
আবুধাবির বিমানবন্দর সড়কের ফুডল্যান্ড ভবনের দোতলায় এবার আয়োজন করা হয়েছিল দুর্গাপূজার। গত ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এই পূজার উদ্যোক্তা ছিল কলকাতার সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তবে দর্শক হিসেবে সেখানে আমিরাতপ্রবাসী বাংলাদেশি হিন্দু নর-নারীদের ভিড় ছিল লক্ষণীয়।
দেবী দুর্গা যেন ঘরের মেয়ে। তিনি শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি ফেরেন। এরপর চারদিন মর্ত্যলোকে থেকে তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে কৈলাস ভবনে যাত্রা করেন। দেবী দুর্গার প্রতিমা বিসর্জনের পরই শুরু হয় বিজয়া দশমী। আর সিঁদুর খেলার মধ্য দিয়ে শেষ হয় এর অনুষ্ঠান। এরপর পুরুষেরা বাড়ি ফিরে একে অন্যকে আলিঙ্গন করেন। মা-বাবা বা মুরব্বিরা ছেলেমেয়েদের ধান, দূর্বা দিয়ে করেন আশীর্বাদ। তবে মিষ্টিমুখ এ পর্বের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। বিসর্জনের পরের দিন কোনো কোনো অঞ্চলে দশরার আয়োজন করা হয়। কোনো অঞ্চলে বলে মেলা। কালীপূজা পর্যন্ত শারদীয় শুভেচ্ছা বিনিময় করা হয়।
আবুধাবি বা দুবাইতে দেবীকে বিসর্জন দেওয়া হয়নি। তবে বিজয়া দশমীকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন আচার-আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয়। দেবী দুর্গাকে সিঁদুর পরিয়ে বিদায় জানান নারীরা। তাঁরা একে অন্যের কপালে সিঁদুর পরিয়ে দীর্ঘায়ু কামনা করেন।
দুবাইয়ের চন্দনা মজুমদার সুন্দর করে ব্যাখ্যা দিলেন। তিনি বলেন, দুর্গামাকে সিঁদুর রাঙিয়ে সে সিঁদুর তাঁরা কপালে মেখে দেবী দুর্গারই আশীর্বাদ নেন। চৈতী তালুকদারের সঙ্গে দেখা হলো বার দুবাইয়ের মন্দির চত্বরের এক পাশে। তাঁর কথা, সনাতন নারীরা বিশ্বাস করেন, সিঁদুর মঙ্গল বয়ে আনে নারীর জীবনে।
মিতা সাহা জানালেন, নীল পদ্মফুল সম্পর্কে। ১০৮টি মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে সমান সংখ্যক নীলপদ্ম দিয়ে দেবীর পূজা বড় চমকপ্রদ। তিনি বলেন, এই আয়োজন সমৃদ্ধির নির্দেশনা দেয়।
ইতি রায় চৌধুরীর মুখে তৃপ্তির হাসি। বললেন ‘কলাবউ’ সম্পর্কে। এর অন্য নামে নব পত্রিকা। এখানে নয় ধরনের বৃক্ষ আর লতার সমাহার। এগুলো নয় দেবীর নির্দেশক। ইতি বলেন, একসঙ্গে হয়ে যায় নয় দেবীর পূজা।
শিবানী রায়কে চুপচাপ মনে হয়েছিল। না, মুখ খুললেন। তিনি বলেন, কুমারী পূজা নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন।
আবুধাবিতে শম্পা মিস্ত্রি দাঁড়ানো ছিলেন মন্দিরের সামনে ঠিক পুব দিকে। সন্তানদের নিয়ে এসেছেন তিনি। বললেন, পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। মানুষের ভিড়কে তিনি মিলনমেলা হিসেবে বর্ণনা করলেন।
মন্দিরের দেয়ালে দুলছে যামিনী রায়, নন্দলালের ছবি। তরুণী মায়েরা তুলির আঁচড়ে কিছু সৃষ্টি ও উপস্থাপন করেছেন। একটি ছবিতে অঙুলি নির্দেশনা দিয়ে আয়োজকের একজন উল্লেখ করছেন তুলি শিল্পীর নাম। তিনি মৌসুমী মুখার্জী। তিনি জানালেন, ওই ছবিটি যামিনী রায়ের। এর ওপরে সিঁদুর রাঙানো হয়েছে। মৌসুমী বলেন, বড় শ্রমের ফসল এখানকার ছবি। দর্শকেরা অনেকে ছবিগুলো দেখছেন তখন।
বাংলাদেশে কিশোরেরা টই টই করে বেড়ায় এ মন্দির-সে মন্দির। আবুধাবিপ্রবাসী পূজা, সুম্মিতা, ঊর্মি, দিশা হয়তো সেভাবে ঘুরতে পারেনি। তবে নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্বের আলাপ চালিয়ে যেতে পেরেছে তারা।
সুস্মিতার চোখে গণেশের পেটটা হাসি থামাতে পারেনি অনেকের। ঊর্মি বলল, এমন আনন্দভ্রমণ সব সময় হয়ে ওঠে না। অন্যদিকে দিশার কাছে ভালো লেগেছে গণেশের বাহন ইঁদুরটি।
পূজার প্রকাশে অনেক হাসি। বলল, খুবই উপভোগ্য হয়ে উঠেছে পূজার উত্সব।
পূর্বা, দূর্বা; ওরাও শামিল হয়েছে পূজায়। অন্যদের মতো নতুন জামা পরার আনন্দ তাদের। পূজাতে দুজনেরই ভালো লেগেছে ছোটদের গান আর নাচ। উলুধ্বনির প্রতিযোগিতা ছিল তাদের কাছে নতুন। কে কতটুকু মিষ্টি করে উলুধ্বনি দিতে পারে, এরও পাল্লা! বড় অদ্ভুত মনে হয়েছে তাদের কাছে। বিষয়টি ছোটরা উপভোগ করেছে।
লাকী হালদার বলেন, পূজা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক। দুর্গা উত্সব মেলবন্ধনের। তিনি আরও বলেন, বিজয়ায় ছোটদের ধান, দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ একটি বহমান চর্চা। এ অনুশীলন মনকে ইতিবাচক প্রভাব আনে।
আবুধাবি ও দুবাই দুই জায়গাতেই দর্শনার্থীদের ভিড় ছিল উপচে পড়ার মতো। তবুও নর-নারী হেঁটেছেন, পূজা দেখেছেন, দীর্ঘ কাফেলায় মানুষের সঙ্গে মত বিনিময় করেছেন। এতে পরস্পর পেয়েছেন মনের প্রশান্তি।
ঝাঁঝ, শঙ্খ, ঘণ্টা, ঢাকের বাদ্যে তাদের দোলা দিয়েছে পূজার দিন কয়টিতে। আরতিতে তাঁরা অন্য রকম আনন্দ পেয়েছেন। সব দেশে বিজয়া দশমীতে পারস্পরিক শুভেচ্ছা প্রকাশের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে দুর্গা উত্সব।
নিমাই সরকার
আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত