বন্ধু দিবস

বন্ধুত্বে পাঁচে পাঁচ

স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়—শিক্ষাজীবনের একেকটা ধাপ। নতুন নতুন বন্ধুর সঙ্গে পরিচয়। তবে একই বন্ধুর সঙ্গে জীবনের এই তিন গুরুত্বপূর্ণ সময় পার করার অভিজ্ঞতাও কারও কারও আছে। তাঁদের বন্ধুত্বটা কেমন? এই বিষয়েই পাঠকের কাছে লেখা আহ্বান করেছিলাম আমরা। আজ আগস্ট মাসের প্রথম রোববার, বন্ধু দিবসে পাঠকের লেখা নিয়ে বিশেষ আয়োজন।

এক বন্ধু ছবিতে অনুপস্থিত
এক বন্ধু ছবিতে অনুপস্থিত

‘কিরে, মিজান। তাড়াতাড়ি আয়। আর সেতুকে বল একটা টেপ কিনে আনতে। বলে প্যাঁচানো লাগবে।’ এ রকম কথা হতো প্রায় প্রতিদিন। খেলার মাঠের কতশত স্মৃতি জমে আছে, সেগুলো হয়তো বলে শেষ করা যাবে না।

বলছিলাম স্কুলের দিনগুলোর কথা। সেই ছোট্টবেলা। নার্সারি, কেজি থেকে শুরু। এত ছোট বয়সের কথা মনেও নেই তেমন ভালো করে। তবে স্কুলের ম্যাগাজিন খুললেই বুঝতে পারি, কত ছোট থেকে আমরা একসঙ্গে বড় হয়েছি। উত্তরের জেলা দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলায় আমাদের স্কুল। উপজেলা শহর থেকেও প্রায় ছয় মাইলের পথ। তাই মফস্বল শহরও হয়তো বলা যায় না। চারদিকে সবুজের সমারোহ, মাঝে কিছু দালানকোঠায় তৈরি এই শিক্ষাঙ্গন। স্কুলের নাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বিইউএসএমএস, পার্বতীপুর, দিনাজপুর। আমি ও বীণা নার্সারিতেই ভর্তি হই। সেতু ও মিজান আসে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। আসিফ যোগ দেয় ষষ্ঠ শ্রেণিতে।

সবার আগে বীণার সঙ্গে পরিচয়। একসঙ্গে এক শাখায় ক্লাস করেছি শিক্ষাজীবনের প্রথম দিন থেকে। প্রতিটা ক্লাসে প্রথম তিনে ওর থাকা চাই-ই চাই। পড়ালেখা ছিল ওর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। আমরা এক স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তাম। স্যারের বাসা একটি দূরে ছিল। সবাই দলবেঁধে হেঁটে হেঁটে যেতাম। এর মধ্যে যে কত গল্প হতো, কত স্বপ্ন দেখা হতো। সেসব দিনের কথা ভাবতেও ভালো লাগে।

সেতু আর মিজানের সঙ্গে ক্লাসে তো দেখা হতোই। তবে বেশি জমত খেলার মাঠে। ভালো বোলার ছিল সেতু। আর আমারও ছিল খেলার ঝোঁক। তাই বিভিন্ন জায়গায় খেলতে যেতাম আমরা। ক্লাসের হয়ে খেলা, পাড়ার হয়ে খেলা, ক্লাবের হয়ে খেলা, আরও কত কী।

পরে এলেও আসিফের সঙ্গে বন্ধুত্ব জমেছিল বেশ। যেহেতু খেলা নিয়ে আমাদের আগ্রহ বেশি ছিল, তাই এসব নিয়েই কথা হতো বেশি। সে সময় ক্রিকেটারদের স্টিকার পাওয়া যেত। স্টিকার জমানোর জন্য সে কী উৎসাহ। এ ছাড়া গান, সিনেমা নিয়ে আলোচনাও ওর সঙ্গেই শুধু হতো।

এসএসসির পর আমরা একই প্রতিষ্ঠানের কলেজ সেকশনে ভর্তি হলাম। এ ব্যাপারটা একটু মজার। ১২ বছর এই স্কুলে পড়েছি। তাই নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা সহপাঠী হয়েও আমাদের ‘বড় ভাই’–এর চোখে দেখত। এটা খুব উপভোগ করতাম। কলেজে উঠে আমরা সবাই সহশিক্ষা কার্যক্রমে বেশ জোর দিয়েছিলাম। বিতর্ক, আবৃত্তি, কুইজ, কিছুই বাদ দিইনি। ইন্টার হাউস প্রতিযোগিতাগুলোয় তখন কঠিন লড়াই হতো।

এরপরে আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কঠিন ভর্তিযুদ্ধ। এই সময়টায় আমাদের মধ্যে একটু দূরত্ব তৈরি হয়। নিজেদের মতো করে প্রস্তুতি নিতে থাকি। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ছিল বেশির ভাগের। সেটা হয়তো হয়নি। তবে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ১২০০ একরের ক্যাম্পাসে পা রাখার পর সব হতাশা কেটে গেছে। আমরা পাঁচ বন্ধুই এখন বাকৃবিতে পড়ি। প্রথমবার সুযোগ পাই চারজন। পরের বছর আরেকজন। আমি, বীণা ও সেতু ভেটেরিনারি অনুষদের শিক্ষার্থী। আসিফ আর মিজান কৃষি অনুষদে। মিজান ও সেতু এক হলে থাকে, বঙ্গবন্ধু হল। আমি ও আসিফ শামসুল হক হলে। তাই স্কুলজীবন থেকে শুরু করে এখনো আমাদের দেখা হয় প্রতিদিন।

বাকৃবিতে সুযোগ পাওয়ার পর শুরুর দিনগুলোতে নদীর পাড়ে আড্ডা দেওয়া হতো। বাকৃবিতে যাঁরা গেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন, আমাদের ক্যাম্পাসটা কী সুন্দর! নদীর পাড়ে বসে আমরা স্কুল-কলেজজীবনের স্মৃতিচারণা করতাম। একসঙ্গে পাঁচজন বাকৃবিতে ভর্তি হয়েছি শুনে স্কুলের শিক্ষকেরাও অনেক খুশি হয়েছিলেন, সেটা নিয়েও আলাপ হতো।

একসঙ্গে নৌকায় করে অনেক ঘুরেছি। জব্বারের মোড়ে একসঙ্গে খাওয়া, আমবাগানে আড্ডা, মাঝরাতে পরোটা–মিষ্টি আর দই খাওয়া। সব মিলিয়ে সুন্দর একটা পথচলা। তবে ধীরে ধীরে সবার ব্যস্ততা বেড়েছে। এখন আর আয়োজন করে দেখা হয় না। তবে যখনই দেখা হয়, মনটা ভালো হয়ে যায়। সেতু আর মিজান মাঝেমধ্যে আসে আমার রুমে। আমার ঘরে কোনো খাবার দেখলেই বলে, ‘নিয়ে গেলাম।’ আমিও বলি, ‘ইচ্ছা হলে খেয়ে যা। নেওয়া যাবে না।’

ঈদে বা যেকোনো ছুটিতে বাড়িতে যাওয়ার সময় আমরা একসঙ্গে যাই। আসিফের বাড়ি একটু দূরে। বাকি চারজনের বাড়ি পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে। তাই বাড়িতে গেলেও প্রতিদিন বিকেলে দেখা হয়। অন্য বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে খেলা হয়, খাওয়াদাওয়া হয়, সেই আগের দিনগুলোর মতো।