
মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বলার কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না রোকেয়া তাসমিমের। কলেজের ইতিহাস ক্লাবে যদি যুক্ত না হতেন, রোকেয়ার হয়তো জানাই হতো না, চমৎকার উপস্থাপনাও তিনি করতে জানেন। রোকেয়া পড়েন যশোরের সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজের ইতিহাস বিভাগে। দ্বিতীয় বর্ষে।
রোকেয়া তাসমিমের মতো এমন আরও অনেক শিক্ষার্থীই নিজেকে ‘আবিষ্কারের’ সুযোগ পাচ্ছেন ক্লাব কার্যক্রমের মাধ্যমে। কলেজের ১৯টি বিভাগের মধ্যে অন্তত ৯টি বিভাগের শিক্ষার্থীদেরই নিজস্ব ক্লাব আছে। বিভাগের শিক্ষকদের পৃষ্ঠপোষকতায় শুধু যে ক্লাসরুমের বাইরেও বিষয়ভিত্তিক পড়ালেখার চর্চা হচ্ছে, তা নয়, এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা অর্জন করছেন নেতৃত্বের গুণ।
গত ১৫ অক্টোবর ঢুঁ মেরেছিলাম এমএম কলেজের ইতিহাস বিভাগে। দেখা গেল একঝাঁক তরুণ শিক্ষার্থী বিভাগের সেমিনার রুমে বসে আড্ডায় মেতেছেন। একফাঁকে বিভাগের শিক্ষার্থী ও ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ রায় আবৃত্তি করে শোনালেন নিজের লেখা রুবাই (চার পঙ্ক্তির কবিতা)। একটি করে রুবাই শেষ হচ্ছিল, আর তাঁর সহপাঠীরা বলে উঠছিলেন, ‘সাধু সাধু’! এরপর দ্বিতীয় বর্ষের রোকেয়া তাসমিম শোনালেন গান। তালিও পেলেন তুমুল।
বিভাগের শিক্ষার্থী লিমা খাতুন বলেন, ‘আমাদের ক্লাবের মাধ্যমেই প্রথম বর্ষ থেকে শেষ বর্ষ পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর মধ্যে একটা বন্ধন তৈরি হয়েছে। নেতৃত্ব দেওয়ার দক্ষতা বেড়েছে। ক্লাবের উদ্যোগে কখনো আমরা বেরিয়ে পড়েছি রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী সুন্দরবনের ধুমঘাটে। আবার কখনো ভরত রাজার দেউল পরিদর্শনে। সেখান থেকে ফিরে ইতিহাসের খোঁজে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে আমাদের মধ্যে গবেষণামুখী হওয়ার উৎসাহ বেড়েছে। সেমিনার পেপার তৈরির মতো জটিল বিষয় আমরা রপ্ত করেছি। ক্লাব আছে বলেই প্রতিদিন একধরনের রোমাঞ্চ নিয়ে ক্যাম্পাসে আসি, পাঠ গ্রহণ করছি।’
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জানান, এই কলেজের ১৯টি বিভাগের মধ্যে শুরুতে ইতিহাস বিভাগই ক্লাব চালু করেছিল—২০২২ সালের ১৩ অক্টোবর। ক্লাবের উদ্যোগে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য ভ্রমণ, ‘রিসার্চ মেথডোলজি’ শিরোনামে দিনব্যাপী কর্মশালা, ইফতার পার্টি, টি পার্টি ও পিঠা উৎসবের মতো নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে। দুর্গত মানুষের পাশেও দাঁড়িয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
ক্লাবের পৃষ্ঠপোষক ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহজাহান কবীর বলেন, ‘এই ক্লাব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে কাজ করছে। পড়ালেখায় আনন্দ পাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি গবেষণামুখী হয়েছে। সেমিনার, ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণসহ অনুষ্ঠান আয়োজনে কী ধরনের প্রস্তুতি নিতে হয়, তা-ও তারা শিখেছে। জড়তা কাটিয়ে কথা বলার দক্ষতা অর্জন করেছে।’
স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণিতভীতি দূর করতে দুর্বার গতিতে কাজ করে যাচ্ছে এমএম কলেজের গণিত ক্লাব। ক্লাবের উদ্যোগে ইতিমধ্যে যশোর কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও মিউনিসিপ্যাল প্রিপারেটরি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আয়োজন করা হয়েছে অলিম্পিয়াড। অলিম্পিয়াডে অংশ নেওয়া সেরা ১০ জন সনদ পেয়েছেন। তিনজন জিতেছেন পুরস্কার।
