ডিজাইনারদের স্বপ্নের কথা

প্রথম আলোর আলোকিত ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতা দেশীয় পোশাকের বাজার সমৃদ্ধ করছে। পাশাপাশি পোশাকসচেতন মানুষের রুচি গঠনেও রাখছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পোশাকে বৈচিত্র্যের স্বাদ দিতে নিরলসভাবে কাজ করছেন ডিজাইনাররা। এবার রেমন্ড-আলোকিত ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতায় যেসব প্রতিষ্ঠান ও ডিজাইনার পুরস্কৃত হয়েছেন তাঁদের অনুভূতি, কাজের ধরন ও আগামী পরিকল্পনা তুলে ধরা হলো। কথা বলেছেন অনুজ দেবরাঙা টেক্সটাইল অ্যান্ড ক্র্যাফটসডিজাইনার: শাহাদাত আলী খান আদিবাসীদের সংস্পর্শে আসার সুযোগে তাঁতের বুননের বিষয়টা শাহাদাত আলী খানকে আলাদাভাবেই যেন আর্কষণ করেছিল। সেই থেকে নিজের কাজের ক্ষেত্রে তাঁতশিল্পকে বেছে নেন। ১৯৯৫ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠান রাঙা টেক্সটাইল অ্যান্ড ক্র্যাফটস যাত্রা শুরু করে। এবার তাঁর পুরস্কার পাওয়া পোশাকে তাঁত, সিল্ক ও সুতোর ওপর এন্টিকের কাজ ছিল বেশি। তিনি ২০০০ সালে আলোকিত ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রতিবারই পুরস্কৃত হয়েছেন। সালসাবিল বুটিক হাউসডিজাইনার: মোয়াজ্জেম হোসেন সৃষ্টিতেই অমৃত সুখের ছোঁয়া খুঁজে পান ডিজাইনার মোয়াজ্জেম হোসেন। প্রথম আলোর ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতায় সেরাদের সেরা হওয়ার পুরস্কার তাঁর স্বপ্নের পরিধি আরও বাড়িয়ে দেবে বহুগুণ—এরকমই মনে করেন তিনি। তাঁর ডিজাইন করা পোশাকে রাজশাহী সিল্ক, মসলিন ও এন্ডিসিল্ক ব্যবহার করেছেন। উত্সব গরমের মধ্যে পড়ায় হালকা রং ব্যবহার করেছেন বেশি। ২০০৩ সাল থেকে আলোকিত ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ছেলেদের ফতুয়ায় পান প্রথম পুরস্কার। এরপর নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন তিনি। এবার শাড়ি, ফিউশন, ফতুয়া (মেয়ে), শার্ট, যুগল পোশাক বিভাগে পুরস্কার পেয়েছে তাঁর প্রতিষ্ঠান।উইভারসডিজাইনার: ফারহানা রহমানএবার পুরস্কার পাবেন—এমনটা ভাবেননি ডিজাইনার ফারহানা রহমান। প্রত্যাশা না থাকলেও প্রাপ্তির আনন্দে তিনি খুশি। বড় বুটিকগুলোর পাশাপাশি নতুন বুটিকগুলোর পুরস্কার প্রাপ্তিতে তিনি আশান্বিত। জামদানিতে চুমকি, এমব্রয়ডারি আর কারচুপির কাজ ছিল তাঁর পোশাকে। গতানুগতিকতা থেকে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে আঁচলে ও কুঁচিতে ডিজাইন করেছেন তিনি। এ পর্যন্ত আলোকিত ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতায় পাঁচবার অংশ নিয়ে গতবার ও এবার বিজয়ী হয়েছেন।