মানুষ আসলে চায় তাকে কেউ দেখুক। তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুক
মানুষ আসলে চায় তাকে কেউ দেখুক। তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুক

যাকে ভিলেন ভেবেছ, সে-ই হয়তো সবচেয়ে পছন্দের মানুষ

অভিনয়জগতে আছেন তিন দশকের বেশি। ‘বোনস’–এর মতো জনপ্রিয় সিরিজে কাজ করলেও তাঁকে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি দিয়েছে স্পাইডার-ম্যান ২ ছবির ৩০ সেকেন্ড স্থায়ী একটি চরিত্র। এত বছর পরও সেই দৃশ্য থেকে তৈরি হয় মিম। বুঝতেই পারছেন, এমিলি দেশানেলের কথা বলছি। বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৮ মে সমাবর্তন বক্তৃতা দিয়েছেন এই অভিনেত্রী। সেখান থেকে নির্বাচিত অংশ।

টিভি পর্দায় বহু চরিত্রেই অভিনয় করেছি। কখনো ডাক্তার, কখনো উকিল, কখনো আবার কোম্পানির প্রধান হয়ে সামলেছি বিশাল ব্যবসা। আমি সামান্য অভিনয়শিল্পী, এতটুকুই করতে পারি। তোমাদের মতো আইন, ব্যবসা, ওষুধ নিয়ে পড়ার মতো মেধা আমার ছিল না; বরং আমার যতটুকু মেধা ছিল, তা অভিনয়েই কাজে লাগিয়েছি।

তোমরা পাস করে যে চাকরিতে প্রবেশ করবে, তার সবকিছুই আমি করেছি। হোক না সেটা পর্দায়, কিন্তু করেছি তো!

তিন দশকের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পেরেছি, অভিনয় মানে শুধু একটি চরিত্র করা না, অন্য কারও ‘ভান’ করাও নয়। অভিনয় মানে একটি চরিত্রের সঙ্গে মিশে যাওয়া। তার আচার-আচরণ, আবেগ-অনুভূতি বুঝতে পারা। সুখ-দুঃখে সহমর্মী হওয়া।

একটি চরিত্র তৈরিই হয় মানুষের অব্যক্ত চাওয়া-পাওয়াকে কেন্দ্র করে। মানুষ কী চায়? কেন চায়? কীভাবে চায়? আমি নিজেও সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এ প্রশ্নের উত্তর আমি অভিনয়ের মধ্য দিয়েই পেয়েছি।

অভিনয় মানে একটি চরিত্রের সঙ্গে মিশে যাওয়া

তখন আমি তৃতীয় বর্ষে পড়ি। এমন সময় আন্তর চেকভের থ্রি সিস্টার্স নাটকে অভিনয়ের সুযোগ আসে আমার কাছে। নাটকের মূল চরিত্র তিন বোন। আমার ছিল সবচেয়ে ছোট বোনের চরিত্র—ইরিনা। তিন বোন আর ভাইয়ের ছোট্ট বাসা, মিলেমিশে থাকে। সেই সংসারে হাজির হয় নাটকের ভিলেন ইরিনার হবু ভাবি নাতাশা।

তার ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে ঘর ছাড়ে ইরিনা। আমার অভিনয়জীবনের অন্যতম সহজ চরিত্র ছিল সেটি। কারণ, আমি বড়ই হয়েছি নাতাশা চরিত্রকে ঘৃণা করে। তাই ইরিনার সঙ্গে নিজেকে মেলানো আমার জন্য খুব সহজ ছিল।

কয়েক বছর পর, লস অ্যাঞ্জেলেসে একই নাটকে অভিনয় করার সুযোগ মিলল, কিন্তু চরিত্রটা ভিন্ন। আমি আর সেই ছোট্ট ইরিনা নই, আমি এখন নাতাশা। কয়েক বছর আগেও যাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতাম, সেই নাতাশাই হয়ে উঠল আমার প্রতিদিনের সঙ্গী।

যত দিন যেতে লাগল, আমি যেন নাতাশাকে বুঝতে শুরু করলাম। নাতাশাও ভিলেন নয়, তার বুকেও আছে জমে থাকা অব্যক্ত কষ্ট। সেও চায় তার প্রতি কেউ সহমর্মী হোক, তাকে কেউ দেখতে পাক। কেউ তার কষ্টের সঙ্গী হোক।

দুটি চরিত্র মঞ্চের দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে, দুজনই নিজের কষ্টের কথা বলছে। কিন্তু একজনের কষ্ট সবাই দেখতে পাচ্ছে, আরেকজনেরটা অনুপস্থিত।

নাতাশা চরিত্রটি করতে গিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম, মানুষ আসলে চায় তাকে কেউ দেখুক। তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুক। করুণা করে নয়, তার প্রতি সম্মান রেখে কথা বলুক। মানুষ সহমর্মিতা চায়, সহানুভূতিও চায়। কিন্তু সেটি নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে নয়।

কোনো দিন অনেক ভালো যাবে, কোনো দিন অনেক খারাপ। এ নিয়ে এত ভাবলে নিজের কাজটা ঠিকমতো করতে পারবে না

