
‘নগর গঠন’—শব্দটি আজ আর নতুন নয়। তবে যখন প্রসঙ্গ আসে হাজার বছরের পুরোনো কোনো নগরের, তখন সেটির পটভূমি, নির্মাণশৈলী ও সাংস্কৃতিক পরিপার্শ্ব হয়ে ওঠে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এমনই এক নগর ছিল পুণ্ড্রনগর, যার নিঃশব্দ ধ্বংসাবশেষ আজও ছড়িয়ে আছে করতোয়া নদীর পূর্ব তীরে, প্রাচীন জনপদ মহাস্থানে। বর্তমানে যা বগুড়া জেলার অন্তর্ভুক্ত।
প্রায় ১ দশমিক ৫ বর্গকিলোমিটারের এক প্রাকৃতিক উঁচু ভূমিতে গড়ে উঠেছিল এই নগর। ভৌগোলিক অবস্থান, নদীপথের সংযোগ এবং কৌশলগত বিন্যাসের কারণে এটি হয়ে উঠেছিল উত্তরবঙ্গের একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র।
ইতিহাসের পাতায় যা ‘পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তি’ নামে পরিচিত, তা পাল রাজাদের হাতে রূপ পেয়েছিল এক সুবিন্যস্ত ও সংগঠিত নগররূপে।
পালযুগ—বাংলার ইতিহাসে এক সোনালি অধ্যায়। এই সময়েই পুণ্ড্রনগর এক স্থাপত্যবিস্ময়ে পরিণত হয়। নগরের কেন্দ্রে ছিল প্রশাসনিক কাঠামো, রাজপ্রাসাদ, কর সংগ্রহ কেন্দ্র ও ধর্মীয় মঠ।
এটি কেবল রাজধানী নয়, ছিল সাংস্কৃতিক ভাবনার এক প্রতিফলন। রাজ্য শাসনের পরিকল্পনায় নগরকেন্দ্র যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তার নিদর্শন মেলে নগর গঠনের বৈজ্ঞানিক বিন্যাসে।
পুণ্ড্রনগরের আরেকটি মুখ্য বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মীয় ভাবধারা। পাল রাজারা বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাই নগর–পরিকল্পনায় মঠ, বিহার, স্তূপ ও প্রার্থনাস্থলের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা রাখা হয়েছিল। নিছক ধর্মীয় স্থাপনাই নয়, ছিল বিদ্যার কেন্দ্র, সমাজচিন্তার প্রতিফলন।
নগরের উত্তরাংশে ছিল ধর্ম ও বাণিজ্যের কেন্দ্র, যার ধারাবাহিকতায় দক্ষিণে গড়ে উঠেছিল বাজার ও মঠসংলগ্ন আবাসন এলাকা।
পাল রাজারা শহরকে কেবল প্রাচীরবেষ্টিত এলাকা ভাবেননি। শহরের বাইরেও ছিল নগর-সম্পৃক্ত কর্মকাণ্ড। মঠের আশপাশে গড়ে উঠেছিল বসতি, পথসংলগ্ন বাজার আর বিশ্রামের স্থান। একধরনের ‘নগর সম্প্রসারণ’ কৌশল এখানে লক্ষ করা যায়, যা বর্তমানের নগরায়ণ ধারণার সঙ্গে মিলে যায়।
যদিও মহাস্থানের অনেক কাঠামো সময়ের সঙ্গে বিলীন হয়ে গেছে, তবু স্থাপত্যবিদেরা এখনো খোঁজ করছেন সেই শহরের কাঠামোগত রূপরেখা। অজস্র প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও মানচিত্রে ধরা পড়ছে ধ্বংসাবশেষের আভাস, নগরের মূল প্রবেশপথ, রাস্তার রেখাচিত্র এবং ঘনবসতির ছাপ।
পুণ্ড্রনগরের অনুপম বিন্যাস কেবল ইতিহাস নয়, একটি জীবনযাত্রার ধারা। আজ যখন নগরায়ণ নিয়ে নানা আলোচনায় আমরা বিভোর, তখন হাজার বছর আগেকার এ পরিকল্পিত নগর থেকে শেখার আছে অনেক কিছু।
