আদবকেতা

সন্তান নিয়ে আদিখ্যেতা নয়

অপরের সন্তানকে আদর করার ক্ষেত্রে ‘ন্যাকা ন্যাকা কথা’ না বলাই ভালো
অপরের সন্তানকে আদর করার ক্ষেত্রে ‘ন্যাকা ন্যাকা কথা’ না বলাই ভালো

দিন সাতেকের জন্য রাহেলার বাসায় বেড়াতে এসেছেন তাঁর বোন। এসেই রাহেলার তিন বছরের ছেলেটিকে কোলে তুলে নিলেন। বোনকে বলতে থাকলেন, ‘দেখেছিস, তোর ছেলেটি কত সহজে আমার আপন হয়ে গেল। ও তোর চেয়ে আমাকেই বেশি ভালোবাসবে।’ এরপর যত দিন তিনি ওই বাসায় ছিলেন, তত দিন খানিকটা বাড়াবাড়িই করলেন বলা যায়। বোনের ছেলের যত্ন নিয়ে গৃহকর্মীদের বকাঝকা দেওয়া থেকে শুরু করে রাহেলাকেও নানা কিছু বোঝাতে লাগলেন। কখনো বলতে লাগলেন, ‘তুই তো বাচ্চার যত্ন নিতেই পারিস না...তোর বাচ্চা মোটেই তোকে ভালোবাসে না...।’ বোনের এই আদিখ্যেতাপনায় রাহেলা খানিকটা বিব্রত ও বিরক্ত হলেও কিছু বললেন না। তাঁর মন খানিকটা খারাপ হলো।
কেবল পরিবারের কাছের মানুষই নয়, অনেক সময় সামাজিক আড্ডায়ও মায়েরা এমনতর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারেন। বন্ধুবান্ধব কারও সন্তানকে আদর করতে গিয়ে অনেক সময় সজ্ঞানে, আবার কখনো না বুঝে এমন কিছু বলেন বা করেন, যাতে শিশুটির মা বিব্রত হন বা মনে কষ্ট পান। অযাচিত উপদেশ থেকে শুরু করে ঘটাÿকরেও বলেন কেউ কেউ। যেমন কেউ অপরের সন্তানকে কিছু সময়ের জন্য আদর করতে করতে মাকে বলেন, ‘বাচ্চা দেখি আপনার কাছে যেতেই চাইছে না, সে দেখি আপনাকে চেনেই না!’ কখনো বলে বসেন, ‘আরে, তুমি কি ওর আপন মা? দেখে তো মনে হয় না।’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
এসব কথায় মায়ের মনে খানিকটা প্রভাব পড়তে পারে। তিনি ভাবতে পারেন, আমি কি সত্যিই আমার সন্তানের যথাযথ যত্ন নিতে পারছি না? সে কি সত্যিই আমাকে চেনে না? কেন আমার সন্তান আরেকজনকে বেশি পছন্দ করে? এসব ভাবতে ভাবতে তাঁর মধ্যে হতাশা আর বিষণ্নতা তৈরি হতে পারে, কখনো-বা এ ধরনের কথার প্রতিক্রিয়ায় তিনি রাগ করেন, আর বন্ধু-স্বজনের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। আবার কখনো সন্তানের প্রতিও তার বিরূপ মনোভাব তৈরি হতে পারে। তিনি অপরের কথায় মনে করেন, সত্যিই তাঁর সন্তান তাঁকে অপছন্দই করে!
প্রকৃতপক্ষে মায়ের সঙ্গে সন্তানের যে বন্ধন, তা জন্মের আগেই শুরু হয়ে যায়। আর জন্মের পর প্রথম মায়ের কোলে যাওয়া, বুকের দুধ খাওয়া ইত্যাদি পর্যায়ে এই বন্ধন আরও দৃঢ় হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় অ্যাটাচমেন্ট। এই মানসিক বন্ধন পৃথিবীর কোনো বন্ধনের সঙ্গেই তুলনীয় নয়। এই বিষয় নিয়ে গবেষণা হয়েছে এখনো হচ্ছে। এই বিষয়কে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, এটি জৈবিক (জেনেটিক), মানসিক (সাইকোলজিক্যাল) ও নবজাতকের একটি প্রাথমিক রিফ্লেক্স। সবাই শিশুদের ভালোবাসে, তাদের পছন্দ করে, আদর করতে চায়, কিন্তু এই আদর আর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ কখনোই যেন শিশুর মাকে বিরক্ত বিব্রত বা বিষণ্ন না করে। মনে রাখতে হবে—
* মায়ের ভালোবাসা আর যত্নের সঙ্গে অপরের ভালোবাসা বা যত্নের কোনো তুলনা করা যাবে না।
* অপরের সন্তানকে আদর করার ক্ষেত্রে ‘ন্যাকা ন্যাকা কথা’ বা আদিখ্যেতা না করাই ভালো।
* এমন কিছু বলবেন না বা করবেন না, যাতে শিশুটির মা নিজেকে ছোট মনে করেন।
* আপনার যদি শিশুর মাকে সন্তানের যত্নের বিষয়ে কোনো উপদেশ দেওয়ার থাকে, তবে তা তাঁকে একলা ডেকে বলুন। ভরা মজলিশে তাঁকে কটাক্ষ করবেন না।
* আপনি যত বড় ‘বিশেষজ্ঞ’-ই হন না কেন, সন্তানের মঙ্গল কামনায় মাকে কখনোই অতিক্রম করতে পারবেন না। সন্তান যত্ন-প্রক্রিয়ায় মায়ের ভুল হতেই পারে। সেটি মায়ের অজ্ঞতা, মোটেই ইচ্ছাপ্রসূত ভুল নয়। বিষয়টি মনে রেখে মাকে উপদেশ দেবেন।
* শিশুকে তার মা সম্পর্কে নেতিবাচক কোনো কথা বলবেন না, কারণ এর প্রভাব শিশুদের মনে পড়ে।
* শিশুর যত্ন আর ভালোবাসার বিষয়ে প্রত্যেক মাকে উৎসাহিত করুন। তাঁকে প্রশংসা করুন। প্রয়োজনে মাকে এসব বিষয়ে সহায়তা করুন।
মায়েদের এসব পরিস্থিতিতে মন খারাপ করলে চলবে না।

