অভিনেত্রী মনিরা মিঠুর অভিনয় ভুবনে প্রতিষ্ঠার পেছনে তাঁর ভাইয়ের অবদান অনেক। এটা তিনি সব সময় বলেন। সেই ভাইয়ের আজ জন্মদিন। বিশেষ এই দিনে ভাইকে স্মরণ করে তিনি লিখেছেন, ‘ভাইজান, আমার এই অগোছালো জীবনে আপনাকে খুব বেশি মিস করি।’ এই অভিনেত্রীর ভাইয়ের নাম অভিনেতা চ্যালেঞ্জার। বাংলা নাটকে এখনো যাঁর অভাব প্রতি মুহূর্তে বোঝা যায়। প্রয়াত এই অভিনেতা এখনো প্রতিদিন নাটকের ছোট ছোট ভিডিও, রিলসে বারবার ফিরে আসেন। কোটি কোটি ভিউ–এর সেসব ভিডিও বলে দেয় এখনো তিনি দর্শকদের কাছে কতটা জনপ্রিয়।
ঘুরতে এসে তিনি হয়ে যান অভিনেতা। সেই গল্পটাও মজার। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল তাঁর। সেই পরিচয়ের সূত্রে একটি ঈদ নাটকের শুটিং দেখতে আসেন চ্যালেঞ্জার। সেদিন সঙ্গে ছিল তাঁর স্ত্রী ঝর্ণা। নাটকের নাম ‘হাবলঙ্গের বাজার’। শুটিং চলছিল। জাহিদ হাসান, মাহফুজ আহমেদ, শাওন, ডা. এজাজ এই নাটকে অভিনয় করেন।
একটি বিশেষ দৃশ্যের জন্য তখনো কোনো অভিনেতাকে বলেননি হুমায়ূন আহমেদ। দৃশ্যটি একজন নাপিতের। দৃশ্যটির জন্য কাকে নেবেন এই নির্মাতা? হুমায়ূন আহমেদ কিন্তু ঠিকই জানতেন কাকে দিয়ে অভিনয় করাবেন। কারণ, তিনি মনে মনে পরিকল্পনা করেছিলেন চ্যালেঞ্জারকে দিয়েই ওই চরিত্রটা করাবেন।
সেই দিনের স্মৃতি নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ প্রথম আলোয় লিখেছিলেন, ‘এই চরিত্রের জন্য কাউকে ডাকা হয়নি। কারণ, আমার মাথায় অন্য পরিকল্পনা আছে। চ্যালেঞ্জার এসেছে তার স্ত্রীকে নিয়ে নাটকের নির্মাণ দেখতে। আমার চোখ চ্যালেঞ্জারের দিকে।’ সেদিন নাপিতের সেই দৃশ্যটি শুরু করবেন এমন মুহূর্তে হুমায়ূন আহমেদ চ্যালেঞ্জারের দিকে তাকিয়ে তাঁকে ডাকেন।
হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়, ‘চ্যালেঞ্জারকে ডেকে বললাম, এসো, নাপিতের চরিত্রে অভিনয় করো। হতভম্ব হয়ে চ্যালেঞ্জার বলল, “স্যার, আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?” আমি বললাম, কোনো কথা নয়। ধুতি পরো। ক্ষুর হাতে নাও।’ প্রিয় নির্মাতা এবং সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের কথায় আর না করতে পারলেন না। ধুতি, ক্ষুর নিয়ে নেমে পড়লেন অভিনয়ে। সেই নাটকে ডা. এজাজের সঙ্গে অভিনয় করেন তিনি।
জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের নাটকে একটি মাত্র দৃশ্যে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে টিভি নাটকে অভিনয় শুরু করেন তিনি। প্রথম নাটক করেই তিনি হুমায়ূন আহমেদের মন জয় করে নেন। দর্শকেরাও তাঁর অভিনয় পছন্দ করেন। এভাবেই শুরু হয় তাঁর অভিনয়ের পথচলা।
এই নাটকের পরপরই তাঁকে এক ঘণ্টার একটা নাটকে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করার জন্য ডাকেন হুমায়ূন আহমেদ। নাটকের নাম ‘খোয়াবনগর’। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি চ্যালেঞ্জারকে। ক্যারিয়ারে অল্প সময়েই তিনি দুশর মতো নাটকে অভিনয় করেছেন। যেকোনো চরিত্রেই তিনি ছিলেন সাবলীল। নিজেকে মানিয়ে নিতেন তিনি। এই অভিনেতার আলাদাভাবে অভিনয় জানা ছিল না।
জীবন থেকে পাওয়া বিভিন্ন অভিজ্ঞতাই চরিত্রের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতেন চ্যালেঞ্জার। অভিনয় যেমন ভালো করতেন তেমনি ব্যক্তিজীবনেও তিনি ছিলেন সৎ। এই অভিনেতার মৃত্যুর পর হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, ‘সবাই বলবে, বাংলাদেশ একজন বড় অভিনেতাকে হারাল। আমি বলছি, আমরা একজন ভালো মানুষ হারিয়েছি। অভিনেতা তৈরি করা যায়। ভালো মানুষ তৈরি করা যায় না। তৈরি করা গেলে আমি ভালো মানুষ তৈরির একটা স্কুল দিতাম।’
অভিনেতা চ্যালেঞ্জার ১৯৫৯ সালের ১০ আগস্ট রাজধানীর খিলগাঁওয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে যান। ছেলে ঢাকায় থাকেন। মেয়ে থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। তাঁর বোন অভিনেত্রী মনিরা মিঠু এক সাক্ষাৎকারে জানান, তাঁর ভাইয়ের আসল নাম এ এফ এম তোফাজ্জল হোসেন। নাম পাল্টে তাঁকে চ্যালেঞ্জার বানিয়ে দেন হুমায়ূন আহমেদ।
ভাই সম্পর্কে মনিরা মিঠু সেই সাক্ষাৎকারে আরও বলেছিলেন, ‘আমার জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া আমার ভাই। তিনিই আমাকে ছোট থেকে বড় করেছেন। আমাকে মানুষ করেছেন। আমার বাবা-মা সবই ছিলেন তিনি। ভাইকে হারিয়ে মনে হয় মাথার ওপর থেকে সব ছায়া সরে গেছে। এখনো নিজেকে শূন্য মনে হয়।’
টিভি ও চলচ্চিত্র মিলিয়ে আট বছরে চ্যালেঞ্জারের কাজের সংখ্যা দুই শতাধিক। তাঁর অভিনীত সিনেমাগুলোর মধ্যে শহীদুল ইসলাম খোকনের ‘লাল সবুজ’, হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’, আমজাদ হোসেনের ‘কাল সকালে’ উল্লেখযোগ্য। অভিনেতা চ্যালেঞ্জার ২০১০ সালের ১২ অক্টোবর মারা যান।