গরমকাপড় আর মায়ের কোল—শীতে ওম পেতে আর কী লাগে!
গরমকাপড় আর মায়ের কোল—শীতে ওম পেতে আর কী লাগে!

সেই যে আমার নানা রঙের উলগুলি

শীতকাল কবে আসবে? কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর সুপর্ণা এ প্রশ্নের উত্তর এখন জানেন কি না, জানা নেই। জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। বর্ষাকালে আর বৃষ্টির দেখা মেলে না। জলে ভাসে না করঞ্জা ফুল। শীতেও ভ্যাপসা গরম। শুধু ঋতুর নিয়ম মেনে মৌসুমি ফুলগুলো ফোটে আর ঝরে ঝরে পড়ে। তবু কোথাও না কোথাও তো শীতের জন্ম হয়! ধীরে হলেও নেমে আসে হিম হেমন্তের এই অগ্রহায়ণে। এবারের হেমন্তে হালকা হিম জানান দিচ্ছে, হাওয়া বদল হচ্ছে; আর হুতাশ করতে হবে না। ফিরছে শীতের আমেজ।

ক্যালেন্ডারে শীত আসার আগেই প্রকৃতিতে শীতের রং লেগেছে। ঝুপ করে নেমে আসছে সন্ধ্যা, হিমের চাদর জড়িয়ে নিচ্ছে আকাশ। মাঠ, ঘাস আর রাতে ফোটা শিউলি ফুল সকালের শিশিরে জবুথবু। জবুথবু হয়ে আছে পথের ধারে ফোটা ছোট্ট নীল ফুলের হাসি, তার নাম জেনেছি কানাইবাঁশি। আসলে ফুল ফোটাবে বলেই বৃষ্টিহীন দিনে বুনো গাছ ভিজিয়ে দিয়ে যায় শিশিরের কণা।

আচ্ছা এই যে কুয়াশা, শিশির আর শিরশিরানি—এসবই কি হেমন্তের নিজস্ব? শীতের কাছে কি তার কোনো ঋণই নেই? আবার এ কথাও তো ঠিক, হেমন্ত আছে বলেই না শীতের এত আড়ম্বর। আর তা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।

ধুলা ঝেরে বাইরে এসেছে তোরঙ্গ। রাগ-অভিমান নয়, তবু এত দিন যাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল, এই হিম দিনে ‘সমারোহে এসো’ বলে বের করা হচ্ছে শীতের নানা রঙের পোশাক। গায়ে জড়ানোর আগে বাড়ির ছাদ ও উঠানগুলোতে রোদ পোহাচ্ছে নানা রঙের উল।

আমার মায়ের ছিল টিনের তোরঙ্গ। এই তোরঙ্গ বাইরে এলেই বোঝা যেত, শীত সমাসন্ন। তোরঙ্গ খুলতেই বেরিয়ে আসত ন্যাপথলিনের গন্ধমাখা ছোটবেলার সোয়েটার, গায়ে দেওয়ার জন্য পরে আর কোনো দিন যার ডাক পড়েনি। বেরিয়ে আসত ঠাকুরমার বোনা পুরোনো কাঁথা। ঠাকুরমা নেই, তবু প্রতি শীতে একবার কাঁথায় মা ছুঁয়ে নিতেন তাঁর মায়ের আঙুল।

তোরঙ্গের একদম নিচে পাট করা থাকত বাবার তরুণ বয়সের মাফলার আর চাদর। ওই মাফলার ও চাদর কখনো রোদ পেত না, পেত আদর। তোরঙ্গ থেকে বের করে গলা ও গায়ে জড়িয়ে আবার গুছিয়ে রেখে দিতেন পরের শীতে নেড়ে দেখার জন্য। এমনই প্রেম আর ম্যাজিক নিয়ে আসত শীতকাল।

ছোটোবেলায় শীতকাল আসত ভয় সঙ্গে নিয়ে। পরীক্ষার ভয়। ভয় কাটিয়ে স্কুলফেরত পথে হঠাৎ ফাঁকা জমিতে দেখা যেত বিশাল তাঁবু। জোড়া হাতি ও জোকারের ছবি আঁকা গেটে লেখা, ‘দ্য রওশন সার্কাস’ বা ‘বুলবুল সার্কাস’।

এই তাঁবুই বুঝিয়ে দিত, ‘এসেছে শীতের দূত,/ এ লগন রোদ পোহাবার।’ ভোরে শিশিরভেজা ঘাসে হাঁটলে ঠান্ডায় লাল হয়ে যেত নাক। তাই মনে হতো, সার্কাসের জোকার লাল বলের নাকে করে বয়ে এনেছে শীতের রসদ। এবার ম্যাজিক করে তা ছড়িয়ে দেবে পুরো মফস্‌সলে।

