বাদ্যযন্ত্র হাতে গানপাগল কিছু মানুষ, প্রাণোচ্ছল দর্শক আর একসঙ্গে সবার গলা মেলানো গান—শেষ কবে এই তিনের মিশেল উপভোগ করেছেন? কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী নিশ্চয়ই এই প্রশ্ন শুনে স্মৃতিকাতর হবেন। প্রায় দেড় বছর ধরে ক্যাম্পাস বন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নানা উৎসব-আয়োজনে গানের আসর যেখানে খুব স্বাভাবিক বিষয় ছিল, সেটাই এখন ‘দূরের স্মৃতি’ মনে হয়।
আপাতদৃষ্টে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সঙ্গে ব্যান্ডের গানের সম্পর্কও দূরের মনে হতে পারে। কিন্তু সত্যিই কি তা–ই? আমাদের দেশের কনসার্টগুলোর একটা বড় অংশই ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক। দেশের নামী ব্যান্ডগুলো যেমন সানন্দে শিক্ষার্থীদের আমন্ত্রণে সাড়া দেয়, তেমনি ক্যাম্পাসের নিজস্ব ব্যান্ডগুলোও মুখিয়ে থাকে কনসার্টের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুরা একসঙ্গে গান করতে করতে বেড়ে উঠেছে, ক্যাম্পাসের গণ্ডি ছাপিয়ে এক সময় সারা দেশে পৌঁছে গেছে, এমন নিদর্শনও পাওয়া যাবে অনেক। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেঘদল কিংবা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিরোনামহীন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যান্ডের গানের একটি নিয়মিত আয়োজন—সোডিয়াম বাতির গান। এর অন্যতম আয়োজক ফাহাদ আল মাহমুদ বলছিলেন, ক্যাম্পাসের একটা ব্যান্ড সবচেয়ে বড় যে সুবিধা পায়, তা হলো আশপাশের মানুষের সমর্থন। যেটা শুরুর কঠিন সময়টা সহজ করে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুমুখী সংস্কৃতিও একটা ব্যান্ড গড়ে ওঠার পেছনে বিশেষ অবদান রাখে। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রেসিডেন্ট মুকিত আল আলিমের বক্তব্য, ‘আমার মতে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনটাই একটা ব্যান্ডের বেড়ে ওঠার সময়। তাই আমরা সব সময় নিজেদের ব্যান্ডগুলোকে পারফর্ম করার সুযোগ দিতে চেষ্টা করি। আমাদের এখানে যেমন বেশ বড় করে ইন্টার ইউনিভার্সিটি আনপ্লাগড হয়। এ ছাড়া বসন্ত উৎসব, বৈশাখের আয়োজনসহ সব অনুষ্ঠানেই ব্যান্ডগুলো পারফর্ম করে।’
দীর্ঘ বন্ধে ক্যাম্পাসের ব্যান্ডগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ল? অনলাইনে পড়ালেখার মতো কি দল বেঁধে গানের চর্চাও চলছে? নাকি ধুলা জমেছে গিটারে? খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম আমরা।
‘আমাদের ব্যান্ডটা আসলে ওভাবে দাঁড়ানোর সুযোগই পায়নি। ক্যাম্পাসে কয়েকটা শো করার পরই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। ব্যান্ডের সদস্যরা যে যার বাড়ি চলে গেছে। একেকজন একেক জেলার। তাই কোনোভাবেই প্র্যাকটিসটা ধরে রাখতে পারিনি,’ বলছিলেন ক্র্যাকপট ব্যান্ডের গিটারিস্ট ইজাব মাহমুদ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ব্যান্ডের যাত্রা শুরু করলেও এখন তাঁদের সেই স্বপ্ন ফিকে হয়ে আসছে।