মায়েরা যা মেনে চলতে পারেন—
* মনে রাখতে হবে, যাঁরা এই কটাক্ষ করছেন, তাঁদের বেশির ভাগই না বুঝে বলছেন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করছেন না।
* চট করে রেগে যাওয়া যাবে না, তৎক্ষণাৎ পাল্টা যুক্তি আর উদাহরণ দিয়ে সন্তানের প্রতি ভালোবাসার প্রমাণ দেবেন না।
* বিষয়টি নিয়ে আপনজন, বিশেষ করে সন্তানের বাবার সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন, তাঁর সাহায্য আর মতামত চাইতে পারেন।
* যদি কোনো আড্ডায় বারবার বিষয়টি ঘটতে থাকে, তবে সেই ধরনের আড্ডা ও ব্যক্তিকে এড়িয়ে চলুন।
* সন্তানের ওপর কখনোই রাগ করবেন না।
* নিজেকে ছোট ভাবার কোনো কারণ নেই। আপনি একজন মা, কেবল এই গর্বেই মাথা উঁচু করে থাকবেন।
* অপরের কথায় সন্তানের যত্নের বিষয়ে হুট করে নিজেকে পাল্টানোর চেষ্টা করবেন না। যুক্তি দিয়ে বিবেচনা করুন, প্রয়োজনে বয়োজ্যেষ্ঠ বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন।
* সব সময় বিশ্বাস করতে হবে, মা ও সন্তানের ভালোবাসায় কোনো কমতি বা খাদ নেই, এটি প্রমাণিত সত্য। আশপাশের লোকজনের কথায় কখনোই এই চিরন্তন সত্যের পরিবর্তন হবে না।