বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে প্রেমে যদি পড়েই যান

তুমুল ভালোবাসা, বাঁধভাঙা আবেগ কিংবা অন্ধপ্রেম—কখনো কখনো এর সবই ভর করে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে। দেখা যায় বিজ্ঞানের ছাত্র কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে বসেছে। ওদিকে ব্যবস্থাপনা ক্লাসের ফার্স্টবেঞ্চার মেয়েটিও ‘আবেগ ব্যবস্থাপনা’য় একদম ফেল! বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে প্রেমে যদি পড়েই যান, যদি ভীষণ অস্থিরতা পেয়েই বসে, তবে এই লেখা আপনার জন্য।

কার্টুন: আরাফাত করিম
কার্টুন: আরাফাত করিম

সুধীন দত্তের কবিতায় আছে: ‘একটি কথার দ্বিধা থরথর চূড়ে/ ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী।’ ‘ভালোবাসি’ শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে ‘সাতটি অমরাবতী’র সুখ মনে ভর করে। এখানেই শেষ নয়। কবিতার পরের দুটি লাইনে আছে: ‘একটি নিমেষ দাঁড়াল সরণিজুড়ে,/ থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি।’ মানে, ‘ভালোবসি’ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে সময়ও থমকে দাঁড়ায়। ভালোবাসার যত রকমফেরই থাক না কেন, ভালোবাসা বলতে মূলত নর-নারীর প্রেমকেই বোঝানো হয়। এই প্রেমের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াও বড় অদ্ভুত। প্রত্যাখ্যানে মন বিদীর্ণ হয়, সম্মতিতে মনে আর কিছুর জায়গা হয় না।

যে প্রেম সবকিছু রঙিন করে দেখায়, সে প্রেম নিজে আবার অন্ধ। স্থান, কাল আর পাত্র দেখার ক্ষমতা তার নেই। স্থান দেখার ক্ষমতা নেই, তাই পড়ার জায়গায় মানে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ছেলেমেয়েরা প্রেমে পড়ে। কাল দেখার ক্ষমতা নেই, তাই ছাত্রজীবনে সংসারজীবন শুরু করতে চায়।

সবই ঠিক আছে। কিন্তু সব আবার সব সময় ঠিক থাকে না। স্কুল-কলেজের কঠিন বিধিনিষেধ আর মা-বাবার কড়া নজরে অনেক প্রেম অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর হঠাৎ করে সবাই বড় হয়ে যায়। এবার আর থাকে না অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণ, তাই প্রেমের সহজ সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত উদ্যানে প্রেমের নতুন চারা গাছ সাঁই সাঁই করে বাড়তে থাকে। মুশকিল হলো, সেই গাছে পানি ঢালতে গিয়ে অনেকের পড়াশোনা লাটে ওঠে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছেলেটির বা যে মেয়েটির ভালো রেজাল্ট করার কথা, সে পথ হারায়। অথচ, ভর্তি পরীক্ষার তুমুল প্রতিযোগিতায় সে ঠিকই মেধার পরিচয় দিয়েছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কো-এডুকেশন চলে, মানে ছেলে-মেয়ে এখানে একসঙ্গে পড়ে। অনেক শিক্ষার্থীর জন্য এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার আকস্মিক ঘূর্ণিঝড়ে অনেক শিক্ষার্থী দিশা হারিয়ে ফেলে। বুঝতে পারে না সতীর্থের সঙ্গে কী রকম সম্পর্ক থাকা উচিত। কেউ কেউ তো বন্ধুত্ব আর প্রেমকেও গুলিয়ে ফেলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমনটা বলেছেন, ‘বন্ধুত্ব বলিতে তিনটি পদার্থ বোঝায়। দুজন ব্যক্তি ও একটি জগৎ। অর্থাৎ দুজনে সহযোগী হইয়া জগতের কাজ সম্পন্ন করা। আর, প্রেম বলিলে দুজন ব্যক্তিমাত্র বোঝায়, আর জগৎ নাই। দুজনেই দুজনের জগৎ।’ অর্থাৎ এই ‘দুজনের জগতে’ পড়ালেখা, ক্যারিয়ার, পরিবার, সব গৌণ হয়ে যায়।

