>

‘বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এক দুর্দান্ত, দুঃসাহসী স্পাই গোপন মিশন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশ-দেশান্তরে।...কোমলে কঠোরে মেশানো নিষ্ঠুর, সুন্দর এক অন্তর। একা। টানে সবাইকে, কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না।...’
তবে আধুনিক মনস্ক পাঠককে ঠিকই বাঁধনে জড়িয়েছে মাসুদ রানা—বাংলা ভাষায় লেখা স্পাই থ্রিলারের প্রধান চরিত্র। কাজী আনোয়ার হোসেনের সৃষ্টি মাসুদ রানা চলতি মে মাসে পূর্ণ করছে ৫০ বছর। ১৯৬৬ সালে ধ্বংস পাহাড় দিয়ে শুরু—দুদিন পর বের হবে মাসুদ রানার ৪৪৭তম বই দুরন্ত কৈশোর। মাসুদ রানার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ছুটির দিনের এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন।
বরিশালের বিএম কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র শামসুল হক জাহিদ। ঢাকা থেকে লঞ্চে করে বই আসার খবর পাওয়ার পর আর তর সইত না। পরদিন সকালে দোকান খুলতে না-খুলতেই গিয়ে হাজির। মাসুদ রানার বই বলে কথা! হাতে তুলে নিয়ে গোগ্রাসে গিলতে থাকা।
‘সেটা ছিল দারুণ এক রোমাঞ্চকর সময়’, স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বললেন জাহিদ। ‘মাসুদ রানার কী কাহিনি আর কী ভাষা! ভাবা যায়!’
একটু থেমে প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, এখনো কি ও রকমটাই লেখা হচ্ছে? এক শর কিছু বেশি বই পড়েছিলাম। ভার্সিটি ছাড়ার পর আস্তে আস্তে পড়া ছেড়ে দিয়েছি।’
দেশের অন্যতম অভিজ্ঞ অর্থনৈতিক সাংবাদিক ও ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের যুগ্ম সম্পাদক শামসুল হকের মতো আরও অনেকেই আজ থেকে পাঁচ দশক আগে তাঁদের উঠতি যৌবনে মাসুদ রানাকে পেয়েছিলেন, মোহিত-রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন। কিন্তু কয়জনই ভাবতে পেরেছিলেন যে কালের যাত্রায় মাসুদ রানার প্রকাশনা ৫০ বছরে উপনীত হবে? মাসুদ রানার স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেনই তা ভেবেছিলেন?
‘৫০ বছর? এক বছরও পার করতে পারব কি না, ভাবিনি’—কিছুটা হেসে বললেন কাজীদা। ‘তবে এটা মনে করেছিলাম যে কাজটা করতে পারলে ভালো লাগবে।’
তাহলে এখন কেমন লাগছে?
‘ভাগ্যিস আমি লেখা চালিয়ে গিয়েছিলাম’—জবাব দিলেন কাজীদা। ‘আর তাই তো ৫০ বছরে পূর্ণ করল মাসুদ রানার প্রকাশনা। ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে, একটা কাজের কাজ করেছি।’
দুই
সেটা ১৯৬৬ সালের মে মাস। প্রজাপতির প্রতীকসংবলিত সেবা প্রকাশনীর নামটি তখন মাত্র পরিচিতি পাচ্ছে। বাংলা প্রকাশনা জগতের প্রথম পেপারব্যাক। কুয়াশা সিরিজের তিনটি বই বের হয়েছে। তারপরই এল ধ্বংস পাহাড়, যার নায়ক মাসুদ রানা। প্রথম বাংলা মৌলিক স্পাই থ্রিলার উপন্যাস, প্রথম বাঙালি আন্তর্জাতিক গুপ্তচর বা স্পাই চরিত্র। একটা হইচই পড়ে গেল। এও কী সম্ভব বাংলা সাহিত্যে? একে তো স্পাই, তার ওপর আছে যৌনতা।
