Thank you for trying Sticky AMP!!

পোশাকে আমার দেশ আমার ভাষা

পোশাকে লেখা বা ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ইতিহাস তুলে ধরার ধারাটি এখনো বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ দিন বা মাসে। দেশজ ঢঙে পোশাকের নকশাগুলোও হয়ে উঠে আকর্ষণীয়।

পোশাকে লেখা টাইপোগ্রাফি ও ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাস তুলে ধরার ধারাটি এখনো বেশ জনপ্রিয়। মডেল : হিমি ও অর্ণব , পোশাক : শরদিন্দু ও দেশাল, কৃতজ্ঞতা : পারসোনা

সেই যে কত বছর আগে নিত্য উপহার বাংলাদেশের পতাকার লাল-সবুজে তৈরি করল টি-শার্ট। তরুণ মন তো জয় করলই, দেশে বা বিদেশের মাটিতে যেকোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পরনে এই টি-শার্ট থাকতেই হবে। আর বিজয়ী হলো তো কথাই নেই। টি-শার্টটি বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের প্রতিযোগীকে তুলে ধরে।

বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ দিন বা মাসে এ ধরনের পোশাকও যেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে

আবার ধরুন দেশালের ফতুয়া, পাঞ্জাবির একটা নকশা। সেটা বছরের পর বছর ধরে তৈরি করা হচ্ছে মার্চ ও ডিসেম্বরে। দেশালের ডিজাইনার ও ভাইস চেয়ারপারসন ইশরাত জাহান বললেন, ‘১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পরদিন (৮ মার্চ ১৯৭১) দৈনিক আজাদ পত্রিকার যে সংখ্যাটি বেরিয়েছিল, সেটার প্রথম পৃষ্ঠা আমরা এনেছি ফতুয়া, পাঞ্জাবির নকশায়। এটা বেশ সাড়া ফেলেছে। সবচেয়ে বেশি যে নকশার পাঞ্জাবি আমাদের জনপ্রিয় হয়েছে, সেটার শিরোনাম “ভাষার গান।”’ এ নকশায় ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের সময় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এবং আরও কটি স্লোগান তুলে ধরা হয়েছে। এর মানে পোশাকের মাধ্যমে ইতিহাসকেও তুলে ধরা হচ্ছে। পোশাকে লেখা বা ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ইতিহাস তুলে ধরার ধারাটি এখনো বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ দিন বা মাসে।

ঐতিহাসিক স্মারকের সঙ্গে নতুন নকশার এই পোশাকগুলি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। পোশাক : শরদিন্দু ও নিত্য উপহার

নিত্য উপহারের একটা শাল রয়েছে—অসংখ্য লেখা সেটিতে। লেখাগুলো আসলে বাংলাদেশের নদীর নাম। যত নদী রয়েছে, সব নাম উঠে এসেছে মানচিত্রে নদীর অবস্থানসহ। নিত্য উপহারের স্বত্বাধিকারী বাহার রহমান বললেন, ‘পোশাক আসলে নিজেকে প্রকাশ করা। বাংলা লেখা বা বার্তা নিজে বুঝে পড়া যায়। বিদেশে টি–শার্টে যা অনুপস্থিত। বিদেশে থাকা অনেক গ্রাহকই বলেছেন, “আপনার টি–শার্টের কবিতা থেকেই আমার ছেলে বাংলা কবিতা শিখেছে।”’

পোশাকে তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পোস্টার

বাহার জানালেন ডিজাইনার বা ফ্যাশন হাউসগুলোর কাজটাও অনেক সহজ হয়ে গেছে। কারণ, আমাদের এত সৃজনশীল লেখক, কবি, গীতিকবি রয়েছেন—তাঁরাই মূল কাজটা করে গেছেন। তাঁদের লেখা থেকে পঙ্‌ক্তি বা কোনো বাক্য বাছাই করে ডিজাইনটা করে ফেলা।