গণিত ক্লাবের দপ্তর সম্পাদক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘গণিতভীতি দূর করতেই আমরা কাজ করি।’ ক্লাবের ফেসবুক পেজের মাধ্যমে গণিতের জটিল সমস্যা তুলে দিয়ে আবার সেটির সমাধানও দেওয়া হচ্ছে বলে তিনি জানান। এ ছাড়া পিঠা উৎসব, বার্ষিক বনভোজন ও মাসিক বৈঠকের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উজ্জীবিত করা হয়।
শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়নে বিভাগের ক্লাবগুলো অবদান রাখছে। এ ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে বরাবরই কলেজ কর্তৃপক্ষ উৎসাহ দিয়েছে। প্রতিটি বিভাগ যেন সহশিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ক্লাব গড়ে তোলে, সে বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আছে।এস এম শফিকুল ইসলাম, অধ্যক্ষ, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ
২০২৩ সালের শেষ দিকে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগে ফিন্যান্স ক্লাবের যাত্রা শুরু হয়। পরের বছর ২০২৪ সালের বন্যায় ‘মানবতায় তারুণ্য’ শিরোনামে এই ক্লাবের শিক্ষার্থীরা বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ক্যাম্পাস ও আশপাশ থেকে তাঁরা সংগ্রহ করেছিলেন প্রায় ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা। সেই টাকায় খুলনার পাইকগাছা উপজেলার বানভাসি ৫০০টি পরিবারকে ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হয়েছে। নোয়াখালীর দুটি পরিবারকে বানিয়ে দেওয়া হয়েছে কাঁচা ঘর। ক্লাবের পক্ষ থেকে গত দুই বছরে চারটি ঈদে দরিদ্র ব্যক্তিদের মধ্যে ঈদের সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বাড়াতে বিতর্ক ও পেশাবিষয়ক কর্মসূচিও দেয় ফিন্যান্স ক্লাব। ক্লাবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিতর্ক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সে সুবাদেই হয়তো কলেজ কর্তৃপক্ষ আয়োজিত আন্তবিভাগ বিতর্ক প্রতিযোগিতা–২০২৪-এ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ।
বিভাগের প্রভাষক সাইফুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘ফিন্যান্স ক্লাব তিনটি শাখায় কাজ করে—মানবতার তারুণ্য, ক্যারিয়ার ও বিতর্ক। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মানবিক, যোগ্য ও দক্ষ হিসেবে গড়ে উঠতে উৎসাহ দেওয়া হয়।’
যশোরের সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের বিজ্ঞান ক্লাবের উদ্যোগে ক্যাম্পাসের পুকুরে সফলভাবে মুক্তা চাষ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলেজের ১৯টি বিভাগের ১৩৮ জন শিক্ষার্থীকে দিনব্যাপী মুক্তা চাষ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এরপর ক্যাম্পাসের একটি পুকুরে ছাড়া হয় ১০০টি ঝিনুক। চলতি বছরের আগস্টে ঝিনুক থেকে মুক্তা সংগ্রহ করা হয়েছে।
বিজ্ঞান ক্লাবের নির্বাহী কমিটির সদস্য ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মহসীন উদ্দিন বলেন, ‘বিজ্ঞান ক্লাবের উদ্যোগে ক্যাম্পাসে একটি পুকুরে মুক্তা চাষ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এক বছর পরে ৪০টি ঝিনুক টিকে ছিল। সেখান থেকে ৮০টি মুক্তা পাওয়া গেছে। মুক্তাসহ প্রকল্পের প্রতিবেদন কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। আরও শিক্ষার্থীরা মুক্তা চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। কর্মশালায় যোগ দেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্তত ১৫ জন আমাকে জানিয়েছে, তারা উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেদের বাড়ির পুকুরে মুক্তা চাষ শুরু করেছে।’
শুধু মুক্তা চাষ প্রকল্প নয়; পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াড, রসায়ন অলিম্পিয়াডসহ নানা আয়োজনে অংশগ্রহণের জন্য ক্লাবের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি পাঠানো হয়। এ ছাড়া বিজ্ঞান মেলায় স্টল দেওয়াসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তো আছেই।