ঢাকার ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পথচলা শুরু হয়েছিল সোলমেট শ্যাল ডাই ব্যান্ডের। মুঠোফোনে ব্যান্ডের বেজিস্ট রিভনাত রেহাত বলছিলেন, ‘বিধিনিষেধের কারণে আমাদের মৌলিক গানের রেকর্ডিং এখনো শেষ করতে পারিনি। গানের কম্পোজিশন অনেক আগে শেষ হলেও স্টুডিও রেকর্ডিং এখনো শুরুই করা যায়নি। আর লাইভ শো তো পুরোপুরিই বন্ধ।’
করোনাকালের হতাশাকে পাশ কাটিয়ে কীভাবে একটা ব্যান্ড নিজেদের সক্রিয় রাখতে পারে জানতে চেয়েছিলাম রিয়াসাত আজমির কাছে। তাঁর দুটো পরিচয়। একদিকে তিনি আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (এআইইউবি) প্রভাষক, অন্যদিকে ‘আরেকটা রক ব্যান্ড’-এর ভোকাল। বললেন, ‘একটা কথা মনে রাখা দরকার, ব্যান্ড মানেই কিন্তু শুধু পারফর্ম করা নয়। ব্যান্ড শো, কনসার্ট ইত্যাদি যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ, ভিন্নভাবেও ব্যান্ডগুলো নিজেদের কার্যক্রম চালু রাখতে পারে। ব্যান্ডের সদস্যরা নিজেদের দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারে। এই সুযোগে গানের প্রোডাকশনটা শিখে নিতে পারে; কম্পোজিশন এগিয়ে নিতে পারে। তবে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় আমি যেটা মনে করি, সেটা হলো গান শোনা। নানা ধরনের গান খোঁজা, শোনাও একজন মিউজিশিয়ানের কাজ।’
যেখানে আরও বছরখানেক ক্যাম্পাসে গান করার পরিকল্পনা ছিল, সেখানে ক্যাম্পাসে পা না রেখেই শেষ হয়ে যাচ্ছে অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন। পেশাজীবনেও ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কেউ কেউ। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ব্যান্ড ব্ল্যাকআউটের গিটারিস্ট শাহরিয়ার পারভেজ বলছিলেন, ‘একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার সুবাদেই আমরা একসঙ্গে ব্যান্ড গড়েছিলাম। ক্যাম্পাসের অনেক কনসার্টে নিয়মিত পারফর্ম করেছি। কিন্তু এখন তো সবই বন্ধ। বন্ধের মধ্যেও কয়েকজনের গ্র্যাজুয়েশন শেষ। এখন ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। আর্থিক নিশ্চয়তা নিয়েও তো ভাবতে হচ্ছে এখন। তাই সব খুলে গেলেও ব্যান্ডটা আর ফিরবে কি না জানি না।’
এত হতাশার মধ্যেও কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে অনলাইনের বদৌলতে। কয়েকটি ব্যান্ড করোনাকালে ফেসবুক লাইভ বা ইউটিউবে সরব থেকেছে। যে যার জায়গায় বসে নতুন গান নিয়েও কাজ করছে কেউ কেউ। বিশ্ববিদ্যালয় খুললে আবার ক্যাম্পাস মাতাবেন, সেই অপেক্ষায় আছেন তাঁরা।
ব্যাপারটাকে আসলে আরও একটু বড় পরিসরে দেখা প্রয়োজন। একটা ব্যান্ডের টিকে থাকার জন্য যেমন অধ্যবসায়, গানের প্রতি ভালোবাসা দরকার; তেমনি পর্যাপ্ত আর্থিক সুবিধারও প্রয়োজন আছে। মিউজিক করতে সময় ও অর্থ দুই–ই জরুরি। এ দেশে তো সবাই বিনা মূল্যে গান শুনে অভ্যস্ত। লাইভ কনসার্ট ছাড়া আয়ের তেমন কোনো উৎস মিউজিশিয়ানদের নেই। পুরো ব্যাপারটিকে একটা পলিসির আওতায় আনতে হবে। মিউজিশিয়ানদের আর্থিক প্রয়োজনটা নিশ্চিত করা না গেলে বিধিনিষেধ কিংবা মহামারির প্রকোপ ছাড়াও অনেক ব্যান্ড এমনিতেই হারিয়ে যাবে।জিয়াউর রহমান, বেজিস্ট, শিরোনামহীন