এ বছর নতুন নকশার টি-শার্ট বাজারে ছেড়েছে নিত্য উপহার। এতে শোভা পাচ্ছে আদর্শলিপি, বর্ণ পরিচয়–এর আদি প্রচ্ছদ। বাহারের ভাষ্যে এ নকশা তৈরি করার ব্যাখ্যা, ‘আমাদের প্রজন্মের মানুষ কোন বই থেকে কীভাবে বাংলা বর্ণ, বাক্যের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতেই এ নকশা আমরা করেছি। আবার নিজেদের শৈশবের স্মৃতিও ফিরে আসছে বয়স্কদের মনে।’ নিত্য উপহারের টি-শার্ট, শাল কিংবা শাড়িতে বিভিন্ন সময় উঠে এসেছে চর্যাপদ থেকে শুরু করে শহীদ কাদরীর অগ্রন্থিত কবিতা।

কথার আলপনায় রাঙানো পোশাক

দেশালের পোশাকে থাকা কাজগুলোকে ভ্রাম্যমাণ চিত্রকলা হিসেবে দেখেন ইশরাত জাহান। পোশাকে যে লেখা তুলে ধরেন, নকশা করার সময় সেই লেখার ভাব বা বার্তা কি মাথায় রাখেন? ইশরাত বললেন, ‘বর্ষার উপযোগী আমাদের একটা ডিজাইন আছে। সেটায় রবীন্দ্রসংগীতের “আমার নিশীথের রাতের বাদল ধারা” ব্যবহার করেছি। এটার নকশায় অক্ষরগুলো একটু বাঁকা, একটু হেলে যাচ্ছে এমন আবহ দিয়েছি। যাতে মনে হয় বৃষ্টি হচ্ছে ঝোড়ো বাতাস হচ্ছে। এভাবে লেখা, গান, কবিতা বা স্লোগানের মূলভাবটা নকশায় তুলে ধরা হয়।’

পোশাকে থাকা কাজগুলো যেন হয়ে উঠেছে ভ্রাম্যমাণ চিত্রকলা

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের সপক্ষে বেশ কিছু পোস্টার এঁকেছিলেন আমাদের প্রধান চিত্রশিল্পীরা। সেগুলো মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা, হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে কাজ করেছে। এ পোস্টারগুলো মেয়েদের পাঞ্জাবিতে তুলে এনেছে এ প্রজন্মের ফ্যাশন হাউস শরদিন্দু। প্রতিষ্ঠানটির ডিজাইনার ও স্বত্বাধিকারী হাবিবা আক্তার। তাঁর ভাবনাটা এমন—পোশাক একটা বার্তা দেবে, তথ্য দেবে। আর সেটি দেওয়া যায় আমাদের পুঁথি, কবিতা, গানের লাইন থেকে। ফাল্গুনে যেমন আমাদের একটা নকশা ছিল ‘মন আমার দেহঘড়ি’ গান থেকে। নকশায় আমরা নিয়েছি ‘মাটির একটা কেস বানাইয়া মেশিন দিছে তার ভেতর।’ এভাবে শরদিন্দুর পোশাকে উঠে আসে চর্যাপদ, পদ্মপুরাণ থেকে শুরু করে দেশাত্মবোধক গান, কবিতা ইত্যাদি। ডিজাইনে থাকে পেইন্টিং, পটচিত্র, গুহাচিত্র কিংবা টেরাকোটার ধারা। আর এ মার্চে তারা তুলে ধরেছে মুক্তিযুদ্ধের পোস্টার।

শাড়ি ও ওড়নায় বাংলা গানের কোলাজ। পোশাক : বিবিয়ানা

শাড়িতেও দেখা যায় গান-কবিতার ব্যবহার। বছর কয়েক আগে ডিজাইনার লিপি খন্দকার তাঁর প্রতিষ্ঠান বিবিআনার জন্য বানিয়েছিলেন কবিতা লেখা এক শাড়ি। আনিসুল হকের ‘তুই কি আমার দুঃখ হবি’ লেখা ছিল শাড়ির ক্যানভাসে। এবারে বিবিআনার শাড়ির নকশায় যেন গানের কোলাজ। ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিল’, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’—নানা কথার আলপনা।বার্তা দেওয়ার বিষয়টি বারবার উঠে এসেছে ডিজাইনারদের কথায়। দেশজ ঢঙে নকশাগুলোও হয়ে ওঠে আকর্ষণীয়। সৃজনশীল ভাবনায় তৈরি পোশাকগুলোই হয়ে ওঠে বাঙালির, বাংলাদেশের ‘শুভেচ্ছাদূত’।