
দৌড় প্রতিযোগিতা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এটি যেন একটা ট্রেন্ড হয়ে উঠেছে। স্বল্প দূরত্বের দৌড় থেকে হাফ ম্যারাথন, পূর্ণ ম্যারাথন কিংবা আলট্রা—দেশজুড়ে তৈরি হয়েছে দৌড়ের নতুন এক সংস্কৃতি। এই দৌড়-উন্মাদনা নিয়েই লিখেছেন এভারেস্টজয়ী বাবর আলী
শেষ রাতের আয়েশি ঘুম ছেড়ে হাজির একদল নারী-পুরুষ। জুতার ফিতায় পা দুটোকে বেঁধে স্টার্ট লাইনের সামনে দাঁড়িয়েছেন তাঁরা। সদ্য গোঁফ গজানো কিশোর থেকে কাশফুলের মতো সাদা কেশগুচ্ছের অধিকারী প্রবীণ—আছেন সবাই। সবার চোখেমুখেই ব্যগ্রতা। রেস পরিচালকের ‘স্টার্ট’ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের পদাঘাতে মুখর হয় পথ। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, এদের পথের কোনো শেষ নেই; দৌড়াচ্ছে তো দৌড়াচ্ছেই!
মানুষের শারীরিক সক্ষমতার সে কী বলিষ্ঠ প্রকাশ! আর কেউবা ধীর, স্থির পদচালনে অভ্যস্ত। একদমই অচেনা কারও পাশাপাশি দৌড়াতে গিয়ে খসে পড়ে অপরিচয়ের দেয়াল। এই সান্নিধ্যসুখ অনেকের জীবনেই থেকে যায় লম্বা সময়। দৌড়ের সময় আশপাশের বাড়ির উঠান থেকে অনেকেই করতালির মাধ্যমে স্বাগত জানান।
লম্বা দৌড়ে শরীর যখন মনের কথা শুনতে চায় না, তখন একদম অচেনা কারও কাছ থেকে পাওয়া এইটুকু উৎসাহ রীতিমতো টনিকের কাজ করে। পাঁজরের ভেতর বুনো ঘোড়ার মতো লাফাতে থাকা হৃৎপিণ্ডকে কেয়ার করার ফুরসত তখন কই। সবকিছুর যেমন শেষ আছে, একসময় পথও ফুরোয়।
ভোরের আকাশে তখন হয়তোবা শিশুসূর্যের রাজত্ব। শেষের রেখা ছুঁয়ে অনেকের চোখেই থাকে অসাধ্য সাধনের আনন্দ, নিজেদের সামর্থ্যের পারদটা আরেকটু উঁচুতে নিয়ে যাওয়ার পুলক। টানা দৌড়ানোর ফলে জীবনীশক্তি খানিকটা নিবু নিবু হলেও ফিনিশ লাইনে পৌঁছালে ঠোঁটে থাকে অমূল্য হাসি। শেষের রেখায় পৌঁছানোর আনন্দের কাছে ম্লান হয়ে যায় পথের শ্রান্তি।
ঢাকা কিংবা বিভাগীয় শহর তো বটেই, দেশের নানা জেলা, উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এ রকম যূথবব্ধ দৌড় এখন সাধারণ চিত্র। আর এসব রানারদের কারণে দেশের বড় একটা অংশের কাছে দৌড় এখন হয়ে গেছে জীবনের অঙ্গ!
কয়েক বছর আগেও দৌড়াত কিংবা জোরে হাঁটত মূলত নানা অসংক্রামক রোগে ভোগা বর্ষীয়ান, স্বাস্থ্যসচেতন জনাকয়েক মানুষ। অ্যাথলেট আর নানা বাহিনীতে যোগ দিতে আগ্রহী তরুণদেরও কাজটা করতে দেখা যেত।
এখন ‘দৌড়ের ওপর আছি’ বলা মানুষের সংখ্যা প্রচুর। ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো বড় শহরের নানা পার্ক কিংবা মফস্সলের মেঠো পথেও রানারদের নিয়মিত পদচারণ। পাঁচ-সাত কিলোমিটারের স্বল্প দূরত্বের দৌড় যাঁরা অতিকষ্টে শেষ করতেন কিংবা হাফ ম্যারাথনের দূরত্ব পাড়ি দিতে যাঁদের হাঁপ ধরে যেত, তাঁরাই নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে পাড়ি দিচ্ছেন পূর্ণ দূরত্বের ম্যারাথন কিংবা আলট্রা ম্যারাথনের অতি দূরত্ব।
কোমর বা শরীর থেকে অতিরিক্ত মেদ ঝরিয়ে ফেলতে কিংবা শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনের আশায় দৌড়াতে এসে অনেকেই এখন এই জগতের আনন্দে মশগুল। নিয়মিত দৌড় হয়ে গেছে তাঁদের ফিটনেস জার্নির অংশ। দেশজুড়ে আয়োজিত স্বল্প দূরত্বের দৌড়, হাফ ম্যারাথন, ম্যারাথন কিংবা আলট্রা ম্যারাথনগুলোর এর পেছনে বড় ভূমিকা আছে।
অনেক আগে থেকেই দেশে নানা দৌড় প্রতিযোগিতার চল ছিল। তবে ২০১৮-১৯ সাল থেকে সাধারণ্যের মধ্যে এর প্রসার বাড়তে শুরু করে। মাঝখানে কোভিড-১৯-এর কারণে এই যাত্রা খানিকটা থমকে গেলেও পরে দৌড়ের নানা প্রতিযোগিতা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
আগে বছরজুড়ে আয়োজিত ম্যারাথন বা হাফ ম্যারাথনের সংখ্যা যেখানে আঙুলের কর গুনে করে ফেলা যেত, সঠিক হিসাব রাখতে এখন সেখানে দরকার এক্সেল শিট!