সেখানে ছিল শাসন, সংস্কৃতি, ধর্ম ও প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান। যা আজকের নগরজীবনের জন্যও প্রাসঙ্গিক।
১৯৭৬ ও ১৯৯৩-৯৯ সালের প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজে পুণ্ড্রনগরের দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে যে গৃহভবনের অংশ পাওয়া যায়, তা একটি সুসংবদ্ধ আবাসনপাড়ার ইঙ্গিত দেয়। এসব স্থাপনার কাঠামো দেখে বোঝা যায়, সেগুলো প্রাথমিকভাবে একতলা ছিল এবং মাটি ও কাঠ ছিল প্রধান নির্মাণ উপাদান।
বাড়িগুলোর দেয়াল সাধারণত ছিল ৩০ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার পুরু, যা তাদের একতলা থাকার সম্ভাবনার কথা জানায়।
তখন বাড়ির মেঝে তৈরি হতো মাটি ও পোড়ামাটির টুকরার সংমিশ্রণে। দেয়ালগুলো নির্মিত হতো পোড়া ইটের ভগ্নাংশ ও মাটির মিশ্রণ দিয়ে, যাতে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। কিছু স্থানে দেখা যায় কাঠের খুঁটির গর্ত, যেগুলো প্রমাণ করে, কাঠের খুঁটি ছিল গৃহের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
প্রথমবারের মতো খননে পাওয়া যায় ভাঙা ছাদ টাইলস, যা এ অঞ্চলে টাইলস ব্যবহার করা প্রাচীন ছাদের অন্যতম নিদর্শন। কোনো কোনো ঘরে টাইলসের পাশাপাশি খড়ের ছাদ ব্যবহারের প্রমাণও পাওয়া গেছে।
টাইলসগুলোর আকৃতি ছিল গড়পড়তা ১৬ সেন্টিমিটার চওড়া ও ৯ সেন্টিমিটার উচু। এতে দুটি ছিদ্র ও লম্বালম্বি খাঁজ দেখা যায়, যা কাঠের কাঠামোয় সেগুলোকে ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থার কথা বলে।
বসতিবিন্যাস ছিল এক বা একাধিক উঠান ঘিরে গঠিত। প্রতিটি বাড়িতে ছোট কক্ষ, রান্নাঘর, বারান্দা ও খোলা স্থান থাকার প্রবণতা দেখা যায়। প্রবেশপথে আধখোলা বারান্দা বা দালান যুক্ত থাকত, যা বসবাসকারীদের জন্য সামাজিক যোগাযোগ ও দৈনন্দিন কাজকর্মে সহায়ক ছিল।
ঘরের ছাদকাঠামো তৈরি হতো কাঠের পার্লিন ও ত্রিভুজ কাঠের সাহায্যে। এর ওপর ছাদ টাইল বসানো হতো। এ ছাদের গঠন ছিল এমনভাবে পরিকল্পিত, যাতে তা বর্ষার জল নিচে নামিয়ে দিতে পারে এবং দীর্ঘ সময় টিকেও থাকে।
পুণ্ড্রনগরের আবাসিক অঞ্চল সমানভাবে বিস্তৃত ছিল না। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ছিল ঘনবসতিপূর্ণ। নগরের বিভিন্ন অংশে ব্যবসায়ী, কারিগর ও ধর্মীয় ব্যক্তিদের জন্য নির্মিত আলাদা ঘরবাড়ির চিহ্ন পাওয়া যায়।
যদিও স্পষ্ট শ্রেণিভিত্তিক বিভাজন ছিল না; বরং প্রতিটি পাড়া ছিল পেশাভিত্তিক কিছু বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন, যা স্থানীয় জীবনের বৈচিত্র্য প্রকাশ করে।