‘শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ বা বেশির ভাগই কিন্তু বলল যে ভালো হচ্ছে।’ স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বললেন কাজীদা। ‘ শতকরা ৩০ ভাগের মতে জঘন্য। বেশির ভাগ যখন নিচ্ছে তখন আমিও লেখা ও প্রকাশ চালিয়ে গেলাম।’
নিন্দা-সমালোচনার বিপরীতে উৎসাহদাতাদের মধ্যে অনেক বড় বড় মানুষও কিন্তু ছিলেন। প্রয়াত কবি আহসান হাবীবের স্নেহ পেয়েছেন কাজীদা। সমসাময়িকদের মধ্যে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, চিত্রশিল্পী হাশেম খান, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির ও প্রয়াত সাংবাদিক শাহাদত চৌধুরীর অনুপ্রেরণার কথা বিশেষভাবে বলতে হয়।
তিন
কুয়াশা লেখার পর বন্ধু মাহবুব আমিন জেমস বন্ড সিরিজের ডক্টর নো ধরিয়ে দিয়েছিলেন বিদ্যুৎ মিত্র অর্থাৎ কাজীদার হাতে। বিদ্যুৎ মিত্র ছদ্মনামেই তখন কুয়াশা সিরিজের বই বাজারে। জেমস বন্ডের বইটি পড়ার পর একাধারে চমৎকৃত, লজ্জিত ও উত্তেজিত হয়ে পড়লেন কাজীদা। নাহ। লিখলে ওই রকম বিশ্বমানের থ্রিলারই লিখবেন। পড়তে শুরু করলেন বিভিন্ন বিদেশি বই। কাহিনি সাজাতে ১৯৬৫ সালে মোটরসাইকেলে করে ঘুরে এলেন চট্টগ্রাম, কাপ্তাই ও রাঙামাটি। এরপর সাত মাস সময় নিয়ে লিখলেন ধ্বংস-পাহাড়।
এরপর ১০ মাস সময় নিয়ে লেখা হলো ভরতনাট্যম। তরুণ মহলে সাড়া পড়ে গেল। কিন্তু রক্ষণশীলরা তো মারমার করে উঠলেন। সিরিজের বই স্বর্ণমৃগ বের হওয়ার পর তো বিষয়টা গড়াল আদালত পর্যন্ত। যুবসমাজকে নষ্ট করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত যিনি, তাঁকে তো ছাড় দেওয়া যায় না। নিষিদ্ধ হলো বইটি। তাতে বোধ হয় লাভই হলো। দমলেন না কাজীদা। আর পাঠকের কাছ থেকে অবিরত তাড়া আসতে লাগল নতুন বইয়ের। যেখানে বাঙালির তো বৈশ্বিক গুপ্তচরবৃত্তির কোনো অভিজ্ঞতাই নেই, সেখানে এ ধরনের বই লেখা কী করে সম্ভব? তাই শুরু হলো ‘বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে’ বা ‘বিদেশি কাহিনির ছায়া অবলম্বনে’ লেখা, যার প্রথমটি হলো স্বর্ণমৃগ। সেই থেকে চলছে।
নিন্দুক-সমালোচকদের গালমন্দ অগ্রাহ্য করে মাসুদ রানার কাহিনি সংগ্রহ করা হয়েছে ও হচ্ছে অ্যালিস্টেয়ার ম্যাকলিন, জেমস হেডলি চেজ, রবার্ট লুডলাম, উইলবার স্মিথ, ইয়ান ফ্লেমিংসহ অসংখ্য লেখকের বই থেকে। মূল কাহিনির কাঠামোকে সামনে রেখে অনেক ক্ষেত্রেই এদিক-ওদিক ও চরিত্র সংযোজন-বিয়োজন করে দাঁড়াচ্ছে মাসুদ রানার প্রতিটি বই। যৌনতার বিষয়টি ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে বহু আগেই। প্রথম দিকের ৩০-৩৫টা বই বাদে আর কোনোটিতেই যৌনতার তেমন কিছু নেই। কাহিনির প্রয়োজনে কখনো-বা থাকছে, না হলে নেই। তারপরও মাসুদ রানার বই এখন ৪৫০ ছুঁই ছুঁই করছে। আবার আড়াল থেকে অনেকেই তো মাসুদ রানা লিখেছেন ও লিখছেন। লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নেওয়ার দুঃসাহস তো মাসুদ রানাকে ঘিরেই।
চার.
