
পরীক্ষার ফল খারাপ হলে মন ভেঙে যায়। আর যদি বেশি খারাপ হয়, তবে চারদিক শূন্য শূন্য লাগে। মনে হয়, পাশে কেউ নেই। মা-বাবা বকতে শুরু করেন। আশপাশের কারও দিকে তাকানো যায় না। মনে হয়, এই জীবনের মানে কী?
এসো, তোমাকে এ সময়ের একজন ব্যর্থ মানুষের গল্প শোনাই। সত্যি গল্প। জ্যাক মার নাম জানো তো? চীনের ব্যবসায়ী। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উদ্যোক্তাদের একজন। অথচ চীনের জাতীয় কলেজে ভর্তির জন্য তাঁকে তিনবার পরীক্ষা দিতে হয়েছে। দশবার চেষ্টা করেও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেননি। চাকরির জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেও সফল হননি। কিন্তু জ্যাক মা হাল ছেড়ে দেননি। দিলে আজ তিনি আলীবাবার মতো এত বড় প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পারতেন না।
এটা ঠিক, প্রতিটি ব্যর্থতার সঙ্গে কষ্ট থাকে। সেই কষ্টটা কখনো কখনো গভীর হয়। সহজে ভোলা যায় না। এটাকেই জীবনে কাজে লাগাতে হয়। ভুলতে না পারা সেই কষ্টকে জীবনের উদ্যম আর প্রেরণা করে তুলতে হয়। তা ছাড়া প্রতিটি ব্যর্থতা থেকেই কিছু না কিছু শেখার থাকে।
আচ্ছা, মনে করো, এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় তুমি জিপিএ-৫ পেয়েছ। তাতে কী হতো? মা-বাবা খুব খুশি হতেন। বুক ফুলিয়ে আত্মীয়দের এই রেজাল্ট বলে বেড়াতেন। আশপাশের বাসায় হয়তো মিষ্টি পাঠাতেন। এই রেজাল্ট নিয়ে তোমারও খুব গর্ব হতো। গর্বে মাটিতে পা পড়ত না। এর কিছুদিন পরের কথা ভাবো। মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা। তুমি হয়তো সেসব জায়গায় ভর্তির সুযোগ পেলে না। তখন মনে হতো, এই জিপিএ নিয়ে লাভ কি হলো!
জিপিএ-৫ পাওয়া কখনোই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না। তা ছাড়া জিপিএর ওপর ক্যারিয়ারও নির্ভর করে না। এটা ঠিক, ভালো জিপিএ চলার পথকে সহজ করে। কিন্তু সেটা গন্তব্যকে নিশ্চিত করে না। ক্যারিয়ার নির্ভর করে আরও অনেক কিছুর ওপর। সেগুলো বুঝে এগিয়ে যেতে হয়।
আজ তুমি যথেষ্ট ভালো ফল করতে পারোনি। আশপাশের সবাই কেমন যেন সরু চোখে তোমার দিকে তাকাচ্ছে। সেটা দেখে আরও হতাশ হচ্ছো। কয়েক দিন আগেও ভেবেছিলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে, ডাক্তারি পড়বে। এখন দেখছ, এই জিপিএ দিয়ে সেটি সম্ভব নয়। সেসব আশা এখন ছাড়তে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ হয়তো আছে। কিন্তু সেখানেও ভর্তি হতে পারবে কি না, বুঝতে পারছ না।
বলো দেখি, চলার পথ কি একটাই? এক পথ ছেড়ে অন্য পথে হাঁটতে সমস্যা কোথায়? এত দিন যেটাকে তোমার পথ ভেবেছ, সেটি তোমার পথ না-ও হতে পারে। কারও বিজ্ঞানের বিষয় পড়তে ভালো লাগে। কারও ভালো লাগে মানবিক বা বাণিজ্য শাখার বিষয়। তুমি এখন নতুন করে আরেকবার ভাবো, কোন শাখায় তুমি থাকবে। মা-বাবা কিংবা অন্য কারও দিকে তাকিয়ো না। তোমার মন কী বলে, সেটা দেখো।
অভিভাবকদের বলি, আপনি হয়তো আপনার সন্তানকে বিজ্ঞান শাখায় দিয়েছিলেন। দিয়েছিলেন, কারণ মনে করেছিলেন মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানে পড়ে। এমন ধারণা তৈরি হওয়ার পেছনে আমাদের স্কুলগুলোও দায়ী। ভালো রেজাল্ট করা শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হতে বলে। অথচ যার যেটি পড়তে ভালো লাগে, তাকে সেটি পড়তে দেওয়ার দরকার ছিল।
এইচএসসি পরীক্ষার ফল দেখে যারা নিজেকে ব্যর্থ ভাবছ, তারা সামনের দিকে তাকাও। আর কয়েক বছর পর তুমি বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির চাকরির জন্য লড়াই করবে। সেখানে প্রায় ক্ষেত্রেই তোমার এই রেজাল্ট কোনো প্রভাব রাখবে না। এমনকি উচ্চতর পড়াশোনা শেষ করেও অনেকে স্বাধীন পেশায় নামে। সেখানেও এই ফল সরাসরি কোনো ভূমিকা রাখে না।
তোমার সামনে এখন নতুন সুযোগ এসেছে। পিছিয়ে পড়ার এই কষ্টকে সামনে এগোনোর শক্তিতে রূপান্তরিত করো। পিছিয়ে পড়া মানে হেরে যাওয়া নয়। অনেক সময় উচ্চ লাফ দেওয়ার জন্য একটু পেছনে এসে দৌড় শুরু করতে হয়।
দেখো, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ তোমার রয়েছে কি না। থাকলে পুরোনো প্রশ্ন দেখে প্রস্তুতি নাও। এখন ভর্তি পরীক্ষার ওপরই বাকিটা নির্ভর করবে। সুযোগটাকে কাজে লাগাও। আর যদি তোমার ফল আরও খারাপ হয়ে থাকে, তাতেও নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। পরের বছরের এইচএসসি পরীক্ষার জন্য নতুন করে সবকিছু শুরু করো।
তোমার চেষ্টা ও উদ্যম তোমাকে সফল করবে। পৃথিবীতে যাঁরা বড় হয়েছেন, সফল হয়েছেন, তাঁদের কেউই চেষ্টা আর উদ্যম হারাননি। তাঁরা কখনো পরীক্ষার ফলের দিকে তাকাননি। তাঁরা অনেক দূর থেকে ভবিষ্যৎকে দেখতে পেতেন। গন্তব্যকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে সামনে এগোতেন। তাই তাঁদের গন্তব্যে পৌঁছাতে সমস্যা হয়নি। তবে তাঁদের চলার পথেও বাধা ছিল, কষ্ট ছিল। এগুলোকে বিবেচনায় নিয়েই তাঁরা এগিয়েছেন। থেমে যাননি। বাধা সরানোর কষ্ট তাঁরা উপভোগ করেছেন। জীবনকে বৃহৎ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শিখেছেন।
আরেকটা কথা। তুমি কি নিজেকে ভালো মানুষ করে তুলতে পেরেছ? ভালো মানুষ শুধু নিজের দিকে তাকায় না। ভালো মানুষ অন্যের দিকেও তাকায়। অন্যকে ভালোবাসে। ভালো মানুষ তার চারপাশকে ভালো রাখে। ভালো মানুষ নিজেকে নিষ্ক্রিয় রাখে না। সে সব সময় ভালো কাজ করতে থাকে। তুমি ভালো মানুষ হয়ে ওঠো। তবে অন্যদের কাছ থেকেও ভালোবাসা পেতে থাকবে।