবে। দক্ষিণ কোরিয়ার দিকে তাকালে দেখা যায়, নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে রীতিমতো তরুণদের আশকারা দেওয়া হয়েছে। সেই সময়েই গড়ে ওঠা নতুন ফেস্টিভ্যাল, নতুন মার্কেট, নতুন নতুন স্টুডিও, সবাই তরুণ নির্মাতাদের উৎসাহ দিয়ে বলেছে—সারা বিশ্ব তোমার খেলার মাঠ। আজ তারা সারা বিশ্বে পৌঁছে গেছে। পার্ক-চ্যান উক, বং জুন-হো, হওয়াং ডং-হুক এর মতো নির্মাতারা রীতিমতো আমেরিকা ইউরোপ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। ‘প্যারাসাইট’ নির্মাতা বং-এর সেই বিখ্যাত উক্তি—‘মাত্র এক ইঞ্চি সাবটাইটেলের ব্যবধানটুকু পেরোতে পারলেই কিন্তু বিশ্বের অসাধারণ সব চলচ্চিত্র আপনার হাতের নাগালে’, আজ পশ্চিমা পরিবেশকেরাও প্রায়ই এই উদ্ধৃতি দেন। দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার পুরোনো নীতিগুলোকে যেমন সংশোধন করেছে, সেন্সরশিপকে অনেকাংশে বিলুপ্ত করেছে, তেমন একটি সক্রিয় ‘ইকোসিস্টেম’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকারিভাবে বড় বড় বিনিয়োগও করেছে। উচ্চগতির ইন্টারনেট নিশ্চিত করেছে, অনলাইনে পেমেন্ট সহজতর করেছে। এতে দর্শক বেড়েছে, বেড়েছে বেসরকারি বিনিয়োগ।

দক্ষিণ কোরিয়ার ছবি বিশ্বমঞ্চে যে সম্মানের জায়গাটি তৈরি করেছে, এর মূল কারণ, কোরীয়দের রিফর্ম পরিকল্পনা ছিল অনেক সুদূরপ্রসারী, তারা বাহ্যিক চাকচিক্য কিংবা স্বজনপ্রীতি নয়; বরং সত্যিকারের মেধা ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করেছে। নতুন মুখদের খুঁজে বের করেছে, তাদের গড়ে তুলেছে। আমরা জাতি হিসেবে তার কতটা করছি? যে যার জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করছি কি? তাই আজকের এই পরিস্থিতির দায় এড়ানো মুশকিল।

বাংলা একাডেমিতে বসছে ‘ফ্যাব ফেস্ট–২০২২’

যেকোনো রিফর্ম মুভমেন্টের সফলতা নির্ভর করে একটি কেন্দ্রীয় বা ফোকাল প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বের ওপর। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির রিফর্মের প্রতিশ্রুতি নিয়ে খুব শিগগিরই আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে ফিল্ম অ্যালায়েন্স অব বাংলাদেশ, সংক্ষেপে 'ফ্যাব'। আমরা নতুনেরা কি আশা করি ফ্যাব থেকে? আমাদের প্রথম কিংবা দ্বিতীয় ছবিগুলোর নির্মাণ এবং মুক্তি কি আর একটু নির্ঝঞ্ঝাট হতে পারে? পরিচিত মুখগুলোর বাইরে যাঁরা, যাঁরা নতুন বা যাঁদের শিশুতোষ, প্রামাণ্যচিত্র বা অ্যানিমেশন হাতেখড়ি, তাদের অধিকার কি কেউ রক্ষা করবে? প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে হয়তো আরেকটু সময় লাগবে। তবে এই যে নানান আদর্শের, নানান ঘরানার নির্মাতারা প্রথমবারের মতন একটি প্ল্যাটফর্মে একত্র হচ্ছেন, সবাই মিলে স্বপ্ন দেখছেন, ব্যাপারটি বেশ আশা জাগানিয়া।