পিনন ও মিতাস বুটিকডিজাইনার: মহাচ্ছানা কোরেশী প্রথম আলোর পুরস্কার ডিজাইনার মহাচ্ছানা কোরেশীর কাছে স্বপ্নের বাস্তবায়ন। ২০০৪ সাল থেকে নিয়মিত এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রতিবারই পুরস্কৃত হয়েছেন। এবার উত্সবকে প্রাধান্য দিয়ে তাঁর কাপড়ে ব্যবহার করা হয়েছে মেরুন, কালো, ফিরোজা ও লাল রং। দেশীয় কাপড়ের মধ্যে বলাকা সিল্ক, জামদানি, মসলিন, অ্যান্ডিসিল্ক ও দোপিয়ান ব্যবহার করেছেন। ডিজাইনার হিসেবে এগিয়ে যেতে চান বহুদূর। ঘরানা বুটিক ডিজাইনার: শামীমা নবী নিতান্ত শখ থেকেই পোশাক ডিজাইনে আসেন শামীমা নবী। বললেন, ‘নিজের সুপ্ত ইচ্ছেশক্তিকে কাপড়ের ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে বেছে নিয়েছি পোশাক ডিজাইনিং।’ তাঁর ডিজাইন করা পোশাকে রাজশাহী সিল্কের ওপর চুমকি, পুতি ও লেইজের কাজ রয়েছে। রং ব্যবহার করেছেন বাদামি ও কফি। এ পর্যন্ত নয়বার অংশ নিয়ে দুবার পুরস্কার জিতেছেন তিনি। গ্লোসিডিজাইনার: মো. রাশিদুল মজিদ চৌধুরীছাত্রাবস্থা থেকেই ডিজাইনিংয়ের প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল। ১৯৯৮ সালে ঘরোয়া প্রদর্শনীর মাধ্যমে পোশাক ডিজাইনিংয়ে আসেন রাশিদুল মজিদ চৌধুরী। এবার শাড়ি গ বিভাগে যুগ্মভাবে প্রথম হয়েছে তাঁর প্রতিষ্ঠান। পোশাকে ব্যবহার করেছেন অ্যাপ্লিক, গোল্ডেন ব্লক, কারচুপি ও মেটাল। দেশীয় মোটিফে দুপিয়ান কাপড়ে পারপেল ও নীলের সমন্বয়ে কাজ করেছেন তিনি। আলোকিত ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতায় আটবার অংশ নিয়ে সাতবার পুরস্কার পেয়েছেন। শৈল্পিক ডিজাইনার: এইচ এম ইলিয়াছ‘আমাদের দেশি পোশাককে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রূপ দেওয়ার জন্যই আমার এ পেশায় আসা।’ জানালেন শৈল্পিকের ডিজাইনার এইচ এম ইলিয়াছ। আর সেরাদের সেরা হওয়ার অনুভূতিটা তাঁর কাছে সত্যিকার অর্থেই অন্যরকম আনন্দের। এবারের প্রতিযোগিতায় পাঞ্জাবি, ফতুয়া (ছেলে), ফতুয়া (মেয়ে), ফিউশন (ছেলে ও মেয়ে), শার্ট, যুগল পোশাক বিভাগে পুরস্কার জিতে নেন তিনি। তাঁর ডিজাইন করা পোশাকে মিডিয়া হিসেবে ব্যবহার করেছেন কারচুপি, হ্যান্ড পেইন্ট, কম্পিউটার ব্লক, হাতের কাজ, অ্যাপ্লিকসহ বিভিন্ন মেটেরিয়াল। সুতো, সিল্ক, এন্ডিকটন ও এন্ডিসিল্ক কাপড়ে লাল, কালো, ছাই ও সবুজ রঙের ব্যবহার ছিল। মিয়াবিবি ও তাজনুর বুটিকডিজাইনার: সুলতানা নুরজাহান কাজের স্বীকৃতি পেয়ে খুবই ভালো লাগছে—বলছিলেন মিয়াবিবি ও তাজনুর বুটিকের ডিজাইনার সুলতানা নুরজাহান। তাঁর ডিজাইন করা পোশাকে অ্যাপ্লিক, কালার প্রিন্ট, এমব্রয়ডারি ও কারচুপির কাজকে ভিন্নভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এবার শাড়ি ক, খ ও গ বিভাগের তিনটিতেই পুরস্কার পায় তাঁর প্রতিষ্ঠান। এ পর্যন্ত প্রতিযোগিতায় ছয়বার অংশ নিয়ে পাঁচবারই পুরস্কার জিতে নিয়েছেন তিনি। রূপান্তিকা