প্রত্নতাত্ত্বিক খননে গৃহস্থালির অনেক নিদর্শন পাওয়া গেছে—মণ্ডিত টেরাকোটা ফলক, ছোট অলংকার (যেমন মালা, আংটি), পোড়ামাটির পাত্র, রান্নার সামগ্রী ইত্যাদি।
এগুলো এই পাড়াগুলোর মানুষের জীবনধারা ও সংস্কৃতির এক আকর্ষণীয় চিত্র তুলে ধরে। পাল সাম্রাজ্যের শেষ দিকে এই নগর ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ডের কবলে পড়ে।
সে সময়ের আগুনে পোড়া মাটি, কাঠ ও ইটের স্তূপ এখনো খননে দৃশ্যমান, যা সেই বিধ্বংসী ঘটনার নীরব সাক্ষী।
গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে এবং নদীবাহিত বদ্বীপ এলাকায় মাটি ব্যবহার করে ভবন নির্মাণ করা প্রচলিত পদ্ধতি ছিল। বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষ স্থাপনার জন্য। ধীরে ধীরে মাটি পোড়ানো ইটে পরিণত হয়েছিল। পরে পোড়ামাটির অলংকরণসহ ইট ব্যবহৃত হতে শুরু করে।
ইট সংকোচনের চাপ সহ্য করতে পারলেও উচ্চতা বৃদ্ধিতে বিশেষ দক্ষতা দরকার ছিল। ছোট স্থাপনা নির্মাণে ইট ব্যবহারের পরিবর্তে বৃহত্তর কাঠামোতে ইট ব্যবহার করা হতো। বিশেষ করে নিচের দিকটি বেশি প্রশস্ত রেখে ইটের দেয়াল তৈরি করা সহজ ছিল। সে সময় বদ্বীপ এলাকার মানুষ বহুতল আবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করেননি।
পালযুগে প্রাচীন পুণ্ড্রনগরের সাধারণ জনগণের আবাসন অবস্থা মূলত একতলাভিত্তিক। যা মাটির ও কাঠের নির্মাণপদ্ধতিতে নির্ভরশীল ছিল। আবাসনগুলোর গঠন বেশ সাদাসিধে হলেও পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উন্নত কারিগরি দক্ষতার প্রকাশ ঘটেছিল।
প্রাচীন শহরের বিন্যাসে রাস্তা, প্রাসাদ নির্মাণের ব্যাপকতা ও ভিজ্যুয়াল স্কেল প্রাচীন শহরের স্থানিক অবস্থার গুণমান মূল্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মহাস্থান এমনই একটি শহর, যেখানে খুব শৌখিন ও উচ্চাভিলাষী প্রাসাদ ছিল না; বরং এখানকার বিনম্র স্থাপত্যগুলো মানুষের ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ থেকে উদ্ভূত হয়েছে।
ভূপ্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা বিশাল, পুরু, সুরক্ষিত প্রাচীর এটিকে ঘিরে রাখত। তবু এটি প্রাচীরের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে একধরনের ‘প্রবাহমান শহর’ হিসেবে। গভীরভাবে বলতে গেলে, নদীর পাড়ে অবস্থিত মহাস্থান ছিল সমৃদ্ধ একটি প্রাচীন নগরীর আদর্শ রূপ।
ড. সাজিদ বিন দোজা, স্থাপত্য ইতিহাসবিশেষজ্ঞ
তথ্যসূত্র: ‘বেঙ্গল অ্যানসেন্ট আরবান আর্কিটেকচারাল এক্সপ্রেশন: আ স্টাডি অব মহাস্থান সেটেলমেন্ট প্যাটার্নস, আর্কিওলজিক্যাল ফাইন্ডিংস অ্যান্ড স্ট্রাকচারাল অ্যানালাইসিস অব মহাস্থান’, জার্নাল অব বেঙ্গল স্টাডিজ; রেখাচিত্রে প্রাচীন পুণ্ড্রনগর: অষ্টম শতাব্দীর সচিত্র ধারণাগাঁথা ইত্যাদি।