পোশাকের সাজে নকশিকাঁথার বুনন। মডেল হয়েছেন অভিনেত্রী সুনেরাহ্‌ বিনতে কামাল
পোশাকের সাজে নকশিকাঁথার বুনন। মডেল হয়েছেন অভিনেত্রী সুনেরাহ্‌ বিনতে কামাল

চলতি ধারায় নকশিকাঁথার ফোঁড়

নকশিকাঁথা আবহমান বাংলার এক শৈল্পিক ঐতিহ্য; গ্রামীণ অবসরের প্রতিফলন। আধুনিক এ সময়ের ফ্যাশনের বুননেও যেন এটি চলতি ধারা। শাড়ি, পাঞ্জাবি, সালোয়ার–কামিজ, ফতুয়াসহ সব পোশাকেই নকশিকাঁথার একটুখানি ফোঁড় অন্য মাত্রা নিয়ে আসে। অনুষঙ্গ, ঘর সাজানোর উপকরণেও নকশিকাঁথা অনন্য।

খুবই সাধারণ এর ব্যবহৃত উপকরণ। সুই, সুতা আর পুরোনো কাপড়। এসব দিয়েই যখন তৈরি করা হয় নতুন নকশা, চোখ ফেরানোও দায় হয়ে যায়। কাঁথা সেলাই সবচেয়ে পুরোনো কারুশিল্পগুলোর একটি। ধৈর্য, নিপুণ বুননরীতি আর কাজটির প্রতি ভালোবাসা থেকেই তৈরি হয় একেকটি কাঁথা। গ্রামীণ নারীর অবসর সময়ের প্রতিফলন যেন এটি। সাধারণ কাঁথার চেয়ে এগুলো আলাদা। রং ও নকশার বুননে যেন একেকটি কাহিনি-গাথা। উপহার কিংবা অতিথি বরণের কাজেই এই নকশিকাঁথার ব্যবহার জনপ্রিয় ছিল। কাঁথার নকশা মুগ্ধ করে আসছে কয়েক শ বছর ধরে। নকশিকাঁথার নকশা বা ফোঁড় নতুন রূপে এখন চলে এসেছে নানা পোশাক, ফ্যাশনের অনুষঙ্গ এবং ঘর সাজানোর নানা পণ্যে।

পোশাকে ও গয়নায় সুই–সুতার শৈল্পিক কাজ।

কাঁথার ফোঁড়ের ধরন আছে বেশ কয়েকটি। কাঁথা, পোশাক, নানা ধরনের অনুষঙ্গের ওপর ঘুরেফিরে দেখা যায় এগুলো। একেক অঞ্চলে একেক রকম ফোঁড়। পাঁচ থেকে সাতটি ভিন্ন ভিন্ন কাপড় স্তরে স্তরে সাজিয়ে একত্রে সেলাই করে কাঁথা তৈরির কাজটি করা হতো। হালকা রঙের কাপড়গুলো বাইরের দিকে রাখা হতো ফোঁড় আর ছাঁচ বোঝানোর জন্য। ফোঁড়টি পুরো কাপড়েই দেওয়া হতো, যাতে কাঁথার গাঁথুনি শক্ত হয়। এখন এই সময়ে এসে পোশাকের পাশাপাশি বিছানার চাদর, দেয়ালের ছবি, বালিশের কভার, কুশন কভার, মানিব্যাগ, মুঠোফোনের ব্যাগ, বটুয়া ইত্যাদি জিনিসে নকশিকাঁথার ফোঁড় তুলে ধরা হচ্ছে।

কাঁথার নকশা পরিপূর্ণ দেশীয় আমেজে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে সুতি, সিল্কের শাড়ি কিংবা কামিজের ওপর জমকালোভাবে। গয়নার ওপরও দেখা যাচ্ছে। শীতের চাদর কিংবা ট্রেঞ্চ কোটেও জানিয়ে দিচ্ছে নিজের অবস্থান। কয়েক শ বছরের পুরোনো এই সূচিকর্ম বেশ আধুনিকভাবেই উপস্থাপিত হচ্ছে এখন। তালিকায় আরও আছে বাইকার জ্যাকেট, পালাজ্জো, লম্বা কাটের জামা ইত্যাদি।

নকশিকাঁথার ফোঁড়ে ট্রেঞ্চ কোট।

তবে আগে নকশিকাঁথা বলতে কাঁথাই হতো। গ্রামের ধারা অনুযায়ী নিজেদের জন্যই বানানো হতো। সেটার ফোঁড় ছিল টানা টানা। কিছু কিছু বিশেষ কাঁথা নারীরা বানাতেন, সেটা হলো বালিশ কাঁথা। স্বামীরা অন্য স্থানে কাজ করতেন। রাতে কাঁথাটা বালিশের ওপর রেখে ঘুমাতেন। তাঁদের প্রেম, ভালোবাসা, বিরহ এভাবেই প্রকাশ পেত—জানালেন প্রবর্তনার পরিচালক শাহিদ হোসেন। এই কাঁথার ফোঁড়গুলো আবার রুমালেও ফুটিয়ে তোলা হতো। গ্রামীণ জীবনের সুখ–কান্না, ভালোবাসা সব আবেগই তুলে ধরা হয়েছে নকশিকাঁথার মাধ্যমে। শাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমার খালাদের দেখতাম শাড়ির পাড়ে কাঁথার নকশা করতেন। এটা সে সময় বেশ আধুনিক ছিল।’ নকশিকাঁথার কাজ নতুনভাবেও সামনে আনা হচ্ছে। টাইডাই, ছাপা নকশা, প্যাচওয়ার্কের ওপর নানা ধরনের নকশিকাঁথার কাজ নজর কাড়ে এখন।

পোশাক: চল

কাঁথার বাইরেও যে সুতার এই নকশা অন্য কোনো অনুষঙ্গে তুলে ধরা যায়, তা দেখিয়ে দেয় আড়ং। ফ্রেম করে দেয়ালে ঝোলানোর মতো ছোট–বড় নকশিকাঁথা নিয়ে আসে তারা। কুশন কাভার, টেবিল রানার ইত্যাদিতে আড়ং ও কুমুদিনী নিয়ে এল নকশিকাঁথার কাজ। এমনটাই জানালেন ডিজাইনার লিপি খন্দকার।

নকশিকাঁথার আছে অগণিত ফোঁড়। শতাধিক ফোঁড় নিয়ে কাজ করেছেন লিপি খন্দকার। এ মাধ্যমে মোটিফগুলোও বেশ মজার। পাখি, কদম ফুল, তারা, আমকলকা, ময়ূর, বাঘের থাবা, সুপারি, ডালা, কুলা, প্লেন, ট্রেন, নকশিথালা ইত্যাদি। নিজেদের চিন্তাশক্তি ব্যবহার করে গ্রামের গৃহিণীরা নকশাগুলো বের করতেন। তাঁদের জন্য এটি প্রথমে বিনোদন, তারপর প্রয়োজন। তবে বিক্রির জন্য যেসব পণ্য তৈরি করা হয়, সেগুলোতে আগে থেকেই নকশা এঁকে নেওয়া হয়। এরপর শুরু করা করা হয় সুতার কাজ।

আজকের ফ্যাশনে ঐতিহ্যের সেই ফোঁড়ই স্থান পাচ্ছে দারুণভাবে। মনে করিয়ে দিচ্ছে আবহমান বাংলার এক অনবদ্য শৈল্পিক উপাদানের কথা।