বুটিকস ডিজাইনার: রোকসানা শাহরিয়ারছোটবেলা থেকেই ডিজাইনিংয়ের প্রতি রোকসানা শাহরিয়ারের আলাদা দুর্বলতা ছিল। ২০০৮ সালে অনেকটা শখের বশেই আলোকিত ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। গ্রাহকের সন্তুষ্টিই তাঁর কাছে প্রধান পাওয়া—এ লক্ষ্যেই অগ্রসর হতে চান তিনি। প্রথম আলোর পুরস্কার তাঁকে নতুন করে ভাবায়। ঈদ উত্সবটা গরমের মধ্যে পড়ায় কাপড়ের ক্ষেত্রে হালকা আর সুতোর কাপড়কে বেছে নিয়েছেন তিনি। উত্সবের দিক বিবেচনা করে উজ্জ্বল রংও কম-বেশি উঠে এসেছে। এবার সালোয়ার কামিজ খ বিভাগে দ্বিতীয় হয়েছে তাঁর প্রতিষ্ঠান।রঙিন আউটফিটডিজাইনার: আয়শা সিদ্দিকা দেশের একজন প্রতিষ্ঠিত ডিজাইনার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন আয়শা সিদ্দিকা। এলক্ষ্যে রঙিন আউটফিটের যাত্রা শুরু হয় ২০০৮ সালে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায় ভোগ ফ্যাশন ইনস্টিটিউট থেকে কোর্স করেন ২০০৭ সালে। প্যাটার্ন কাটিংয়ে ভিন্নতা এনে সবুজ, মেরুন, স্বর্ণালি ও জলপাই রঙ ব্যবহার করেছেন পোশাকে। প্রতিযোগিতায় প্রথমবারের মতো অংশ নিয়ে সালোয়ার কামিজ খ বিভাগে প্রথম এবং সালোয়ার কামিজ ক বিভাগে তৃতীয় হন তিনি।শ্রেয়া বুটিকডিজাইনার: মনিদীপা দাশ‘প্রথম আলোর পুরস্কার আমাকে আরও ভালো কিছু করার অনুপ্রেরণা জোগাবে।’ এরকমই আশাবাদী ডিজাইনার মনিদীপা দাশ। তাঁর ডিজাইন করা পোশাকে ছিল দেশীয় ঐতিহ্য। পোশাকে জামদানি, মসলিন, তাঁত ও সপুরা সিল্ক ব্যবহার করেছেন তিনি। অ্যাপ্লিক, এমব্রয়ডারি, কারচুপির কাজকে তিনি ভিন্নভাবে তুলে ধরেছেন। প্রতিষ্ঠানকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান তিনি। এনস ক্রিয়েশানস ডিজাইনার: নুরশাদ ইসলাম ‘প্রথম আলোর এ পুরস্কার আমার কাছে স্বীকৃতি ও অনুপ্রেরণার অন্যতম উত্স।’ এমনটিই মন্তব্য করেন ডিজাইনার নুরশাদ ইসলাম। দেশি সামগ্রী ও মোটিফকে প্রাধান্য দেন তিনি। তাঁর ডিজাইন করা বাচ্চাদের পোশাকে গ্রামীণ স্ট্রাইপের ওপর জরির এমব্রয়ডারি ও সুতোর কাজ রয়েছে। নরসিংদীর তাঁত ও রাজশাহী সিল্কের ব্যবহার রয়েছে তাঁর পোশাকে। প্রতিযোগিতায় প্রথমবার অংশ নেন ২০০৮ সালে। তবে এবারই প্রথম পুরস্কৃত হলেন। বাঙালি বাবু ডিজাইনার: বাবলু দাশ২০০২ সালে ক্র্যাফট ক্যাসল নাম দিয়ে ডিজাইনের জগতে আসেন বাবলু দাশ। দেশি পোশাকের বাজার সমৃদ্ধ করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। তিনি পোশাকে মিডিয়া হিসেবে ব্যবহার করেছেন হ্যান্ড এমব্রয়ডারি, মেশিন এমব্রয়ডারি, কারচুপি ও স্টোন। রং হিসেবে ব্যবহার করেছেন মেরুন, কালো, নীল ও আকাশি। এবার পাঞ্জাবি বিভাগে তৃতীয় ও ফতুয়া (ছেলে) বিভাগে যুগ্মভাবে তৃতীয় হয়েছে তাঁর প্রতিষ্ঠান। অনিন্দ্য ফ্যাশন হাউসডিজাইনার: লুত্ফা সানজিদাডিজাইন ও কোয়ালিটির ওপর গুরুত্ব দিয়ে ১৯৮৯ সালে যাত্রা শুরু করে অনিন্দ্য ফ্যাশন হাউস। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন লালন করলেও একসময় পারিবারিক প্রয়োজনেই বেছে নেন ডিজাইনিং। ২০০০ সালে আলোকিত ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার প্রাপ্তি তাঁর স্বপ্নের পরিধি বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। এবার সালোয়ার কামিজ ক বিভাগে যুগ্মভাবে দ্বিতীয় হয় তাঁর প্রতিষ্ঠান। তাঁর ডিজাইন করা পোশাকে সিল্ক ও অ্যান্ডি সিল্কের ওপর অ্যাপ্লিক ও এমব্রয়ডারির কাজ রয়েছে। রেফসিস স্টাইলডিজাইনার: রাজিয়া সুলতানা সৃষ্টিশীল পেশায় থেকে নিজের ভাবনা তুলে ধরতে চান ডিজাইনার রাজিয়া সুলতানা। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার প্রতি ঝোঁক ছিল তাঁর। প্রতিযোগিতায় প্রথমবার অংশ নিয়ে বিজয়ী হবার অনুভূতিটা তাঁর কাছে সত্যিই অন্যরকম আনন্দের। তাঁর ডিজাইন করা পোশাকে প্যাটার্নের নতুনত্বের সঙ্গে সূক্ষ্ম হাতের কাজ ফুটে উঠেছে। ড্রিম ফ্যাশন হাউসডিজাইনার: নাজমা আক্তারপোশাকে ফেব্রিক্স নির্বাচন করে তাতে রং ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যতিক্রমী মোটিফ এনে পোশাকে নতুনত্ব আনা সম্ভব বলে মনে করেন ডিজাইনার নাজমা আক্তার। শিশুদের বিভাগে এবার প্রথম হয়েছে তাঁর ডিজাইন করা পোশাক। থামি ও স্কার্ট দিয়ে তৈরি পোশাকে এন্টিক ও পুতির কাজ রয়েছে। লাল, সাদা, টিয়া, সবুজ ও মেরুন রঙের সুন্দর সমন্বয় রয়েছে পোশাকে। ডিজাইনারস ওয়ার্ল্ড ডিজাইনার: নুসরাত জাহান সিদ্দিকীমানুষের রুচি ও চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে পোশাক ডিজাইন করেন নুসরাত জাহান সিদ্দিকী। তাঁর মতে, রুচি ও চাহিদার প্রতি দৃষ্টি রাখলেই ভালো ডিজাইন করা সম্ভব। নিজের সৃজনশীল ভাবনা বাস্তবায়িত করার জন্যই এ পেশায় আসা তাঁর। তাঁর পোশাকে গুরুত্ব পেয়েছে দেশি তাঁত, বলাকা সিল্ক ও এন্ডিকটন। প্যাটার্ন পরিবর্তন করে কারচুপি, এমব্রয়ডারি ও হাতের কাজ করেছেন তিনি। প্রতিযোগিতায় দুবার অংশ নিয়ে দুবারই জিতেছেন পুরস্কার। নক্ষত্র ডিজাইনার: আশরাফুল আলমবৈচিত্র্য ও রুচির সমন্বয়ে দেশি পোশাককে সামনে আনাটাই ডিজাইনার আশরাফুল আলমের স্বপ্ন। আলোকিত ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতায় এবারই প্রথম তাঁর অংশ নেওয়া। আর তাতে বিজয়ী হবার অনুভূতিটা তাঁর কাছে অন্য রকম। এবার পাঞ্জাবিতে দ্বিতীয় ও ফতুয়া (ছেলে) বিভাগে পান প্রথম স্থান। মটকা কাপড়ের মধ্যে এমব্রয়ডারি, পাথর ও ধাতব উপকরণ দিয়ে এপ্লিকের কাজ রয়েছে তাঁর ডিজাইন করা পোশাকে। পাঞ্জাবিতে সিল্ক কাপড়ের মধ্যে কারচুপি ও মেটালের সমন্বয়ে শেরওয়ানী কাটিং স্থান পেয়েছে।