অন্য সব মফস্‌সলের মতোই আমাদের মফস্‌সলে আকাশে ধোঁয়ার চাদর বিছিয়ে বিষণ্নতা নিয়ে আসত ক্ষণস্থায়ী বিকেল। ঠান্ডার অজুহাতে চিকলির বিলে গা ঘেঁষে বসে থাকত প্রেমিক-প্রেমিকা। কেউ আবার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে যেত ঝুপ করে নেমে আসা সন্ধ্যায়, সাদা কুয়াশায় ভরে যেত চারপাশ। এ রকম বহু প্রেম ও বিচ্ছেদের স্মৃতি হয়ে আসত শীত।

দুই

শীতকাল এলেই ‘পোড় পোহানো’র এমন দৃশ্য চোখে পড়ে

‘হরেক রঙের বাহারে,/ সকাল হলো আহারে’ গানের মতোই হাজির হতো নব্বইয়ের দশকের শীতের সকাল। অচেনা কোনো আরোহীর সাইকেলের বেল বাজাতে বাজাতে ঘন কুয়াশা পেরিয়ে যাওয়ার শব্দে শুরু হতো সকাল; কিংবা লেপ-তোশক তৈরির ধুনকারের হাঁকে। খেজুরগাছ থেকে রসের হাঁড়ি নামিয়ে আলপথ পেরিয়ে আসতেন গাছি।

কুয়াশা রঙের এই ঠান্ডা রস খাওয়ার পর নিজেকে উষ্ণ করার একমাত্র উপায় ছিল ‘পোড় পোহানো’। এ জন্য আগের দিন বিকেলেই প্রস্তুতি নিতে হতো। খড়, জমির কোণে পড়ে থাকা শুকনা ঘাস-পাতা ও ঘুঁটে কুড়িয়ে এনে ঢেকে রাখতে হতো।

সকালে ওই স্তূপে আগুন জ্বালানো হতো। চারপাশে গোল হয়ে বসে আগুন পোহাত জাড়ে জবুথবু কয়েক বাড়ির মানুষ। এরই মধে৵ হয়তো কেউ ‘গিলিগিলি ছুঁ’ বলে আগুনজ্বলা ছাইয়ের ভেতর থেকে বের করে আনত পাতলা খোসার নতুন আলু। আগুন ও আলু পোড়ার ঘ্রাণে ভেসে যেত সকালের কুয়াশা।

তিন

শীতের দিনে নরম রোদে বসে বই পড়তে ভালো লাগে

বেলা বাড়তে থাকলে উঠানের কোণে নরম রোদ এসে পড়ে। রোদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে উঠানে পাটি পেতে বই-খাতা নিয়ে বসে পড়তাম। রোদ পোহানো আর পড়াশোনা একসঙ্গে চলত। পাশে রোদ পোহাত পাখিরাও; রোদ পোহাত আচারের বয়াম, মায়ের নারকেল তেলের শিশি। এই রোদের লোভে পাশের বাড়ি থেকে ছুটে আসত সহপাঠী ববি। এমনই মায়া আর আরাম নিয়ে আসত সকালবেলার মখমলি রোদ।

যার ঘরে দেয়াল নেই, এমনকি শীতের পোশাকও নেই; যে শিশুটি বাবার লুঙ্গি গলা থেকে পা পর্যন্ত মুড়ে এসেছে আগুন পোহাতে, তার ঘরে, তার গায়েও লুটিয়ে পড়ে এই শীতের নরম রোদ। মানুষে মানুষে বিভেদ করার কোনো ষড় নেই রোদের। এমনই রোদের মাঝে বসে খোসা ছাড়িয়ে কমলালেবুর কোয়া খেতে দিতেন বাবা।

শীতের দিনে খোসা ছাড়িয়ে কমলার কোয়া মুখে পোরার আনন্দে ভাসেন কেউ কেউ

উঠানজুড়ে ভেসে বেড়াত সেই কমলালেবুর ঘ্রাণ। মনে হতো, এই উঠান যেন এক বিষণ্ন কমলালেবুর দেশ, যে দেশের রান্নাঘর থেকে ভেসে আসত অমৃতের ঘ্রাণ। মায়ের হাতে বানানো ভাপা, চিতই পিঠা, দুধ-পুলি কিংবা খেজুর রসের পায়েসের এই ঘ্রাণ পাওয়া যেত বেশ দূর থেকে; এমন ঘ্রাণ ভেসে আসত পাড়ার আর সব বাড়ি থেকেও। কী স্বাদ সেসব পিঠার!