‘বোনস’ সিরিজের প্রথম সিজনের কথা। আমার বয়স তখন মাত্র ২৮। টিভি সিরিজের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করছি। মনের ওপর, শরীরের ওপর প্রচণ্ড চাপ। শিডিউল সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে না, ঘুম হচ্ছে না।

সেটেও বেশ কিছুদিন দেরি করে গিয়েছি। হুট করে একদিন শো রানার হার্ট হানসেন এসে কড়া নাড়লেন আমার ট্রেলারে। আমি ভাবছিলাম, আমার অভিনয় কি এতই ভালো হচ্ছে যে নিজে এসে আমার প্রশংসা করছেন? না, হয়েছিল উল্টোটা।

আমার কাজ নিয়ে মোটেই সন্তুষ্ট ছিল না স্টুডিও। সেটে দেরি করে আসা, অভিনয়ে ভুল নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিল তারা।

পরদিন সব প্রস্তুতি নিয়েই সেটে হাজির হলাম। স্টেজে ঢুকেই দেখি, শো রানার, স্টুডিওর প্রযোজক, পরিচালক—সবাই উপস্থিত। চাকরিচ্যুত করতে নয়, আমার জন্মদিন উদ্‌যাপন করতে। তাঁদের দেখে দৌড়ে সেট থেকে বের হয়ে গেলাম। কোনোভাবেই কান্না সামলাতে পারছিলাম না।

বারবার মনে হচ্ছিল, গতকাল যাঁরা আমার সমালোচনা করলেন, শো বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবলেন, তাঁরাই আমার জন্মদিন উদ্‌যাপন করতে এসেছেন? এটা তো সম্ভব না। হতে পারে চাকরি কেড়ে নেওয়ার আগে এটাই তাঁদের শেষ উদ্‌যাপন। হয়তো এখানেই আমার ক্যারিয়ারের ইতি টানা হয়ে যাবে।

ঠিক সেই সময়ে আমাকে শান্ত করতে এগিয়ে এলেন হানসেন। আমাকে আড়ালে নিয়ে বোঝালেন, অভিনয়জীবনটা এ রকমই। কোনো দিন অনেক ভালো যাবে, কোনো দিন অনেক খারাপ। এ নিয়ে এত ভাবলে নিজের কাজটা ঠিকমতো করতে পারবে না; বরং নিজের কাজটা ঠিকমতো করো, দেখবে তোমার চাকরি নিজে নিজেই টিকে থাকবে।

মজার ব্যাপার হলো হানসেন নিজেও তখন চিন্তায় মরছেন। জানেন না, তাঁর চাকরি আছে কি না, শোর ভাগ্য কী হবে? তা সত্ত্বেও তিনি আমার কথা শুনেছেন, আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। আমি দ্রুতই কাজে ফিরেছি, নিজের সর্বোচ্চটা দিয়েছি। শো হয়েছে সুপারহিট। টানা ১২ বছর একসঙ্গে কাজ করেছি আমরা।

মনে রাখবে, জীবনের প্রতিটা দিন সমান যায় না। কোনো দিন অডিশনে দাঁড়িয়ে সবার সামনে গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করবে। কোনো দিন সব ছেড়ে বাড়ি ফিরে যেতে মন চাইবে। চারপাশের এত প্রতিযোগিতা, এত চাপ অসহ্য হয়ে উঠবে। সেই লড়াইয়ে তখন নিজেকে একটু ছাড় দিতে হবে। দুই পা পিছিয়ে সামনে এগোনোর লড়াই করতে হবে। হ্যাঁ, নিজের সঙ্গে নিজের প্রতিযোগিতা তো থাকবেই। নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার লড়াই, নিজেকে নতুন করে গড়ার লড়াই। কিন্তু এর মধ্যেও একটু ছাড় দিয়ো।

কারও প্রতি সহমর্মী হওয়া, তার প্রতি সহানুভূতি দেখানো কোনো দুর্বলতা নয়। এর মানে তার আগের ব্যবহারকে ছাড় দেওয়াও নয়। সহানুভূতি মানে আরেকজনের প্রয়োজন বুঝে পাশে থাকা। প্রয়োজনের সময় সঙ্গ দেওয়া। যখন একজনের কাছে পুরো পৃথিবী অর্থহীন হয়ে ওঠে, সেই সময়ে তাকে জানান দেওয়া, তার কথা শোনার মতো মানুষও এখানে আছে। সহানুভূতি শুধু অন্যকে সাহায্য করার জন্য নয়; বরং নিজের জন্য, মন খারাপের দিনে নিজেকে এগিয়ে নেওয়ার জন্যও দরকার।

সবার এখন ব্যস্ত একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায়। সহানুভূতি যেন অলীক কল্পনা। নিজেদের মধ্যকার এ প্রতিযোগিতায় অন্যকে সাহায্য করা, সঙ্গ দেওয়ার কথা ভুলে যেয়ো না। কারণ, হয়তো দেখা যাবে যাকে ভিলেন ভেবে বসে ছিলে একদিন, সেই তোমার সবচেয়ে পছন্দের মানুষ।

সূত্র: বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় ইউটিউব