জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর

আদিবাসী ঐতিহ্যের মিলনমেলা

হুঁকা টানছেন পরিবারের কর্তা। কোরান পড়ছেন গৃহকর্ত্রী। তাঁর বাঁপাশে দোলনায় ঘুমন্ত শিশু। ডানপাশে প্রহরী দাঁড়ানো। প্রত্যেকের হাতেই অভিজাত্যের প্রতীক সুদৃশ্য হাতপাখা। এ ছাড়া পাউডারদানি, পুস্তক আবরণী, কাঙ্গা (চিরুনি), টুপি, দুগ্ধ মন্থনকারী যন্ত্র সংরক্ষিত আছে। এটি পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের আদিবাসীদের জীবনের একটি চিত্র। দুচোখে মুগ্ধতা নিয়ে ভাস্কর্যটি দেখছিল আট বছরের আবদুন নাফি। সে ঢাকা থেকে বেড়াতে এসেছে ফুফুর বাসায়। এখানে কেন এসেছ— প্রশ্ন করতেই চটপট উত্তর দিল, ‘বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্য দেখতে জাদুঘরে এসেছি।’আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরে এসে অনেক কিছুই দেখেছে সে। বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক ঐতিহ্য দেখে তার বিস্ময়ের শেষ নেই। জাদুঘরের সহকারী পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মুহাম্মদ আবদুল বাতেন বলেন, এশিয়া মহাদেশে কেবল দুটি জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর রয়েছে। একটি জাপানে অন্যটি বাংলাদেশে। চট্টগ্রামে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৪ সালে। এখানে রয়েছে বাংলাদেশের ২৭টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। পাশাপাশি পাকিস্তান, ভারত, অস্ট্রেলিয়ার কয়েকটি জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে বৈচিত্র্যময় আয়োজনে। বিশেষায়িত জাদুঘর হওয়ায় দেশ-বিদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উপকরণ এনে এটিকে আরও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নেওয়া যায়। এজন্য জাদুঘরবান্ধব মানুষ দরকার। জাদুঘরে ঢোকার পথে রয়েছে টিকিট কাউন্টার। তার সঙ্গে লাগোয়া ছোট্ট বইয়ের তাকে পাওয়া যায় জাদুঘর সম্পর্কিত নির্দেশিকা। বামপাশের দেয়ালে রয়েছে নিগ্রয়েড, ককেশয়েড, মঙ্গোলয়েড, অস্ট্রালয়েড নরগোষ্ঠীর অসংখ্য ভাস্কর্য। ডানপাশের দেয়ালে ঝোলানো আছে বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অবস্থান নির্দেশক মানচিত্র। একপাশে রয়েছে চাকমাদের মাচাঘর।জাদুঘরের ছোট্ট মিলনায়তনে সজ্জিত আছে গারো, সাঁওতাল, কোচ, হাদি, পলিয়া, খাসিয়া, মণিপুরি, মান্দাই, ওঁরাও, বোনা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, চাক, মুণ্ডা, হাজং, লুসাই আদিবাসীদের ব্যবহার্য বাহারি নকশার সব অলংকার। ১ নম্বর গ্যালারি দিয়ে ঢুকতেই দেখা হলো বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সঙ্গে। এখানে সংরক্ষিত আছে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য কবি, শিল্পী এবং সাত বীরশ্রেষ্ঠের অলোকচিত্র। পাকিস্তান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর ব্যবহূত সামগ্রী সহজেই নজর কাড়ে। গাছের বাকল দিয়ে তৈরি সুদৃশ্য চিত্র ও মেয়াস (বর্শানিক্ষেপক), কাঠের থালায় ফুটে উঠেছে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের স্বতন্ত্র জীবনধারা। আরও রয়েছে বাংলার গ্রামজীবনের নানা রকম আলোকচিত্র। মারফতি ভাবধারার মুসলমানদের ঘটা করে ওরস পালনের দৃশ্য, কুমারদের মৃত্পাত্র, ধান কাটার উত্সব, জেলেদের মাছশিকার এবং শীতে খেজুর রস সংগ্রহের দৃশ্য দেখে মনে হবে—হারিয়ে যাই আবার গ্রামে। পাশে দৃষ্টি কাড়ে পাকিস্তানের কাঠের খাটিয়া এবং কাঠের শুভ্র ঘোড়া। নগরের হাজীপাড়া থেকে কামরুন নাহার বেগম এসেছেন সন্তানকে নিয়ে। বললেন, ‘ছেলেকে গ্রামীণ-জীবন ও দেশীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য জাদুঘরে নিয়ে এসেছি। নতুন প্রজন্মকে দেশের ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন করা অভিভাবকের কর্তব্য।’দুনম্বর গ্যালারিতে আছে গারো, সাঁওতাল, মণিপুরি, খাসিয়া প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর জীবনধারার চিত্র। গারোদের আদিবাস তিব্বতে। জাদুঘরে গারোদের বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র, বাদ্যযন্ত্র সংরক্ষিত আছে। গারোদের ভাষায় এগুলোর নাম তিনটাং (গিটার), বাঙচি (বাঁশি), খ্রাম ও লাতুক (ঢোল)। গ্যালারির এক স্থানে শোভা পাচ্ছে চার জন মণিপুরি রমণীর মনোমুগ্ধকর রাস নৃত্য। কলেজছাত্র আবীর হাসান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের দাপটে আদিবাসীরা কোণঠাসা। পাহাড়ের সন্তানেরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলছে। আদিবাসীদের নৃতাত্ত্বিক ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। ৩ নম্বর গ্যালারিতে সংরক্ষিত আছে মুরং, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, হাজং ও বম জনগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর পরিচিতি। জাদুঘর দেখা শেষে ওমর গণি এমইএস কলেজের ছাত্র মো. লতিফ জানান, ‘ঐতিহ্যবাহী জিনিসগুলো ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছেন বাঙালিরা। আগে নারীরা কানে বড় রিং, পুঁতির মালা পরতেন। এখানে এসে বুঝতে পারলাম—আদিবাসীদের কাছ থেকেই এসেছে এসব চমত্কার গয়না। নতুন দম্পতি সিংসা মম ও মেওয়াই প্রু মারমা বান্দরবান থেকে এসেছেন জাদুঘর দেখতে। তাঁরা বলেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষেরা দেখতে কেমন ছিলেন, তাঁদের জীবনযাত্রা কেমন ছিল—এসব দেখতে এসেছি।’ ৪ নম্বর গ্যালারিতে আছে চাকমাদের ঘরোয়া জীবনের নয়নাভিরাম ছবি। স্বামী ঘুমোচ্ছেন। স্ত্রী দোলনায় সন্তানকে ঘুম পাড়াচ্ছেন। একজন যুবতী চুলায় রান্নার কাজে ব্যস্ত। জাদুঘরের টিকিটের মূল্য ১০ টাকা। গ্রীষ্মকালীন সময় অনুযায়ী সকাল নয়টা-পাঁচটা পর্যন্ত জাদুঘর খোলা থাকে। শীতকালে সকাল ১০টা-৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। দুপুরে আধঘণ্টার জন্য বিরতি। রোববার সাপ্তাহিক ছুটি।