বন্ধু গীতিকার মাসুদ করিমের নামের প্রথম অংশ ও আর নিজের প্রিয় ঐতিহাসিক চরিত্র রানা প্রতাপের নামের প্রথম অংশ মিলিয়ে মাসুদ রানার নামকরণ করেন কাজীদা। সাংবাদিক বন্ধু রাহাত খানের নামে নামকরণ বুড়ো মানে রানার বস মেজর রাহাতের চরিত্রটি। প্রথমে পাকিস্তানি কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের আর ১৯৭১ সালের পরে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের (বিসিআই) প্রধান তিনি। রানার সহকর্মী ও বন্ধু সোহেল। আর আছে সোহানা চৌধুরী যে শুধু সহকর্মীই নয়, বান্ধবীও। প্রেমিকাও? হয়তো-বা কখনো কখনো। গিলটি মিঞা অবশ্য সোহানাকে কখনো ‘বউদি’ সম্বোধন করেছে। আছে রানার চিরশত্রু পাগল বিজ্ঞানী প্রফেসর কবীর চৌধুরী। পাঠক ও ভক্তকুলের কাছে এই চরিত্রগুলোর আবেদনও কোনো অংশে কম নয়।
পাঁচ
বাংলা সাহিত্যে মাসুদ রানার স্থান কোথায়? আদৌ কোনো সাহিত্যমূল্য আছে এর? ‘অবশ্যই আছে’, বললেন রওনক জাহান। একসময় গোগ্রাসে রানা পড়তেন, এখন নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। ‘রহস্য-রোমাঞ্চ-অভিযান দিয়ে বাঙালির কল্পনার জগৎকে বহুদূর নিয়ে যাওয়া আর মন ও দৃষ্টিভঙ্গিকে কৌতূহলী করে তোলার ক্ষেত্রে মাসুদ রানার অবদানকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এখানেই মাসুদ রানার সাহিত্যমূল্য।’ আক্তারুজ্জামান ইলিয়াসের ওপর পিএইচডি সম্পন্নকারী এই শিক্ষক এও মনে করেন যে মাসুদ রানার ভাষাশৈলীও উপেক্ষা করার মতো নয়।
তবে কাজীদা তো আর সাহিত্য জগতে একটা জায়গা করে নিতে মাসুদ রানা সৃষ্টি করেননি, তিনি বরাবরই পাঠককে আনন্দ দিতে চেয়েছেন আর নিজের ব্যবসাকে এগিয়ে নিতে চেয়েছেন। এই নির্মোহ মূল্যায়ন তাঁর নিজেরই। আর তাই পাঠকের কাছে যত দিন আবেদন থাকবে তত দিন মাসুদ রানা চলবে—এই নীতিতেই বিশ্বাস রাখেন তিনি।
‘আমি এখন সহযোগী লেখক নিচ্ছি’—জানালেন কাজীদা। এঁরা হলেন কাজী মায়মুর হোসেন, সায়েম সোলায়মান ও ইসমাইল আরমান। ‘তৈরি করছি তাদের, যেন আমার অবর্তমানেও তারা চালিয়ে নিতে পারে মাসুদ রানা সিরিজ। আমি আশাবাদী, ওরা পারবে।’
চলচ্চিত্র-রেডিও-টিভিতে রানা
মাসুদ রানা সিরিজের ১১তম বই বিস্মরণ অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল মাসুদ রানা নামে। এর নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন সোহেল রানা। চিত্রনাট্য লিখেছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন নিজেই। সেটা ১৯৭৪ সালে। স্বর্ণমৃগ বাংলাদেশ বেতারে নাট্যরূপ দেওয়া হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। খায়রুল আলম সবুজ ছিলেন রানা চরিত্রে। আর পিশাচ দ্বীপ অবলম্বনে বিটিভির প্রথম প্যাকেজ নাটক প্রাচীর পেরিয়ে নির্মাণ করেছিলেন আতিকুল হক চৌধুরী। রানা-সোহানার ভূমিকায় ছিলেন নোবেল ও বিপাশা। আর রাহাত খানের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন আবুল হায়াত। সেটা ১৯৯৪ সালে।
একনজরে
* মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম বই ধ্বংস পাহাড়। সে সময় মউত কা টিলা নামে বইটির উর্দু সংস্করণও বেরিয়েছিল। গত মাস পর্যন্ত মাসুদ রানা সিরিজের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৪৪৬। ৪৪৭তম বই দুরন্ত কৈশোর প্রকাশিত হবে ১৭ মে।
* প্রথম বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পী সামসুল ইসলাম।
* মাসুদ রানার প্রথম দিকের বইগুলোর প্রকাশক ছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন। ২০১৫ সালে তিনি মারা যান।
* চরিত্র পরিচিতিতে ‘মাসুদ রানা’র যে নামলিপি ছাপা হয় সেটার নকশা করেছেন হাশেম খান।
* মাসুদ রানার প্রথম চরিত্র পরিচিতি দেওয়া হয় ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত রানা! সাবধান!! বইয়ে। তবে সেই পরিচিতি এখনকার মতো ছিল না।
* মাসুদ রানার প্রিয় অস্ত্র ওয়ালথার পিপিকে।
* কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা সিরিজের প্রিয় বই স্বর্গমৃগ, বিস্মরণ ও শত্রু ভয়ংকর।