ম্যারাথন কিংবা হাফ ম্যারাথন এখন শুধু প্রতিযোগিতা নয়, একটা উৎসব। অনেকের কাছে নতুন একটা জেলা কিংবা উপজেলা ঘুরতে যাওয়ার উপলক্ষ। অবশ্য দৌড়বিদদের কাছে ‘লক্ষ্য’ কখনো উপলক্ষের চেয়ে বড় নয়।
ম্যারাথন উপলক্ষে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আগের দিন আয়োজিত হয় কিট এক্সপো। এ দিন রানারদের হাতে তুলে দেওয়া হয় ইভেন্ট জার্সি, বিবসহ আনুষঙ্গিক সামগ্রী। আর এই কিট এক্সপো ঘিরে পুরো এলাকাতেই থাকে উৎসবমুখর পরিবেশ।
স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য, কৃষ্টির সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ যেমন থাকে, তেমনি জেলা-উপজেলার নানা দ্রষ্টব্য, জিআই পণ্যের সঙ্গেও রানারদের জানাশোনার দারুণ মাধ্যম এই অনুষ্ঠান। মেডেল কিংবা জার্সিতে স্থানীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি কিংবা দ্রষ্টব্য ফুটিয়ে তোলার একটা প্রবণতাও দেখা যায়।
নানা মোটিফে ফুটিয়ে তোলা হয় বন-জঙ্গল-পাহাড় কিংবা স্থানীয় কোনো বন্য প্রাণী সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা। আর দৌড়সহ নানা স্পোর্টসে যাঁরা নিজেদের নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়, তাঁদের গল্প শোনারও দারুণ সুযোগ এই এক্সপো।
দৌড়ের এসব ইভেন্টে অনেকে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেন। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পাড়ি দেওয়া রানারদের জন্য পানি, গ্লুকোজ, স্যালাইন, জুস, মৌসুমি ফলের পসরা সাজিয়ে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর অপেক্ষায় থাকেন তাঁরা।
শহুরে রাস্তার পাশাপাশি দুর্গম নানা অঞ্চলে আয়োজিত প্রতিযোগিতাতেও কাজ করেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। পরে নানা সামাজিক প্রয়োজন কিংবা দুর্যোগে ‘ফার্স্ট রেসপন্ডার’ হিসেবেও তাঁরা এগিয়ে আসেন।
স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে দৌড়ে উদ্বুদ্ধ করতে এলাকাভিত্তিক অনেক দলেরও জন্ম হয়েছে। এগুলো মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক গ্রুপ হলেও কমিউনিটি গড়ে তুলতে এদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
‘আমি নই, আমরা’ এই মনস্তত্ত্ব ও সাহসের জোগানদারও এরা। তবে জাতি হিসেবে আমাদের সবারই নেতা হতে চাওয়ার প্রবণতার কারণে ভাঙনের সংখ্যাও প্রচুর। এলাকাভিত্তিক এক গ্রুপ ভেঙে তিনখানা আলাদা আলাদা গ্রুপ তৈরির নজিরও আছে! বিভেদের বেড়া যে সেই আবহমান কাল থেকে আমাদের সঙ্গী!
শেষ রানারটাও যাতে গলা ভেজানোর জন্য পর্যাপ্ত পানি পান, সেটার এন্তেজাম রাখাটা একান্ত প্রয়োজন। আবার অনেকেই আনুষঙ্গিক অন্যান্য আয়োজনে এত ব্যস্ত থাকে যে আয়োজনের কেন্দ্রবিন্দু যে মূল ট্র্যাক, সেদিকেই নজর দিতে ভুলে যান।
আবার নিজ সামর্থ্যের আওতার বাইরে গিয়ে অনেকেই আয়োজন করে ফেলেন ম্যারাথন বা আলট্রা ম্যারাথন। সে ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা সুনিশ্চিত! তবে ঢাকা কিংবা কোনো বিভাগীয় শহরে একটা আয়োজন করা যত সহজ, সেই একই উদ্যোগ একটা উপজেলা, ইউনিয়ন কিংবা পাহাড়ের কোনো জায়গায় বাস্তবায়ন করাটা ততটাই দুরূহ।
প্রস্তুতির ঘাটতি থাকলে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় রানিং ট্র্যাক। যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে না এলে উপভোগের বদলে এই খেলা ‘স্পোর্টস অব সাফারিংস’ হয়ে যাওয়াটা বিচিত্র কিছু না। এই মুশকিলে পড়েন অনুশীলন নির্ভর না হয়ে ইভেন্ট-নির্ভর হয়ে পড়া দৌড়বিদেরা। লম্বা পথের আগ্রাসন প্রতি পদক্ষেপে টের পান তারা!