
আঁধার তাড়াতে তাড়াতে হাল জামানায় এসে খোদ নিজের ভবিষ্যতই অন্ধকার হয়ে পড়েছে মোমবাতির। তার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী দাঁড়িয়ে গেছে সস্তার ‘রিচার্জেবল ইলেকট্রিক লাইট’। ‘চার্জার লাইট’ নামে পরিচিত চীনের তৈরি এসব বিজলিবাতিতে বাজার সয়লাব। টেকেও বেশ অনেক দিন। ফলে মোমবাতির বাজার দিনে দিনে সংকুচিত হয়ে আসছে। খুচরা দোকানের সামনের তাকে সাজানো পণ্যের সারি থেকে সে অপসারিত। তার স্থান হয়েছে মেঝে বা নিচের তাকের মজুত পণ্যের বস্তা-প্যাকেটের ফাঁক-ফোকরে।
কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার একদা সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি/ আশু গৃহে তার দেখিবে না আর/ নিশিথে প্রদীপ ভাতি’। ভাগ্যিশ কবি আর ধরাধামে নেই। থাকলে মোমবাতির এহেন পরিণামে যে মনে বড় দাগা পেতেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কী আর করা! সময় সবকিছুই বদলে দেয়। এটাই অমোঘ সত্য। সেই অমোঘ নিয়মে বদলে গেছে মানুষের জীবনযাত্রা। মোমবাতির ভাবিষ্যৎ হয়ে পড়েছে অন্ধকারাচ্ছন্ন।
বছর তিন-চারেক থেকেই চীনের তৈরি প্লাস্টিকের কাঠামোতে ছোট ছোট বাতিযুক্ত এসব চার্জার লাইট দেশের বাজারে আসতে থাকে। লম্বা-খাটো, গোল, তেকোনা, আড়াআড়ি যেমন তার হরেক রকম আকার; তেমনি লাল, নীল হলুদ, সবুজ বিভিন্ন রঙের বাহার। একেবারে নজরকাড়া জিনিস। ব্যবহারও সহজ। বোতাম চাপামাত্র ঝলমলে আলোয় আঁধার বিতাড়িত। এক পাশে প্লাগ সংযুক্ত। সুবিধামতো কোনো সকেটে সংযোগ করলে ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই পুরো চার্জ। একবার পুরো চার্জ হয়ে গেলে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক আঁধার তাড়ায়। আগুন লেগে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা নেই। দামও হাতের নাগালে। দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠার সেটিই প্রধান কারণ।
বাজার ঘুরে দেখা গেল ফুটপাত থেকে ছোট-বড় সব মুদিখানায় এখন এসব চীনা চার্জার লাইটের মজুত পর্যাপ্ত। ঢাকার চকবাজারে এসব চার্জারের প্রধান পাইকারি দোকান। সেখানে সোহাগ ট্রেডার্সের ব্যবসায়ী মো. সোহেল জানালেন, হরেক রকমের চার্জার লাইট আসছে চীন থেকে। এর কোনোটিতে আছে টর্চ সংযুক্ত, কোনোটিতে আছে ছোট্ট পাখা, কিছু আছে দেয়ালে লটকে রাখার জন্য, টেবিল ল্যাম্পের আকারে স্ট্যান্ডযুক্ত চার্জার লাইটও আছে নানা আকারের। দাম নির্ভর করে আকারের ওপর। সর্বনিম্ন দাম ৬০ টাকা। সর্বোচ্চ ৭০০ টাকা। এগুলোর সঙ্গে ছোট আরের পাখাও রয়েছে। চকবাজারে এসব চার্জার লাইটের হাজার খানেকের বেশি পাইকারি দোকান। মাসে আট থেকে ১০ লাখ টাকা বিক্রি প্রতিটিতে। এ থেকেই চার্জার লাইটের বাড়বাড়ন্ত আঁচ পাওয়া যায়।
চীনের বাতির রমরমায় অনুপ্রাণিত হয়ে দেশেও এখন এ ধরনের বাতি তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অবশ্য বড় কোনো কারখানা প্রতিষ্ঠা হয়েছে তা নয়। দেশের তৈরি বাতিগুলো আকারে ছোট। তেমন দর্শনধারীও নয়। সেলফোনের চার্জার দিয়ে এসব বাতির চার্জ দেওয়া যায়। বিভিন্ন এলাকায় ইলেকট্রিক মিস্ত্রিরাই এসব তৈরি করেন বলে খুচরা বিক্রেতারা জানিয়েছেন। এসব দেশি বাতির গায়ে উৎপাদনকারীর কোনো সিলছাপ্পরও নেই। দাম চীনা বাতির চেয়ে কম। আকারভেদে ৫০ থেকে ১০০ টাকা। দামের বিচারে আলোকিত করার ক্ষমতার পরিমাপ করা ঠিক হবে না। কারণ দাম কম হলেও আলো বিতরণ করে ঢের। একটু যত্ন নিলে বছর খানেক ব্যবহার করা চলে।
এই যখন অবস্থা, তখন মোমবাতি পারবে কেন এসব বিজলিবাতির সঙ্গে। বাজারে মোমবাতির ডজন ছোটগুলো ৬০ টাকা, বড় ১১০ টাকা। এক ডজনের দামে যে চার্জার লাইট কেনা যায় তা দিয়ে অনায়াসে বছর পার। জীবনধারায় তাই মোমবাতির জায়গা দখল করে নিয়েছে এসব বিজলিবাতি। ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাটের যন্ত্রণা লাঘবের এই নতুন নিদানটি আলোর সঙ্গে হাওয়াও বিলিয়ে যাচ্ছে জনজীবনে। মিটমিটে আলোর মান্ধাতা আমলের মোমবাতি এর সঙ্গে পারবে কেন। তার আলোর মতো নিজেও সে মলিন হয়ে পড়েছে। প্রযুক্তির সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া মোমবাতির শেষ আশ্রয় হবে হয়তো কেবল জন্মদিনের কেকের সামনে।