মডেল: মাহমুদ ও মারিয়া

এগুলোর জন্য অবশ্য শিক্ষার্থীকে দায়ী করা চলে না। তার বয়স তাকে এ রকম ছেলেমানুষি আচরণে বাধ্য করে। তাই এক শ বছর আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ের উদার প্রাঙ্গণে একজন আরেকজনের নাম শুনে শিহরিত হতো। তাই পঞ্চাশ বছর আগেও একজন আরেকজনের কাছে চিঠি লিখতে গিয়ে হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে যেত। তাই তিরিশ বছর আগেও চোখে চোখ রেখে হাতে গোলাপ তুলে দিতে গিয়ে অকারণ কাঁপত হাতের আঙুল। এ যুগে অবশ্য প্রেমের ধরন-ধারণ পাল্টেছে। তবে, প্রযুক্তি কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রেমের শিহরণ-কাঁপন থামাতে পারেনি। এখনো নিশ্চয়ই হৃৎপিণ্ডের গতি বাড়ে, হাত কাঁপে।

তাহলে কী করা? বয়স আর আবেগের কাছে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করে দিতে হবে? মনোবিদেরা বলেন, যে কোনো ধরনের ‘ইমোশন’ আগে ‘অ্যাড্রেস’ করতে হবে। অর্থাৎ, আবেগকে বিবেচনায় নিতে হবে। মানুষের অসম্ভব শক্তি আছে; আমরা যেকোনো পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। বেরিয়ে আসা বলতে সম্পর্ক নষ্ট করে প্রেমের অমর কাব্য রচনার কথা বলা হচ্ছে না। যেসব আবেগ মানুষকে বিভ্রান্ত করে, সেসব আবেগ ব্যবস্থাপনার কৌশল আছে। ব্যক্তি নিজেই তা পারে। কোনো কারণে ব্যক্তি নিজে না পারলে কাউন্সিলরের সাহায্য নিতে পারে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা আছে। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় অনেক সুযোগ সামনে নিয়ে আসে। সেগুলোকে কাজে লাগানো উচিত। অনেকেই বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়। সেবামূলক ও গঠনমূলক কাজের মধ্য দিয়ে ‘আবেগকেন্দ্রিক বুদ্ধিমত্তা’ বা ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্সের ভিতকে শক্ত করে।

এত কথার মানে তাহলে কী দাঁড়াল, প্রেম করা যাবে না? কেউ বাধা দিলেও নর-নারী প্রেমে পড়বে; আবার কেউ বাধ্য করতে চাইলেই কাউকে প্রেমে ফেলা সম্ভব হবে না। আসল কথা, ভালোবাসা কোনো এক অজানা মুহূর্তে চলে আসে। তখন ‘ভালোবাসি’ কথাটির চূড়ায় দ্বিধা থরথর করে কাঁপতে পারে, কাঁপুক। ভালোবাসার মধ্য দিয়ে ‘সাতটি অমরাবতী’ ভর করতে পারে, করুক। ‘ভালোবাসি’ শব্দটি উচ্চারণকালে ক্ষণিকের জন্য সময় থমকে দাঁড়াতে পারে, দাঁড়াক। তবে, কবিতার একেবারে শেষ অংশের মতো যেন না হয়। সুধীন দত্তের সেই কবিতার শেষে আছে: ‘সে ভোলে ভুলুক, কোটি মন্বন্তরে/ আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিব না।’ এমন আবেগ নিয়ে চললে নিজের ক্যারিয়ারটাই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। আচ্ছা, ভোলা না ভোলার ব্যাপারেও তো কারও হাত নেই! তাহলে অন্যভাবে বলি। কাউকে না পেয়ে চিরদিন হয়তো তাকে মনে রাখতে চান, রাখুন। কিন্তু তাতে শ্বাস যেন দীর্ঘ না হয়; আফসোস আর হতাশায় নিজের ক্যারিয়ারের সমস্ত সম্ভাবনা যেন নষ্ট না হয়।

লেখক: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়