বেলা আরেকটু বাড়লে ঝিমধরা রোদ পোহাতে আসতেন মা ও পাশের বাড়ির দিদিরা। পিঁড়ি পেতে বসে গল্প করতে করতে আশ্চর্য রঙের আলুশাক বেছে সুপারির খোলে রাখতেন তাঁরা।

কাঁচা টমেটোর সালাদ আর মাটি ফুঁড়ে কিছুদিন আগে বের হওয়া রসুন-পেঁয়াজের পাতা ও চিংড়ি দিয়ে সামান্য মুলার ঝোলে ভাত মেখে খেতে কী যে তৃপ্তি ছিল সে সময়! রান্নাঘর ভরে থাকত আচারের জন্য পাকা চালতা আর পেঁয়াজ-রসুন ও ধনেপাতার সুঘ্রাণ। এই ঘ্রাণ কি শুধুই চালতা আর পাতার! শীতের নিজস্ব ঘ্রাণ নয়?

চার

শীতকাল এলে অভিনেত্রী দিলারা জামানের মতো অনেকেই উল বুনতে বসেন

দুপুরের খাওয়া শেষে টুলে বসে ‘আদর’ বুনে রাখতেন মা। নানা রঙের উলের বল নিয়ে ক্রুশকাঁটায় বুনতেন এই আদর। এই উলের বল গড়াতে গড়াতে চলে যেত পরের বছর শীতে। কখনো পুরোনো শাড়িতে বুনে রাখতেন নতুন কাঁথা। এখন কি কেউ অমন যত্ন করে কাঁথা বা উল বোনেন? এই ‘ব্রেন রট’-এর যুগে মানুষের কি মনে থাকে বহু আগামীর কথা!

সুইডেনের ইউনিভার্সিটি অব গোথেনবার্গের তিন গবেষক জোয়ানা নর্ডস্ট্র্যান্ড, বিরজিতা গানারসন ও গ্রেটা হেগব্লুম-ক্রোনলফ ‘প্রোমোটিং হেলথ থ্রু ইয়ার্নক্র্যাফট: এক্সপেরিয়েন্সেস অব অ্যান অনলাইন নিটিং গ্রুপ লিভিং উইথ মেন্টাল ইলনেস’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছেন, উল বুনলে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে।

বিশেষ করে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগা ব্যক্তিদের জন্য বুনন খুবই উপকারী। জার্নাল অব অকুপেশনাল সায়েন্সে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, সুই-সুতা আর ক্রুশকাঁটা অনেক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে।

পাঁচ

‘পথের পাঁচালী’ সিনেমায় বৃদ্ধা ইন্দির ঠাকরুনের চরিত্রে চুনিবালা দেবী

‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের বৃদ্ধা ইন্দির ঠাকরুনের কথা মনে আছে? যিনি গায়ের ছেঁড়া চাদরের ফাঁক দিয়ে মুখ বের করে হরিকে বলেন, ‘বুড়ো মানুষকে কে দেখে বল? এই দেখ না, এই চাদরখানা! এই সন্ধ্যাবেলায় গায়ে দিয়ে বসি।’

হরি জানায়, ‘তা বেশ তো, এবার পূজোয় একখানা নতুন চাদর কিনে দেব।’
জবাবে বয়সের ভারে ন্যুব্জ ইন্দির এক গাল হেসে আকুতি জানিয়েছেন, ‘হ্যাঁ, দিবি তো! হ্যাঁ, দিবি তো! ও হরি, হ্যাঁ, দিবি তো! ও হরি…।’

মফস্‌সলে এমন অসংখ্য ইন্দির আছেন। শীতের কুয়াশা আর নরম রোদ যেমন সবাই দেখে, তেমনি এই ইন্দিরের মতো বয়স্ক মানুষকেও সবাই দেখুক। একটি চাদরের উষ্ণতা নিয়ে হাসিমুখে শরৎ আর বসন্তের মাঝে এই নাতিদীর্ঘ হিমসেতু পেরিয়ে যাক তাঁরাও।

ছয়

রোদ পোহাতে বসা সেই বিষণ্ন কমলালেবুর দেশ পেরিয়ে এক নির্জন প্রান্তরে এসে পড়েছি। এখানে হেমন্ত আসে, শীত আসে; কিন্তু মখমলি রোদ আসে না। এখানে সঙ্গ দিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)।

মানুষ হয়তো আর বুনবে না, এআইয়ের কোনো ভার্সন একদিন বুনে দেবে উল। জেমিনিকে প্রম্পট দিয়েছি, কিশোর বয়সের ফেলে আসা সেই বিষণ্ন কমলালেবুর দেশে নিয়ে যাও? অমনি দেখি, হুবহু কিশোর আমি পাটি পেতে বসে আছি বাড়ির রোদজ্বলা উঠানে!

বলেছি আবার, ভোরবেলা এই মুখের ওপর টুপ করে ফেলে দিয়ো টিনের চালা বেয়ে নামা শিশিরের ফোঁটা বা উঠানের কোণ থেকে এনে দাও কিছু নরম রোদ্দুর। দেবে বলে বাফার করছে জেমিনি। দীর্ঘ বাফারিংয়ের সামনে বসে শিশিরের হিমে ভিজে জবুথবু কানাইবাঁশি ফুলের মতো কেবলই শীত করতে থাকে…।